ভালো স্কুল বলতে আসলে কী বোঝায়?
তারিক মনজুরঃ সন্তানকে কোন স্কুলে ভর্তি করা যায়, এ নিয়ে অভিভাবকদের চিন্তা করতে হয়। এ চিন্তা বছর শেষে দুশ্চিন্তায় পরিণত হয়। কেননা, তাঁরা চাইলেই যেকোনো স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করাতে পারেন না। প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ‘সেরা’ স্কুলগুলোতে ফাঁকা আসনের বিপরীতে ১০-১৫ গুণ শিক্ষার্থী আবেদন করে। আর যেসব স্কুলের ‘সেরা’র তকমা নেই, সেখানে ক্লাস শুরু হওয়ার পরও আসন খালি থাকে।
প্রতিবছরই এ ধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। তবে এ বছরের সংকট আগের বছরগুলোকে হার মানিয়েছে।
এবার নতুন শিক্ষাবছরে ভর্তির জন্য অনলাইনে আবেদন নেওয়া হয় গত অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত। এর এক মাস পর এই ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে কেন্দ্রীয় লটারি প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে, আড়াই লাখের বেশি শিক্ষার্থী কোনো স্কুলে ভর্তি হতে পারেনি।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) বলছে, স্কুলে কোনো আসনসংকট নেই; যেসব শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারেনি, তারা সরাসরি ভর্তি হতে পারবে।
আসনসংকট না থাকলেও এই পরিস্থিতি তৈরি হলো কেন? কারণ, এই আড়াই লাখ শিক্ষার্থী যেসব স্কুলকে তাদের পছন্দের ক্রমে রেখেছিল, সেখানে আগেই আসন পূর্ণ হয়ে গেছে।
কোন স্কুলগুলো পছন্দের ক্রমে প্রথম দিকে থাকে, সেটি আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। অভিভাবকদের চোখে এগুলো ‘সেরা’ স্কুল। লটারি পদ্ধতির আগে এসব স্কুলে ভর্তির জন্য অর্থ লেনদেনের কথাও শোনা যেত। এখন জিজ্ঞাসা, সেরা নির্ধারিত হয় কিসের ভিত্তিতে?
অভিভাবকদের কাছে সেরা স্কুল সেগুলো, যেগুলো বোর্ড পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে। এই ভালো রেজাল্টের পেছনে কী কী কারণ থাকে, সেগুলো কেউ তলিয়ে দেখতে চান না।
এমনকি রেজাল্টের বাইরে অভিভাবকেরা স্কুলের আর কিছু বিবেচনায় নেন না। স্কুলটি বাসা থেকে কত দূরে, সেখানে বাড়তি কী কী সুযোগ-সুবিধা আছে, এসব নিয়ে তাঁরা ভাবতে চান না। অথচ বাড়ি থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দূরে হলে যাওয়া-আসার পথে প্রচুর সময় নষ্ট হয়। এর বাইরে শারীরিক ধকল তো রয়েছেই। তা ছাড়া বাড়ির কাছের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পাওয়া প্রত্যেক শিক্ষার্থীর অধিকার।
ভালো স্কুল বলতে আসলে কী বোঝায়? ভালো স্কুল হবে এমন, যার প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস চলাচল করবে। ভালো স্কুলে একটি উন্মুক্ত মাঠ থাকবে, যেখানে শিক্ষার্থীরা খেলতে পারবে। ভালো স্কুলে বই পড়ার জন্য লাইব্রেরি আর অনুষ্ঠান করার জন্য মঞ্চ বা মিলনায়তন থাকবে।
পড়াশোনার পাশাপাশি বেড়ে ওঠার জন্য যা যা দরকার, সব ধরনের সুযোগ থাকবে। সবচেয়ে বড় কথা, ভালো স্কুল হবে শিক্ষার্থীর বাড়ির কাছের স্কুল। অথচ সবকিছু বাদ দিয়ে অভিভাবকদের কাছে ভালো স্কুলের পরিচয় হয়েছে—রেজাল্ট। তাই প্রতিবছর শিক্ষার্থী ভর্তির সময়ে এসব স্কুলকে রীতিমতো চাপের মধ্যে থাকতে হয়।
এই চাপ কমানোর জন্য এ বছর ভর্তিপ্রক্রিয়া পুরোপুরি অনলাইনভিত্তিক করা হয়েছিল। কিন্তু বিপুলসংখ্যক আবেদনকারী ভর্তির সুযোগ না পাওয়ায় মাউশি এখন নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা বলছে, ভর্তি হতে না পারা শিক্ষার্থীরা আসন ফাঁকা থাকা সাপেক্ষে যেকোনো স্কুলে গিয়ে সরাসরি ভর্তি হতে পারবে।
‘হতাশ’ এসব অভিভাবক এখন বাধ্য হয়ে তাঁদের ‘পছন্দে না থাকা’ স্কুলগুলোতে যাবেন। অভিভাবকের হতাশা শিক্ষার্থীর মনেও প্রভাব ফেলতে বাধ্য। তাই নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের পড়াশোনা নিয়েও উৎকণ্ঠিত হতে হয়।
তাহলে এভাবেই কি চলতে থাকবে? ভালো স্কুল আর খারাপ স্কুলের দ্বন্দ্ব আসলেই কি শিক্ষার মান বাড়াতে সাহায্য করছে? আশার কথা, নতুন শিক্ষাক্রমে এর সমাধান আছে। এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করার সঙ্গে সঙ্গে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া গেলে সংকট দূর হতে পারে।
নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়ন বা পরীক্ষা নম্বরভিত্তিক রাখা হয়নি, রাখা হয়েছে পারদর্শিতাভিত্তিক; অর্থাৎ শিক্ষার্থীকে নির্ধারিত দক্ষতা অর্জন করে পরবর্তী শ্রেণিতে উঠতে হবে। এমনকি বোর্ড পরীক্ষাতেও কীভাবে নম্বরকে গৌণ করে দক্ষতার মূল্যায়নকে মুখ্য করা যায়, সেটা নিয়ে ভাবা হচ্ছে। ফলে প্রাইভেট-কোচিং আর নোট-গাইডের দৌরাত্ম্য থাকবে না। এর বাইরে সব স্কুলের একাডেমিক কার্যক্রম কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা করতে হবে।
যেমন কোন স্কুলে কোন শিক্ষক নিয়োগ পাবেন, সেটি কেন্দ্রীয় সমন্বিত পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ধারণ করা যায়। তাহলে এই স্কুলে ভালো শিক্ষক আছেন, ওই স্কুলে নেই—এ রকম মন্তব্য আর আসবে না। নির্বাচিত সব শিক্ষককে পূর্ণ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষে পাঠাতে হবে। শ্রেণিকক্ষে তাঁদের শিক্ষক সহায়িকা অনুসরণে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে।
প্রতিটি স্কুল যদি একই রুটিনে চলে এবং শিক্ষক সহায়িকা অনুসরণ করে একই ক্রমে পাঠদান করে, তবে স্কুলগুলোর গুণগত মানের ব্যবধান কমে আসবে। কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিজেদের মতো করে শিক্ষার্থীদের বাড়তি কিছু বই দিয়ে থাকে। এমন ক্ষেত্রে অভিভাবকদের ধারণা হয়, ওই স্কুল বুঝি বেশি ভালো। তাই এনসিটিবির নির্ধারিত বইয়ের বাইরে কোনো স্কুল যাতে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে বাড়তি বই না দেয়, সেদিকে কঠোর নজরদারি দরকার।
আশার কথা, সব ধরনের কেজি স্কুল বন্ধ করার সুপারিশ করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। যেখানে-সেখানে বিদ্যালয় স্থাপন, শিক্ষায় বাণিজ্যিকীকরণ, অতিরিক্ত মুনাফা করাসহ নানা অনিয়ম রোধ করতে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সুপারিশ অনুযায়ী, সরকারি ছাড়া সব স্কুল হবে ‘বেসরকারি স্কুল’।
এমন সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাতে হয়। শিক্ষা ও শিক্ষার্থীর স্বার্থেই সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের স্কুলকে নিয়মিত তদারকির মধ্যে রাখতে হবে। যেসব স্কুলে শিক্ষার পরিবেশে ঘাটতি আছে, সেগুলোকে শিক্ষার্থীর উপযুক্ত করে তুলতে হবে।
লেখকঃ অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৯/১২/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়
“মুক্তমত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”