রাঙামাটিঃ রাঙামাটি জেলা শহরের প্রাণকেন্দ্র বনরূপার পাশেই ‘বনরূপা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’। সেখানকার তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী শিষ্ঠা চাকমা। প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত তাকে মাতৃভাষার পাঠ্যবই দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নিজের ভাষা চাকমা বর্ণমালা এখনো আয়ত্তে আসেনি তার। নির্ভুলভাবে লিখতেও পারে না। এমনকি অন্যান্য বইয়ের মতো পড়তেও পারে না। তার ক্লাসের অর্ণি চাকমা ও পুর্ণশ্রী চাকমার একই অবস্থা। পড়তে না পারার কারণ হিসেবে তারা বলে, ‘দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি। স্যাররা ক্লাসে নিয়মিত পড়ান না। সহপাঠীরাও পারে না। বাবা-মাও পারেন না। তাই বাসায়ও পড়া যায় না। এ জন্য ভুলে গেছি। এবার এখনো পড়া শুরু হয়নি।’ মাতৃভাষা শিক্ষায় এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অবস্থা বলে দিচ্ছে জেলার সার্বিক চিত্র কেমন।
রাঙামাটি জেলায় বাঙালি জনগোষ্ঠী ছাড়াও ১৩টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস। তাদের মধ্যে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীই প্রধান। এই তিন বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ৩০ হাজার ৫৩৪ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৬৯ হাজার ২২১টি মাতৃভাষার বই বিতরণ করা হয়েছে। দেওয়া হয়েছে শিক্ষক সহায়িকা ও শিখন চর্চা খাতাও। তবে মাতৃভাষায় দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাবে এগোচ্ছে না ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় পাঠদান। শিক্ষার্থীরাও এসব পাঠ্যবইয়ের পাঠ নিতে পারছে না। সরকারের এই মহতী উদ্যোগ থেকে আসছে না কাঙ্ক্ষিত সাফল্য। এ জন্য নিজ নিজ মাতৃভাষার শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার পুরোনো দাবিই আলোচিত হচ্ছে বারবার। এদিকে সংকট সমাধানে খুব শিগগিরই মাতৃভাষায় পাঠদানের জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের সময় বাড়ানোর প্রস্তাবের কথা জানিয়েছেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা।
পাহাড়ে চৌদ্দটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস। তাদের মধ্যে কোনো কোনো জনগোষ্ঠীর নিজস্ব বর্ণমালা থাকলেও লিখন ও পঠন চর্চার অভাবে তা দীর্ঘকাল থেকে গেছে অন্তরালে। বর্তমান প্রজন্মও বেড়ে উঠেছে নিজের বর্ণমালার সঙ্গে পরিচিত হওয়া ছাড়াই। এতে কয়েকটি জাতিগোষ্ঠী নিজস্ব ভাষা ও বর্ণমালাও হারাতে বসেছে।
২০১৭ সালে শুরু হয় ‘মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম। এতে পাহাড়ের তিন জনগোষ্ঠী চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা শিশুদের নিজের ভাষায় পড়ালেখার সুযোগ তৈরি হয়। প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত নিজস্ব মাতৃভাষার বই চালু করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়ের তথ্য বলছে, রাঙামাটি জেলার ১০ উপজেলায় চলতি শিক্ষাবর্ষে ৯০৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বই বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিকে ১৫ হাজার ২৭০টি, প্রথম শ্রেণিতে ২২ হাজার ৮৩০টি, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ২৩ হাজার ৭৪৮টি ও তৃতীয় শ্রেণিতে ৭ হাজার ৩৭৩টি বই বিতরণ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে প্রাক-প্রাথমিকে চাকমা ৫ হাজার ৯২৫ জন, মারমা ১ হাজার ৩৫৫ জন, ত্রিপুরা ৩৫৫ জন। প্রথম শ্রেণিতে চাকমা ৫ হাজার ৭৮১ জন, মারমা ১ হাজার ৪২৬ জন, ত্রিপুরা ৪০৩ জন। আর দ্বিতীয় শ্রেণিতে চাকমা ৬ হাজার ১৩৪ জন, মারমা ১ হাজার ৩৯৫ জন, ত্রিপুরা ৩৮৭ জন এবং তৃতীয় শ্রেণিতে চাকমা ৫ হাজার ৮৬৫ জন, মারমা ১ হাজার ২৪৯ জন এবং ত্রিপুরা শিক্ষার্থী রয়েছে ২৫৯ জন।
তবে আট বছর ধরে মাতৃভাষার এসব বই পেলেও সাফল্য হিসেবে তা খুবই সামান্য। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বলছেন, এসব ভাষার দক্ষ শিক্ষক না থাকায় শিশুদের পঠন ও লিখনের ক্ষেত্রে এসব বই কোনো কাজে আসছে না। কিছু শিক্ষককে ভাষাভিত্তিক প্রশিক্ষণ দিয়ে চালু করা হলেও কার্যক্রমটি এখন অনেকটাই থমকে আছে।
বনরূপা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী মৈত্রেয় চাকমার মা লিনা চাকমা বলেন, ‘চাকমা ভাষার বর্ণমালায় লেখা ও পড়া আমরাও পারি না। যার কারণে বাসায়ও চর্চার সুযোগ নেই। স্কুলে যা শিখেছে সেগুলোও চর্চার অভাবে বাচ্চারা ভুলে যায়। এ জন্য আরও প্রশিক্ষিত শিক্ষক বাড়ানো দরকার। নইলে এটা খুব বেশি দূর এগোবে না।’
জানতে চাইলে এই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ধনবীর চাকমা বলেন, ‘আমাদের ৫৩৯ শিক্ষার্থীর বিপরীতে ১৮ জন শিক্ষক আছেন। এর মধ্যে সাতজনই মাতৃভাষার পাঠদানে প্রশিক্ষিত। কিন্তু সাধারণ শিক্ষায় অভ্যস্ত শিক্ষকদের মাত্র সাত দিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে কোনোভাবেই এটা আয়ত্ত করা সম্ভব না। ন্যূনতম একমাস নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার।’
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হৃষীকেশ শীল বলেন, ‘সাত দিনের প্রশিক্ষণে ভাষা রপ্ত করা সম্ভব নয়। পাহাড়ি শিক্ষকরা মুখে নিজেদের মাতৃভাষায় কথা বললেও লিখিতরূপে কোনো আইডিয়া নেই। এমনকি বর্ণমালাগুলোও চিনেন না কেউ কেউ। প্রশিক্ষণ ৩০ দিন করা একটি যৌক্তিক দাবি। তবে এটি করতে হলে বেশি অর্থের দরকার। আমরা ইতোমধ্যেই মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। সরকার চাইলে জেলা পরিষদের মাধ্যমে এটি বাস্তবায়ন করতে পারে। আশা করছি, শিগগির সরকার পদক্ষেপ নেবে।’
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/২১/০২/২০২৫
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.