সরকারি স্কুলমুখী অভিভাবক নেপথ্যে খরচের চাপ
।। ইকবাল খন্দকার।।
বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে যাদের বয়স চল্লিশের আশপাশে, তাদের যদি জিজ্ঞেস করা হয় আপনার জীবনের প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কোনটি, উত্তরে তারা কোনো না কোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম বলবেন। কারণ আজ থেকে বিশ, ত্রিশ, চল্লিশ বা পঞ্চাশ বছর আগে এ দেশের অভিভাবকরা পুরোপুরি আস্থা রাখতেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় তথা প্রাইমারি স্কুলের প্রতি।
তারা বিশ্বাস করতেন, এই প্রতিষ্ঠান তাদের সন্তানের শিক্ষার ভিত এমন মজবুতভাবে তৈরি করে দেবে, যে ভিতের ওপর নির্মাণ করা সম্ভব হবে উচ্চশিক্ষার ‘বহুতল ভবন’। তাদের এই বিশ্বাস আর আস্থা বিফলে যেত না। তাই প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয় মুখরিত থাকত শত শত শিক্ষার্থীর কলরবে। এর পর সামনে আসতে লাগল নানা অভিযোগ।
সব অভিযোগের সারমর্ম- সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ভালো পড়াশোনা হয় না। শিক্ষকরা ফাঁকিবাজি করেন। ক্লাসে বসে ঘুমান। যখন ইচ্ছে তখন আসেন। মন চাইলে আসেন, মন না চাইলে আসেন না। অভিযোগগুলো সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ঢালাওভাবে প্রযোজ্য না হলেও অধিকাংশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ফলে আস্তে আস্তে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করলেন অভিভাবকরা।
এক সময় দেখা গেল, সচেতন এবং সামর্থ্যবান অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের আর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছেনই না। পাঠাচ্ছেন বেসরকারি বিদ্যালয়ে। যেখানে শিক্ষা খরচ লাগামহীন। তবু তারা সেসব প্রতিষ্ঠানকেই বেছে নিয়েছিলেন, যেহেতু সেখানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চেয়ে অনেক বেশি যত্ন এবং দায়িত্ব নিয়ে পড়ানো হয়।
মোট কথা অভিভাবকদের কাছে অর্থ নয়, পড়াশোনাটাই মুখ্য ছিল। একই যুক্তিতে মাধ্যমিক পর্যায়েও তারা বেছে নিতেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে। আর নিশ্চিত থাকতেন শিক্ষকদের আন্তরিকতা এবং দায়িত্বশীলতার বিষয়ে। এর পর শুরু হলো করোনাকাল। মারাত্মক ক্ষতির শিকার হলো বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের অর্থনীতি।
ফলে স্বাভাবিকভাবেই অর্থ সংকটে পড়ে গেলেন অভিভাবকরা। এই সংকট অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেল, যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কেবল বেড়েই চলল। উপার্জন বাড়ে না, কেবল খবচ বাড়ে; এ এক মর্মান্তিক পরিস্থিতি। এই পরিস্থিতিতে নতুন মাত্রা যোগ করে চলল বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষাব্যয়। যা অনেক ক্ষেত্রেই অযৌক্তিক এবং স্বেচ্ছাচারিতার শামিল। অর্থাৎ তাদের ইচ্ছে হলো, তাই বেতন বাড়িয়ে দিল।
ইচ্ছে হলো, তাই অমুক খরচ, তমুক খরচ বাড়িয়ে দিল। আর অভিভাবকরা তা মেনে নিতে বাধ্য হলেন। যেহেতু সন্তানদের ভর্তি করিয়ে ফেলেছেন। এখন আর অন্য রাস্তা খোঁজার সুযোগও নেই। কিন্তু চাপ যখন সহ্যের বাইরে চলে যায়, তখন মানুষ কোনো না কোনো রাস্তা তৈরি করেই নেয়। করতে হয়। কারণ চাপে চাপে চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে কিছুদিন জীবনযাপন করা যায়। দীর্ঘদিন নয়। ইতোমধ্যে অভিভাবকরা সেই রাস্তা তৈরি করে ফেলেছেন।
যার বাহ্যিক রূপ আমরা দেখতে পেলাম সরকারি স্কুলে ভর্তির আবেদনের ক্ষেত্রে। জানা গেছে, সরকারি স্কুলে আসনের তুলনায় পাঁচগুণ বেশি আবেদন জমা পড়েছে। আর বেসরকারি স্কুলের আবেদনের চেয়ে তিনগুণ বেশি আসন রয়েছে। তাই বোঝাই যাচ্ছে, বেসরকারি স্কুল থেকে অভিভাবকরা কীভাবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন বা নিচ্ছেন।
তবে অনেক অভিভাবক মনে করেন, যদি বেসরকারি স্কুলের খরচের ওপর নজরদারি বাড়ানো যেত, যদি তা জবাবদিহিতার আওতায় আনা যেত, তা হলে এসব প্রতিষ্ঠান ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত তাদের নিতে হতো না। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চাইলেই সব বেসরকারি স্কুলকে একই নিয়ম বা জবাবদিহিতার আওতায় আনা সম্ভব হবে না।
কারণ কোনো কোনো স্কুল সত্যিই এমন এমন সুবিধা দিচ্ছে, যা পেতে হলে বাড়তি টাকা গুনতেই হবে। অর্থাৎ এই খরচের কথা জেনেই ওইসব স্কুলে সন্তানদের ভর্তি করানো হয়। তা হলে পরবর্তী সময়ে অভিভাবকরা যদি কুলিয়ে উঠতে না পারেন, তা হলে এর জন্য সেই স্কুলগুলোকে দোষারোপ করা যাবে না। তবে হ্যাঁ, যেসব স্কুল সামান্য সুবিধা দিয়ে অসামান্য ফি আদায় করার অপচেষ্টা চালায়, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ প্রতিষ্ঠান বেসরকারি হলেও একে জবাবদিহিতার আওতায় আনার শতভাগ ক্ষমতা সরকারের রয়েছে।
আর জনসাধারণের বৃহত্তর স্বার্থে সেটা অবশ্যই করা উচিত। নইলে অন্যায়ভাবে ফি বাড়ানো এবং চাপানোর যে অসাধু প্রক্রিয়া, সেটি চলতেই থাকবে। দেখা যাবে ওইসব প্রতিষ্ঠানে কেবল কোটিপতির ছেলেমেয়েরাই পড়তে পারবে। যদি তাদের মেধা নাও থাকে, তবু। টাকার জোর আছে- এটাই হয়ে যাবে যোগ্যতার মাপকাঠি। যা এক সময় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে গোটা শিক্ষাব্যবস্থার জন্য।
আবার ফিরে যাওয়া যাক সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রসঙ্গে। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ ছিল অর্থাৎ যেসব কারণে অভিভাবকরা এসব প্রতিষ্ঠানে সন্তানদের ভর্তি না করিয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করাতেন, সেসব অভিযোগ খতিয়ে দেখার কি কোনো সুযোগ নেই? অবশ্যই শতভাগ সুযোগ আছে। যেহেতু প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি।
তাই সরকার যদি আন্তরিকভাবে নজরদারি বাড়ায়, তা হলে পড়াশোনার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনা সম্ভব। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে আজকাল সামর্থ্যবানদের সন্তানরা যায় না বললেই চলে। অথচ সরকারের ভাণ্ডার থেকে বেতন-ভাতা ঠিকই যাচ্ছে শিক্ষকদের হাতে। তা হলে কেন তারা মন দিয়ে পড়াবেন না? কেন এত এত অভিযোগ থাকবে তাদের বিরুদ্ধে?
দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে। আর এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কোনটা মানসম্পন্ন, কোনটা মানহীন, সেই হিসাব পরে। সংখ্যায় বেড়েছে, এটাই আসল কথা।
অথচ সরকারি প্রতিষ্ঠান সেভাবে বাড়েনি। কিন্তু দেশের উন্নয়ন কাজ তো থেমে নেই। তা হলে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যে হারে বেড়েছে, সেই হারে সরকারি প্রতিষ্ঠান কেন বাড়েনি? উন্নয়নের ছোঁয়া কি এই খাতে লাগা উচিত ছিল না?
যেখানে আমরা জানি এবং মানি- শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড! আন্তরিকতা থাকলে অনেক সমস্যাই মুহূর্তে সমাধান করে ফেলা সম্ভব। আমরা বিশ্বাস করি, খরচের চাপে দিশাহারা অভিভাবকরা সরকারি স্কুলমুখী হলেও তাদের সন্তানরা বঞ্চিত হবে না। অর্থাৎ সরকারি স্কুলেও বেসরকারি স্কুলের মতোই পড়াশোনার ভালো পরিবেশ পাবে।
আর বেসরকারি স্কুলগুলোও মানবিক হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা যদি লোকঠকানো সেই অসাধু ব্যবসায়ীদের মতো অভিভাবকদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করেই যান, তা হলে দুই শ্রেণিতে পার্থক্য থাকল কোথায়?
আর যে নিত্যপণ্যের অতিরিক্ত দামের জন্য অভিভাবকরা দিশাহারা, সেটা নিয়ে কথা না-ই বললাম। কারণ আমরা ধরেই নিয়েছি, জিনিসপত্রের দাম বাড়বেই। চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া, মুখ বুজে মেনে নেওয়া ছাড়া আমাদের আর কিচ্ছু করার নেই। তাই চলুন মেনে নিতে শিখি। আর দেখি, যাদের কিছু করার ক্ষমতা আছে, তারা ঠিক কতদিন নীরব দর্শক হয়ে থাকতে পারেন।
লেখক-
ইকবাল খন্দকার : কথাসাহিত্যিক ও টিভি উপস্থাপক