মাধ্যমিক স্কুলেও ১.১৫ কোটি টাকার লিফট
|
|
|
|
শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ বিধি লঙ্ঘন করে সমীক্ষা ছাড়াই তিন হাজার কোটি টাকার শিক্ষা প্রকল্প অনুমোদন দেয়ায় সেই প্রকল্প আর শেষ হচ্ছে না। প্রকল্পে স্কুলের জন্য প্রতিটি এক কোটি ১৫ লাখ টাকা দরে ৩৪২টি লিফট কেনা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কৃচ্ছ্র সাধনের জন্য বিদেশ সফর বন্ধ থাকলেও এই প্রকল্পে মাথাপিছু সাড়ে ১৩ লাখ টাকা খরচ ধরে ৫০ জন বিদেশ যাবেন। আর কাজ শেষ না হওয়ায় দফায় দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয় প্রকল্পের। সাড়ে ৪ বছরের প্রকল্প ৬ বছর পরে এসে ব্যয় প্রায় ৩৮ শতাংশ বা এক হাজার ২৪২ কোটি টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চলমান প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রতি বছর বিজ্ঞান বিভাগে এক লাখ ২৬ হাজার শিক্ষার্থী (৯ ও ১০ শ্রেণী)-সহ অতিরিক্ত ৪ লাখ ৭০ হাজার ৫৬৭ জন শিক্ষার্থীর আবাসন সুযোগ দরকার। বিদ্যমান বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহের শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সমতাভিত্তিক গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং জীবনব্যাপী শিক্ষালাভের সুযোগ সৃষ্টি করার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সম্পূর্ণ জিওবি অর্থায়নে ৩২৮৪,০০ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে জানুয়ারি ২০১৭ হতে জুন ২০২১ মেয়াদে বাস্তবায়নের নিমিত্ত ‘সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহের উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১৭ সালের ২১ মার্চ একনেক কর্তৃক অনুমোদিত হয়। প্রকল্পটির আওতায় সারা দেশে ৩২৩টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নতুন একাডেমিক ভবন নির্মাণ করা হবে যেখানে শিখন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে ইন্টারনেট সুবিধাসহ মাল্টিমিডিয়া শিক্ষা উপকরণ নিশ্চিত করা হবে। ইন্টারনেট সংযোগসহ আইসিটি ল্যাব সংযোজিত হবে। প্রতিটি ফ্লোরে শিক্ষার্থীদের জন্য পৃথক স্যানিটেশন ব্যবস্থা এবং নিয়মিত হাত ধোয়ার সুবিধা নিশ্চিত করা হবে।
প্রকল্পের মাধ্যমে কাজগুলো হচ্ছে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে আঞ্চলিক বৈষম্য ও ক্রমবর্ধমান শিক্ষার্থীর চাহিদা নিরসন, সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে উন্নত ভৌত সুবিধা এবং শিক্ষা উপকরণ (একাডেমিক ভবন, হোস্টেল, ভূমি উন্নয়ন, কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, স্মার্ট ক্লাসরুম, বিজ্ঞান যন্ত্রপাতি, ফটোকপিয়ার, আসবাবপত্র বই ও রেফারেন্স সামগ্রী, খেলাধুলার সামগ্রী ইত্যাদি) সরবরাহ করা।
তথ্য পর্যালোচনা থেকে জানা গেছে, প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ না হওয়ায় জুলাই ২০২১ হতে জুন ২০২২ পর্যন্ত ১ম দফায় এক বছর মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। পরবর্তীতে আবার এক বছর মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। তাতেও প্রকল্পের কাজে অগ্রগতি নেই। ৬ বছরে কাজ হয়েছে মাত্র ৩০ শতাংশ। অর্থ ব্যয় হয়েছে মাত্র ৬০০ কোটি টাকা বা ১৮.৩৬ শতাংশ। গত ২০২২ সালের ২১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটির (পিএসসি) ৪র্থ সভার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ৩২০টি নতুন একাডেমিক ভবন নির্মাণের ডিজাইন পরিবর্তন, কতিপয় অনুমোদিত অঙ্গের পরিমাণ বৃদ্ধিসহ রেট শিডিউল-২০১৮ অনুসরণের ফলে প্রস্তাবিত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ভৌত কাজের ব্যয় বৃদ্ধি করে ৫৫২২.০০ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় (৬৮.১৫% বৃদ্ধি)-সহ জানুয়ারি ২০১৭ হতে জুন ২০২৫ মেয়াদে বাস্তবায়নের ১ম সংশোধনী প্রস্তাব প্রেরণ করা হয়।
প্রকল্পের মূল কার্যক্রম হচ্ছে বিদ্যালয়গুলোর জন্য ২ লাখ ৪৫ হাজার ৮৩৪টি আসবাবপত্র কেনা, ৩৪২টি লিফট স্থাপন, বিদ্যালয়গুলোর জন্য ৯০ হাজার ৮৭৪টি কম্পিউটার ও অন্যান্য সরঞ্জাম কেনা, বিদ্যমান একাডেমিক ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ, ৫০০ সিটের হোস্টেল নির্মাণ, শিক্ষক কোয়ার্টার নির্মাণ, বৈদেশিক প্রশিক্ষণ, সীমানা প্রাচীর ও গেট নির্মাণ, আরসিসি রাস্তা নির্মাণ করা।
প্রকল্পের খরচ পর্যালোচনায় দেখা যায়, সরকারি অর্থায়নে এই প্রকল্পের ভবন নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পে ৫০ জনকে বিদেশ সফরের জন্য পাঠানো হবে। যাতে খরচ ধরা হয়েছে পৌনে সাত কোটি টাকা। এখানে জনপ্রতি খরচ পড়বে ১৩ লাখ ৫০ হাজার। আর মাধ্যমিক এই স্কুলের জন্য কেনা হবে ৩৪২টি লিফট। যার জন্য খরচ হবে ৩৯২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। প্রতিটি লিফটের দাম পড়বে এক কোটি ১৫ লাখ টাকা। এই খরচগুলো নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের প্রশ্ন রয়েছে। প্রকল্পের পরিচালন ব্যয় ৪ কোটি ৪১ লাখ টাকা ধরা হয়। এখন তা বাড়িয়ে ১১ কোটি ৬৮ লাখ ২২ হাজার করা হয়েছে। অর্থাৎ বছরে এক কোটি টাকার অনেক বেশি হবে পরিচালন ব্যয়।
প্রকল্প সংশোধনের কারণ সম্পর্কে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, নতুন একাডেমিক ভবন নির্মাণে ডিজাইন পরিবর্তন ও ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ, প্রকল্পের আওতায় সারা দেশে ৬ তলা ভিতে ৬ তলা ৩২০টি নতুন একাডেমিক ভবন নির্মাণ করা হবে। বাস্তব চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে জেলা ও বিভাগীয় শহরের প্রস্তাবিত ১৬২টি নতুন একাডেমিক ভবন ৬ তলা ভিতে ৬ তলার পরিবর্তে ১০ তলা ভিতে ১০ তলা নির্মাণ যৌক্তিক হবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ডিপিপি সংশোধন করা হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় বেশি লাগাতে রেট শিডিউল পরিবর্তনে মূল ডিপিপিতে ভৌত কাজের ব্যয় প্রাক্কলন পিডব্লিউডি রেট শিডিউল-২০১৪ সালের ছিল। পরে পিডব্লিউডি রেট শিডিউল ২০১৮ অনুযায়ী করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে পিডব্লিউডি রেট শিডিউল ২০২২ কার্যকর হওয়ায় ভৌত কাজের সংশোধিত ব্যয় প্রাক্কলন চলমান রেট শিডিউল অনুসরণে করা হয়। ফলে প্রস্তাবিত নতুন ব্যয় প্রাক্কলন অনুমোদন গ্রহণে ডিপিপি সংশোধন প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া আসবাবপত্র, অফিস যন্ত্রপাতি ও কম্পিউটার সামগ্রী সংগ্রহের পরিমাণ/সংখ্যা ও ব্যয় বৃদ্ধি, নতুন একাডেমিক ভবন নির্মাণ অঙ্গের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং নতুন একাডেমিক ভবন নির্মাণে ডিজাইন পরিবর্তন, আসবাবপত্র, অফিস সরঞ্জামাদি ও কম্পিউটার সামগ্রীর পরিমাণ/সংখ্যা ও ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় ডিপিপি সংশোধন প্রয়োজন।
পরিকল্পনা কমিশন বলছে, পিইসি সভায় কতিপয় সিদ্ধান্তের পাশাপাশি প্রকল্পের আওতায় প্রস্তাবিত বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে ৬ তলার পরিবর্তে ১০ তলাভবন নির্মাণের চাহিদা ও যৌক্তিকতা নিরূপণ করে তার ব্যাখ্যা পুনর্গঠিত ডিপিপিতে উল্লেখসহ বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে অবস্থিত ১৬২টি বিদ্যালয়ের মধ্য থেকে ২০টি বিদ্যালয়ের ১০ তলা একাডেমিক ভবন নির্মাণ, কর্মচারীদের বেতন ও অফিস যন্ত্রপাতি অঙ্গ দুটি আরডিপিপি থেকে বাদ দেয়া, কতিপয় অঙ্গের ব্যয় কমানোর জন্য বলা হয়। বাস্তবায়নকাল আরও ৩ বছর ৬ মাস বৃদ্ধিসহ নতুন এবং যে সব অংগের কার্যাদেশ এখনো দেয়া হয়নি সে সব নির্মাণ ও পূর্তকাজ পিডব্লিউডির রেট শিডিউল ২০২২ অনুযায়ী সম্পন্ন করতে হবে এবং পুনর্গঠিত ডিপিপি প্রাপ্তি সাপেক্ষে পুনরায় পিইসি সভা আহ্বানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সে পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পটির নির্মাণ ও পূর্তকাজের ব্যয় প্রাক্কলন রেট শিডিউল ২০২২ অনুযায়ী নির্ধারণ করে ডিপিপি পুনর্গঠন করা হয়েছে। বর্তমানে প্রকল্পটির ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা, যা মূল অনুমোদিত ব্যয় অপেক্ষা ১ এক হাজার ২৪২ কোটি (৩৭.৮২ শতাংশ) টাকা বেশি। মার্চের শেষে আবার মূল্যায়ন কমিটির সভায় প্রকল্পটি পর্যালোচনা করা হবে।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৮/০৩/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়