জাতির মেরুদণ্ড শিক্ষা নয়, শিক্ষক
ড. মুহাম্মদ কামাল উদ্দিনঃ শিক্ষা সুষ্ঠু সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এক মৌল উপাদান। আর এ উপাদান যে সমাজে যত বেশি প্রবেশ করেছে, সেই সমাজ তত বেশি উন্নয়ন, উৎপাদন ও কল্যাণের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। একটি জাতির, সভ্যতার প্রধান মাপকাঠি শিক্ষা। শিক্ষাকে তাই যুগে যুগে জাতির মেরুদণ্ড হিসেবে সবাই স্বীকৃতি দিয়েছেন। আর এ নিয়ে নানা আলোচনা দীর্ঘদিন শুনে আসছি। ‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’ আধুনিক সমাজ মেনে নিচ্ছে না, এ বক্তব্যকে আধুনিক সমাজ প্রত্যাখ্যান করছে এবং বক্তব্যটি যথার্থ নয়। প্রকৃত অর্থে ‘শিক্ষকরাই’ জাতির মেরুদণ্ড এ কথাটি যথার্থ, সময়োপযোগী ও ন্যায়সংগত। তবে প্রশ্ন—কোন শিক্ষক? অবশ্যই আদর্শ শিক্ষক। একজন আদর্শ শিক্ষক কেমন হবেন?
শিক্ষাবিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘শিক্ষার্থীর মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত প্রতিভাকে জাগ্রত করবেন শিক্ষকের মন-মানস দিয়ে। আর এ কাজটি যিনি নিজ দায়িত্বে করবেন তাকে আদর্শ শিক্ষক বলা হবে।’ শিক্ষার্থীর প্রতিভা জাগ্রত করার এ মহান কাজটি শুধু তিনিই করতে পারেন, যিনি শিল্পী। শিল্পীর মন ও মানস না থাকলে কখনো এ কাজটি করা সম্ভব নয়। অথচ শিক্ষককে বলা হয় ‘কারিগর’। একজন কারিগর আর একজন শিল্পীর তফাত বোঝার সময় এসে গেছে। শিক্ষক কারিগর এ কথা সনাতন। শিক্ষকরা শিল্পী এ কথাই যথার্থ-যুপোযোগী। সুতরাং শিল্পীর বোধ ও জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে যিনি দায়িত্ব পালন করবেন তাকে বলা হবে শিক্ষক। আর যিনি এ কাজটি করতে ব্যর্থ হবেন তাকে শিক্ষার্থী গ্রহণ করবে না, প্রকৃতপক্ষে তিনি কারিগরশিল্পী নন।
সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম—আগেও, এখনো; বেসরকারি বেশি। বেসরকারি জন্ম সাধারণত শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গের উৎসাহ ও উদ্যোগে; ইদানীং অধিকাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে ব্যক্তিবিশেষের উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ধরন, শিক্ষকদের নিয়োগ, শিক্ষার পরিবেশ নিয়ে আগেও বিতর্ক ছিল, এখনো আছে। দেশের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী এক সেমিনারে বক্তব্যে বলেন, ‘বিদ্যুৎ খাতের চেয়েও আমাদের শিক্ষা খাতে সিস্টেম লস বেশি। এ অবস্থা বন্ধ করতে না পারলে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ অর্থের রক্তক্ষরণ বাড়বে। শিক্ষার নামে অপ্রয়োজনীয় হওয়া সত্ত্বেও এক-এক এলাকায় অসংখ্য স্কুল-কলেজ গড়ে উঠছে। একটি থানায় ১৬টি কলেজ আছে অথচ প্রতি কলেজে ২০-৩০ জনের বেশি ছাত্র নেই।’ (শিক্ষাব্যবস্থা প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ)
মন্ত্রীর এ বক্তব্য দেশের প্রতিটি সংবাদপত্রে ছাপানো হয়। তার এ উপলব্ধি যথার্থ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনার সুযোগ দিল কারা? এসব প্রতিষ্ঠানে পাঠদান কতটা হয়, তা ধর্তব্য নয়, বিচার্যও নয়। রুটিন থাকে, সে রুটিনমাফিক ঘণ্টাও বাজে, স্কুল বসে, ছুটি হয়, শিক্ষার্থী ক্লাস টপকায় কিন্তু সে কতটা শিক্ষা লাভ করল, কতটা জ্ঞানার্জন করল, কতটা যোগ্যতার ভিত্তিতে, তাও জিজ্ঞাস্য বটে।
ইংরেজি Education কথাটির মূল লাতিন অর্থ হলো—‘ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ সম্ভাবনাকে অগ্রসর করে নেওয়া।’ শিক্ষার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে শিক্ষাবিজ্ঞানীরা বলেছেন, ‘Education is nothing but the gradual and harmonious development of body, soul and mind.’ যা কিছু শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণ করা হয়, তাই শিক্ষা। আর শিক্ষা বলতে সুশিক্ষাকে বোঝায়। শিক্ষার সংজ্ঞা যাই হোক না কেন, আমাদের দেশে শিক্ষাগ্রহণ এবং শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশের আগে প্রয়োজন একটি শিক্ষানীতি। এ দেশে ব্যবসানীতি হয়েছে, খাদ্যনীতি হয়েছে, চাকরিনীতি হয়েছে, স্বাস্থ্যনীতি হয়েছে কিন্তু একটি জাতির মানদণ্ড নির্ভর করে তার শিক্ষার ওপর। দুর্ভাগ্য এ দেশে শিক্ষার কোনো নীতি হয়নি, হচ্ছে না। শিক্ষা-অভিমানীরা অনেক কথা শিক্ষা সম্পর্কে বলেছেন কিন্তু সমাধান হয়নি। না হওয়ার কারণ কী? কারণ যাই হোক, স্বাধীনতার ৩৮ বছরে শিক্ষার জন্য কম সেমিনার হয়নিস্বাধীনতার পর অনেক শিক্ষানীতি হয়েছে, কমিশন হয়েছে। কাজ হয়নি। শিক্ষার দিক-নির্দেশনার জন্য কমিটি বারবার রিপোর্ট দিয়েছে কিন্তু কোনো কমিটির রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি। কেন? বারবার প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে আমাদের শাসকশ্রেণিকে। কিন্তু নকল বন্ধের মাধ্যমে শিক্ষার প্রসারতা আনয়ন সম্ভব নয়। জাতীয় জীবনে শিক্ষার প্রসারতা, শিক্ষার সংস্কার একটি সরকারের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে না, এটি একটি জাতীর শিক্ষানীতির ওপরও নির্ভরশীল। শিক্ষানীতি ছাড়া একটি জাতির শিক্ষা ভূলুণ্ঠিত হয়ে পড়ে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে-শিক্ষকদের মননে আজ জ্ঞানার্জনের পরিবর্তে অর্থার্জনই বড়। সাধনা, জ্ঞানচর্চা, শিক্ষাদান সবই এখন অপস্রিয়মাণ। সার্টিফিকেট-সর্বস্ব উচ্চাভিলাষী ডিগ্রিধারী তৈরিতে আমাদের আয়োজন। যার ফলে সরকার কথা দিয়েও কথা রাখছে না। আমরাও আদায় করে নিতে পারছি না। সরকার বলছে শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ, তাহলে শিক্ষকদের অর্থ না দিয়ে কোন খাতে এত বরাদ্দ সরকার দিচ্ছে তাও দেখা দরকার। শিক্ষকদের পেশাগত মান বৃদ্ধির জন্য যে কাগুজে বিধান আছে, তা বাধ্যতামূলক নয় বলে ঐচ্ছিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এর সঙ্গে সংগতি রেখে একজন শিক্ষকের পদোন্নতি, স্কেল উত্তরণ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। অথচ এ ব্যবস্থা সুচারুরূপে পরিচালিত হলে সর্বাধুনিক শিক্ষার সঙ্গে শিক্ষকদের মধ্যে পেশাগত দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন ও সতর্কতা উভয়ই বৃদ্ধি পেত। বর্তমানে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার মান নিম্নমুখী হওয়ার কারণ শিক্ষা সম্পর্কে অধিকাংশ শিক্ষকের নিস্পৃহতা এবং শিক্ষকতাকে মাত্রই অর্থোপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে মনে করা। পরিতাপের বিষয় হলো, আজকের অনেক শিক্ষকই বিএড প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন স্কেল উত্তরণের জন্য।
আমাদের মতো অর্থনৈতিকভাবে গরিব ও সামাজিকভাবে পশ্চাৎপদ দেশে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে একটি ন্যায়ভিত্তিক, যুগোপযোগী, আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত, অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন, জনকল্যাণমুখী ও বিশ্বমানের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন এ কাজে নিয়োজিত শিক্ষকের দিকে নজর দেওয়া। কারণ একজন দক্ষ ও মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন শিক্ষক পারেন তার শিক্ষার্থীকে সময় ও আধুনিক সময়ের সঙ্গে গড়ে তুলতে। অথচ এ জায়গায় বারবার আমরা ভুল করছি। একটি আধুনিক শিক্ষানীতি, বৈষম্যহীন শিক্ষানীতির জন্য সবার মনোনিবেশ থাকলে শিক্ষক নিয়োগ এবং তার পরিচর্চাও হবে উপযুক্ত, এতে সমগ্র শিক্ষার উন্নয়ন হবে। শিক্ষাদান একটি সৃজনশীল কর্ম এবং এ শিক্ষাদানের মানের ওপরই নির্ভর করে আগামী দিনের শিক্ষিত জনসম্পদের গুণাগুণ। এজন্য সমাজের সর্বপেক্ষা প্রতিভাশালী ব্যক্তিদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করতে হবে। দুর্ভাগ্যক্রমে দীর্ঘদিনের অবহেলার ফলে শিক্ষকতা পেশা, বিশেষ করে বিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকতা, এ আকর্ষণ ক্ষমতা নিদারুণভাবে হারিয়ে ফেলেছে। তাই আজ বেশি করে প্রয়োজন শিক্ষার সব স্তরে উচ্চতম যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের আগমন এবং শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ড না ভেবে প্রথমে শিক্ষককে জাতির মেরুদণ্ড ভাবতে শেখা। কারণ একজন অদক্ষ শিক্ষক কখনো জাতির মেরুদণ্ড ঠিক করতে পারে না। তাই শিক্ষক নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাসহ শিক্ষার উন্নয়নে আধুনিক ধ্যান-ধারণার প্রয়োগ সময়ের দাবি।
লেখক: শিক্ষাবিদ-নজরুল গবেষক
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/৩১/১২/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়