শিক্ষায় বৈষম্য নিরসনে প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পুনর্জাগরণ
এএন রাশেদাঃ জাতি এ বছর বিজয়ের আরও একটি বছর অতিক্রম করেছে। এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন, ৩০ লাখ শহীদ ও ৩ লাখ নারীর হৃদয়বিদারক কান্না ও নরকতুল্য যন্ত্রণাময় জীবনের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশে এত বছর পরও কি আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সেই কাঙ্ক্ষিত মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে পেরেছি? উত্তর প্রীতিকর নয়। বিবেকহীন মনুষ্যত্বহীন এবং তথাকথিত মানুষে পরিপূর্ণ। সমাজ, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, শিক্ষা বোর্ড, মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্র যেন অমানুষ বা মনুষ্যত্বহীনদের স্বর্গরাজ্য। যারা বিবেক বাঁচিয়ে রাখতে চান তারা যেন নিষ্পেষিত, ম্রিয়মাণ। বিবেকহীনদের দৌরাত্ম্য আজ সর্বত্র, তারা সর্বগ্রাসীরূপে আবির্ভূত। ৬ নভেম্বর, ২০২৩-এ একটি দৈনিকে প্রকাশ : ‘পরিচালনা কমিটির পেটে কোটি কোটি টাকা’। তারপর তারা লিখেছে, ‘সরকারি তদন্তে প্রমাণ মিলেছে ৩০৪ কোটি টাকা লোপাটের, ১৩ সদস্যের কমিটি চলে মাত্র ছয়জন দিয়ে’ ইত্যাদি। খবরের উদ্ধৃতি আরও দেওয়া যাবে। উদ্ধৃতির মধ্য দিয়ে একটি প্রতিষ্ঠানের লজ্জাজনক কাহিনী উঠে এসেছে। এমন হাজার হাজার ঘটনা প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সংঘটিত হচ্ছে।
কিছুদিন আগে সংবাদমাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছিল মিরপুর মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের লজ্জাজনক কাহিনী একের পর এক প্রকাশিত হচ্ছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্যবিদায়ি উপাচার্যকে নিয়ে এক পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে ‘আত্মীয়দের ডেকে ডেকে চাকরি দেন ঢাবি ভিসি’। গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির অপকর্মের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিন আন্দোলন করতে হয়েছে। সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ব্যক্তিদেরই যখন অনৈতিকতার খবর বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত হয়, তখন তো ‘শিক্ষা’কে বাতি দিয়ে খুঁজতেই হয়। শিক্ষকদেরই যখন এই করুণ পরিণতি তখন শিক্ষার্থীদের অবস্থা আর কী হতে পারে, তা ইডেন মহিলা কলেজ থেকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে ছাত্রকে মারতে মারতে মেরেই ফেলা হয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট মেডিকেল কলেজসহ সব সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে।
সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে আরও প্রকাশিত ‘রেজিস্ট্রেশন কার্ড বিতরণে বেপরোয়া ঘুষবাণিজ্য, বিব্রত শিক্ষা বোর্ড কর্তারা’। ওই সংবাদে বলা হয়েছে, ‘এসএসসি পরীক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন কার্ড বিতরণে বেপরোয়া ঘুষবাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের কিছু কর্মচারীর বিরুদ্ধে। কার্ড সংগ্রহে বোর্ডে আসা প্রধান শিক্ষক, শিক্ষক ও কর্মচারীদের কাছ থেকে তারা প্রকাশ্যেই টাকা নিচ্ছেন।’ ঘুষ-দুর্নীতি সারা দেশসহ শিক্ষাব্যবস্থারও একটি নিরাময়-অযোগ্য কঠিন রোগ। অপারেশন ছাড়া যা নির্মূল করা সম্ভব নয়। ১৯৭১-এ একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পর এ দেশবাসীর আকাঙ্ক্ষা ছিল সব মানুষের জন্য শোষণমুক্ত সমাজ নির্মাণের; যেখানে দুর্নীতি, অন্যায়, অবিচার থাকবে না। আজ ৫২ বছর পর এসেও সেই খেদোক্তি আমাদের করতে হচ্ছে, শুনতে হচ্ছে শিক্ষার সংকটের কথা, বৈষম্যপূর্ণ সমাজের কথা। আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে এ খেদোক্তি করেই ১৯৮৪ সালে ‘আমাদের শিক্ষার সংকট’ প্রবন্ধে শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী লিখেছিলেন, ‘শিক্ষার ক্ষেত্রে আজ যে সংকটের মুখোমুখি হয়েছি আমরা, তা শুধু একক ও বিচ্ছিন্নভাবে শিক্ষার সংকট নয়।… কেবল শিক্ষাক্ষেত্রে ভাসা ভাসা দুয়েকটি সংস্কার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের শিক্ষার সংকটাবর্ত থেকে উদ্ধার পাওয়ার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত।’
স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও আমরা ভাসা ভাসা সংস্কারের মধ্যেই ডুবে আছি। অথচ শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের সঙ্গে সমাজের সব উন্নয়ন জড়িত। শিক্ষাই উন্নয়নের চাবিকাঠি। তার জন্য প্রয়োজন সঠিক বিনিয়োগ, সমাজে শিক্ষকের সম্মানজনক অবস্থান নিশ্চিতকরণ; যাতে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশাকে সর্বাগ্রে পছন্দের পেশা বলে বেছে নেয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে মানব উন্নয়ন মন্ত্রণালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগ যা হবে ১:৩০ অনুপাতে। সব শিশুকে স্কুলে আনার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ এবং শিক্ষা হবে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক। শিক্ষা হবে জীবনমুখী ও জীবনব্যাপী। বর্তমান সরকার যে নানা মতপার্থক্য নিয়ে জীবনমুখী শিক্ষাব্যবস্থার দিকে নজর দিয়েছে বলে বলা হচ্ছে তা বাস্তবে সত্য নয়। সেখানে অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা নেওয়া হয়নি। শিক্ষকদের মধ্যে নেওয়া হলেও তা হয়েছে খুবই নগণ্য। প্রক্রিয়া চলছে তবে পরিণতি ভালো বলে মনে হচ্ছে না। এমন হঠাৎ করে পরিবর্তনের প্রচেষ্টা আগেও ছিল। কিন্তু তার পরিণতি সুখকর হয়নি।
১৯৯৪ সালে প্রণীত হতে যাচ্ছিল তথাকথিত ‘এক ধারার শিক্ষানীতি’র নামে মাদ্রাসামুখী শিক্ষানীতি। ছাত্রদের আন্দোলনের ফলে তা বাতিল হয়েছিল। আবার ১৯৯৩ সালে মাধ্যমিক পর্যায়ে শুরু হয়েছিল ৫০০ প্রশ্ন ব্যাংক’ থেকে ১০০ নম্বরের মধ্যে অবলীলায় ৫০ নম্বর প্রাপ্তির খেলা। এই অপকর্মে মেতে উঠেছিল পাঁচ থেকে ১০ বছর আগে লেখাপড়া ছেড়ে দেওয়া ব্যক্তিরাও, তারা মাধ্যমিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে নিয়েছিল। এত বেশি শিক্ষার্থী পাস করার ফলে অনেক স্থানে অনেক কলেজও গজিয়ে উঠল। কিন্তু তাদের বেশিরভাগই দু-তিন বার উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েও পাসের সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে পারেনি। তারপর এলো ২০১০ থেকে সৃজনশীল পদ্ধতি, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা; যা পিএসসি নামে প্রচারিত হয়েছিল। অষ্টম শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষাকে বলা হলো জেএসসি, শিক্ষানীতিতে এসব পরীক্ষার সুপারিশ না থাকলেও তা করা হলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একক সিদ্ধান্তে; যা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন বিপদগ্রস্ত করে তুলল। প্রশ্নফাঁস, খাতা দেখে দেখে লেখা অর্থাৎ নকল করা; পঞ্চম শ্রেণিতেই শিক্ষার্থীদের অভ্যস্ত করে তোলা হলো। ২০২২-এ এসে আবার তা বাতিল করা হলো। ২০২৩-এ শুরু হয়েছে নতুন পদ্ধতি যে ব্যাপারে শিক্ষক, অভিভাবক কাউকে ভালোভাবে প্রস্তুত করা হয়নি।
ভাবা হয়েছিল, শিক্ষা কার্যক্রম, শিক্ষাদান পদ্ধতি, পাঠ্যপুস্তক ইত্যাদি এমনভাবে প্রণীত হবে যাতে শিক্ষার্থীর মন বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্রের মূল্যবোধ ও ধ্যানধারণা পুষ্ট হয়। ভাষানীতি, সর্বস্তরে শিক্ষার মাধ্যম সম্পর্কে সিদ্ধান্ত, সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বৈষম্য দূরীকরণের ব্যবস্থা, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিতকরণের উদ্যোগ নেওয়া হবে এটাই ছিল সঙ্গত প্রত্যাশা । কিন্তু দেখছি, আমাদের মূল্যবোধগুলো যেন হারিয়ে গেছে! তাই প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পুনর্জাগরণ।
লেখকঃ শিক্ষাবিদ ও সম্পাদক, শিক্ষাবার্তা
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২২/১২/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়