কৃষিতে শিক্ষিত বেকারদের সম্পৃক্ত করা জরুরী
ঢাকাঃ আমাদের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থান একটি বড় চ্যালেঞ্জ। যে হারে মানুষ বাড়ছে, সে হারে সরকারি কিম্বা বেসরকারি কোন খাতেই কর্মসংস্থান বাড়ছে না বরং প্রতিনিয়তই শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছেই। ফলে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক ধরনের হতাশা, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভাবনায় অনেকেই ঝিমিয়ে যাচ্ছেন। বসে বসে যাদের সময় কাটাতে হয়।
আবার লেখাপড়া শেষে বয়স হলে অনেকেই বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। বিয়ে করায় বাবা মায়ের সংসারের বোঝাও আবার বেড়ে যায়। অনেক সময়ই এ নিয়ে পারিবারিক অশান্তি সৃষ্টি হয়। অথচ প্রতিটি শিক্ষিতই কাজ করে বাঁচতে চায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, দেশে কর্মসংস্থান যেন ‘সোনার হরিণ’। অথচ হাতে শক্তি আছে, কাজ করার স্পৃহা আছে, অথচ কাজ নেই।
এটা যে কত কষ্টের, যা ভুক্তভোগীরাই হাঁড়ে হাঁড়ে উপলব্ধি করছেন। কিন্তু এ অবস্থার পরিবর্তন কিভাবে আসবে? যা নিয়ে জনমনে যেমন উদ্বেগ আছে, তেমনি সরকারও ভাবছে কিভাবে সংকট নিরসন করা যায়! সম্প্রতি সরকার কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ‘কর্মসংস্থান অধিদপ্তর’ নামে একটি অধিদপ্তর গঠনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। একই সঙ্গে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে করা হয়েছে, ‘কর্মসংস্থান অনুবিভাগ’। যারা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি তৈরি, এ বিষয়ে গবেষণা, কর্মসংস্থান নিয়ে ডাটাবেজ তৈরিসহ নানা পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছেন।
বিশেষ করে অধিদপ্তর গঠনের পর দায়িত্ব, কাজের পরিধি দু’টোয় বেড়েছে। যারা নতুন নতুন পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছেন। যদি উপযুক্ত ও প্রয়োজনীয় জনবল কাঠামো দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সহায়তা দেয় এবং সরকারি প্রত্যক্ষ পৃষ্টপোষকতা থাকে, তাহলে অধিদপ্তর গঠন করে সুফল মিলবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। আর এসব ঠিকঠাক মতো না করলে ‘ঠুঠো জগন্নাথের’ ন্যায় নাম সর্বস্ব অধিদপ্তর কার্যত কোন সফলতা আনতে পারবে না। আমরা মনে করি, কর্মসংস্থান যেহেতু এখন বড় সমস্যা, যা সমাধানে সরকার অধিদপ্তর গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েই সঠিক কাজটি করেছেন। নব-গঠিত অধিদপ্তর গঠনের মুল উদ্দেশ্যই সফল হবে, আমরা এই প্রত্যাশাই করছি।
আমাদের দেশটি কৃষিনির্ভর। মুলত কৃষিই অর্থনীতির মুল চালিকা শক্তি। কৃষিই হতে পারে সমৃদ্ধ অর্থনীতির চাবিকাঠি। সেই কৃষি চাষাবাদে শিক্ষিত যুব সম্প্রদায়ের তেমন কোন ভুমিকা নাই। অথচ শিক্ষিত যুব সম্প্রদায় কৃষি উৎপাদনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে। চীনসহ উন্নত দেশগুলোর কৃষিতে শিক্ষিতরাই প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে জড়িত। ফলে সেসব দেশ কৃষিতে অভাবনীয় সফলতা এনেছে। চাষাবাদের ক্ষেত্রে এখন যান্ত্রিকরণ হচ্ছে, কম সময়ে জমিতে অনেক বেশি কাজ করাও সম্ভব হচ্ছে।
ফলে কৃষিও সমৃদ্ধ হচ্ছে। আর আমাদের দেশের কৃষি চাষাবাদের চিত্র প্রায় মান্ধাত্বা আমলের। যদিও গরু দিয়ে লাঙ্গলের চাষ আর এখন হয় না, তবুও অন্যান্য কাজের পুরোটাই এখনও কৃষি মজুর নির্ভর। ফলে কৃষি শ্রমিকের অভাবে এখন চাষাবাদও দারুনভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। যদিও ইতিমধ্যেই কৃষির মাঠে কিছু কিছু যন্ত্রচালিত যানের দেখা মিলছে, যা অতি যৎসামান্যই।
বলতে গেলে অনেকটা প্রদর্শনির ন্যায়। হয়ত এ অবস্থার উন্নতি হবে, আর কৃষি চাষাবাদে পুরো যান্ত্রিকীকরণ করা সম্ভব হলে, তখন প্রশিক্ষিত শিক্ষিত যুবকরাই কৃষির মাঠে বড় ধরনের অবদান রাখতে সক্ষম হবে। এ কারণে প্রশিক্ষণ, যান্ত্রিকীকরণই পারবে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে কৃষি চাষাবাদে সম্পৃক্ত করতে। তাহলে একদিকে কৃষির সমৃদ্ধি হবে, অন্যদিকে শিক্ষিত বেকারদেরও কর্মসংস্থান হবে। অবশ্য এবারের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সরকার কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের উপর জোর দিয়ে কৃষির কাজে যন্ত্রের উপর শুল্কহার শূন্য করেছে।
যেহেতু দেশে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভাল না। বিশেষ করে প্রতিবছরই দেদার অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে। অথচ অর্থ বিদেশে পাচার না করে দেশে বিনিয়োগ করলে লাভ, মর্যাদা দু’টোই বাড়তো। কিন্তু পাচারকারীরা তা করেন না। কারণ তাদের অর্থ ব্যবসা বাণিজ্য করে লভ্যাংশের অর্থ নয়, এ অর্থ দুর্নীতির ও লুটপাটের। ফলে যারা দুর্নীতি, লুটপাট করে অর্থ কামাবে তারাতো সে অর্থ পাচার করবে, এটাই স্বাভাবিক। কারণ অর্থ হলেই চটকরে কেউ উদ্যোক্তা হতে পারেন না।
কারণ শিল্প কলকারখানা করতে হলে অভিজ্ঞতা থাকাও জরুরী। সে অভিজ্ঞতা যখন দুর্নীতিবাজদের থাকে না, তখন বিদেশের ব্যাংকে টাকা রাখাকেই নিরাপদ মনে করেন। আর টাকা পাচারের স্বার্থে তারা আমদানি-রফতানিতে অভার-আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের আশ্রয় নেন। কারণ অর্থপাচারে আমদানি-রফতানির মাধ্যমে আন্ডার-ওভার ইনভয়েসিং একটি নিরাপদ মাধ্যম। ফলে দেশের স্বার্থ ক্ষুন্ন হয়, দেশ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে স্থবির হয়ে পড়ে। এজন্য দেশপ্রেম থাকা খুবই জরুরি।
কিন্তু আমাদের দেশে সৎ, নির্ভিক, দেশপ্রেমিক মানুষের বড় অভাব। অথচ বিশ্বের উন্নত দেশগুলো পুঁজিবাদি হলেও সেসব দেশের ব্যবসায়ী, রাজনীতিকদের যথেষ্ট দেশপ্রেম রয়েছে। ফলে তারা অর্থনীতিতেও সমৃদ্ধ হচ্ছেন, আবার সেসব দেশের অর্থ বিদেশে সহসাই পাচারও হয় না। ফলে উদ্যোক্তা সৃষ্টি হয়, বিনিয়োগ বাড়ে, কর্মসংস্থানও হয়। ফলে বেকারত্বের হারও কম থাকে।
অর্থনীতিও সমৃদ্ধ হয়। আর আমাদের দেশের ক্ষমতাসীনরা সুন্দর সুন্দর নীতিবাক্য উচ্চারণ করেন সত্য! উপদেশ নসিহত করেন, দেশপ্রেমের মায়া কান্না করেন, অথচ দুর্নীতি, লুটপাট করেন সমানে। আর তারাই টাকাও পাচার করেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় কোটিপতিদের ছড়াছড়ি জাতি দেখলো। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা! এখন মাঝে মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী বলেন- চাকুরি না খোঁজে অন্যকে চাকুরি দেন। ভালো কথা, অন্যকে চাকুরি দেওয়ার সামর্থ অর্জন করতে পারলে তো, তার আনন্দই আলাদা।
এ জন্য উদ্যোক্তা হতে হবে। আর উদ্যোক্তা হতে হলে, পুঁজি, পরিকল্পনা, সুযোগ সবই লাগবে। তা না হলে একজন শিক্ষিত বেকার ছেলে হঠাৎ কি করে চাকুরি না খোঁজে উদ্যোক্তা হবেন? এটা যে কেউ চাইলেই করতে পারবেন না। এ জন্য সরকারের পরিকল্পনা থাকতে হবে। বাজেটে অর্থ বরাদ্দ রেখে উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিতে হবে। শুধু ঋণ দিলেই হবে না, উদ্যোক্তার উৎপাদিত পণ্য বিপণন, সংরক্ষণে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও থাকতে হবে। যেন উৎপাদিত পণ্য উদ্যোক্তা সহজেই বিক্রি ও ঠিকমতো সংরক্ষণ করতে পারে।
আমাদের দেশে পোল্ট্রি শিল্পের সমূহ সম্ভাবনা ছিল। অনেক শিক্ষিত যুবক এই শিল্পে সম্পৃক্ত হয়ে ভালই করছিলেন। গোটা দেশেই পোল্ট্রি শিল্পের অভাবনীয় সফলতাও এসেছে। ছোট-মাঝারি আকারের খামার গড়ে ওঠেছে। অনেকেই ভালভাবেই ব্যবসা করছিলেন। হঠাৎ এ ব্যবসায় ধস নামে, অনেকেই পুঁজি হারিয়ে পথে বসে যান। ফলে একে একে ছোট খামারগুলো বন্ধ হতে থাকে।
এখনও সে অবস্থায় তেমন কোন উন্নতি ঘটে নাই। অনেকেই ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়ে গেছেন। অথচ দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিকাশ ছাড়া অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন, কর্মসংস্থান কোনটিই সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের দেশে ক্ষমতাসীনদের ভ্রান্তনীতি, দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন কিম্বা টিকে রাখতে পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে চালকল শিল্প, পাটশিল্প, চিনি শিল্প ধ্বংস হয়ে গেছে। ফলে প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে লাখ লাখ মানুষকে কর্মসংস্থান হারাতে হয়েছে।
এ অবস্থা থেকে উত্তোরণের কার্যকরি কোন উদ্যোগও সরকারের নেই। বৈশ্বিক মহামারি করোনার কবলে পড়ে গোটা বিশ্বের অর্থনীতিই বিপর্যস্ত হয়েছে। এতে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থাও নাজুক হয়েছে। যা মোকাবেলায় সরকার ক্ষুদ্র মাঝারি ও বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানকে রক্ষায় বিশেষ বরাদ্দ দিয়ে স্বল্প সুদের ঋণ বিতরণও করেছে। জানা গেছে, সহায়তায় এ অর্থ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে মাত্র ২০ শতাংশ বিনিয়োগ হয়েছে। আর বড় বড় শিল্প খাতে ৮০ শতাংশ প্রদান করা হয়েছে।
বরাবরই একটি পুঁজিবাদি কাঠামোর অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বেশি হলেও তারা সরকারের সহায়তা সেভাবে পান না। যা গুটিকতক ব্যবসায়ীদের মধ্যেই প্রদান করা হয়। ফলে ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্প সফলভাবে দাঁড়াতে পারে না।
তবে, আশার কথা সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষিত তরুণ-তরুণি যুবকদের অনেকেই পরিকল্পিতভাবে কৃষি চাষাবাদে কাজ শুরু করেছেন। উল্লেখ্য, শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ শিক্ষা নিয়ে টাঙ্গাইলে নিজ এলাকায় ফিরে কৃষি ও খামারে আত্মনিয়োগ করেছেন আতাউর রহমান। নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার বাগধনা গ্রামের আল হেলাল উচ্চ শিক্ষা শেষ করে কৃষি কাজ, ফলজ বাগান, দেশি মুরগির খামার, কবুতর পালন করে স্বাবলম্বী হয়েছেন।
অনেক শিক্ষিত যুবক কৃষক পর্যায় থেকে ফসল সংগ্রহ করে ফেসবুক পেজের মাধ্যমে বিক্রিও করছেন। খুলনার দাকোপ এলাকার উচ্চ শিক্ষিত তরুণী হাসনা হেনা বাংলাদেশ টেলিভিশনে ছায়াবানী অনুষ্ঠান করতেন। পরে তিনি অস্ট্রেলিয়ায় ১৪ বছর কাটিয়ে দেশে ফিরে এসে সমন্বিত কৃষি খামার গড়ে তুলে এলাকায় আলোড়ন তুলেছেন। বিশেষকরে বিষমুক্ত সবজি চাষ, হাঁস মুরগি ও ভেড়া পালন ও মাছ চাষ করে নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন।
শুধু এনারাই নন, এমনি লাখ লাখ শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা এখন বিজ্ঞানভিত্তিক উন্নত কৃষি চাষাবাদে নিজেদের সম্পৃক্ত করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন এবং বহু মানুষের কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করছেন। বিশেষ করে আমাদের দেশে খাদ্যে ভেজাল, বিষ, কেমিক্যালের মত ফরমালিনের আগ্রাসনে মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি এখন অনেক বেশি। সব ভোক্তাই বিষমুক্ত, ফরমালিনমুক্ত প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত পণ্যই কিনতে চান।
কৃষি কাজে শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা যুক্ত হওয়ায় দায়িত্ববোধ, সচেতনতা এবং মানবিক মুল্যবোধের কারণে বিষমুক্ত ফল ফলাদি, সবজি, মাছ মাংসই তারা উৎপাদন করে বিপণন করবে, এটা প্রত্যাশা রাখাই স্বাভাবিক। আমরা আশাবাদি, শিক্ষিত যুব সম্প্রদায় যেন সমন্বিত পদ্ধতিতে চাষাবাদ করতে পারে, এ জন্য সরকারি সহায়তা ও স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করে প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা দিতে পারলে আধুনিক প্রযুক্তির কৃষিতে আরও বেশি করে শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা নিজেদের জড়িয়ে ফেলবেন।
এ জন্য সহজ শর্তে সরকারি খাসজমি ইজারা প্রদান করে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে ব্যক্তি উদ্যোগ কিম্বা সমবায় ভিত্তিক আধুনিক চাষাবাদে সরকারি ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে। তাহলে শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
লেখকঃ আব্দুল হাই রঞ্জু
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৩/০১/২০২৪