এইমাত্র পাওয়া

উচ্চশিক্ষায় সমাজবিজ্ঞান: পরিবর্তনের পথে অনন্য যাত্রা

ফারহানা ইয়াসমিন।। সমাজবিজ্ঞান এমন একটি বিজ্ঞান যা মানুষ, তাদের সম্পর্ক, সামাজিক কাঠামো এবং সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করে। সমাজবিজ্ঞানের গুরুত্ব ও এর প্রাসঙ্গিকতা বর্তমানে বেশ উচ্চপর্যায়ে অবস্থান করছে। কেননা, সমাজবিজ্ঞানের অধ্যয়ন শুধু ব্যক্তি উন্নয়নের জন্য নয়, সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। সমাজবিজ্ঞান আমাদের চারপাশের সমাজ ও মানুষের কার্যকলাপ বুঝতে সাহায্য করে। এটি সামাজিক সমস্যা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো বিষয় নিয়ে কাজ করে।

সমাজবিজ্ঞানীর কাজ হলো সমাজের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা এবং সেগুলোর কার্যকর সমাধান প্রদান করা। চিন্তাশীল দার্শনিক এমিল ডুর্খেইম বলেছেন, ‘সমাজ হলো একটি জীবন্ত সংগঠন, যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সমাজবিজ্ঞান এই সংগঠনের অন্তর্নিহিত কারণগুলো বিশ্লেষণ করে। উচ্চশিক্ষায় আপনার-আমার সন্তান কেন সমাজবিজ্ঞান পড়বে? এই প্রশ্নের উত্তর অসংখ্য।

১. সমাজ সম্পর্কে গভীর বোঝাপড়া তৈরি হয়। সমাজবিজ্ঞান মানুষকে চারপাশের সমাজ ও তার বিভিন্ন উপাদান বুঝতে শেখায়। এটি মানুষের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও আচরণগত দিক বিশ্লেষণ করার সুযোগ দেয়।

২. সামাজিক সমস্যা সমাধানের পথ দেখায়। সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ সমাজের সমস্যা – যেমন, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, লিঙ্গবৈষম্য ও শিক্ষাবৈষম্যসহ জটিল সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৩. কর্মক্ষেত্রে বহুমুখী সুযোগে সমাজবিজ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিভিন্ন পেশাগত ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। সমাজকর্ম, শিক্ষা, জনসংযোগ, গবেষণা ও সরকারি নীতিনির্ধারণী পদে সমাজবিজ্ঞানের ছাত্ররা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।

৪. মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে, অর্থাৎ সমাজবিজ্ঞান মানুষকে মানবিক হতে শেখায়। এটি মানুষকে অন্যের দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করতে, সহানুভূতিশীল হতে ও সমাজে ভারসাম্য আনতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

৫. এছাড়াও নেতৃত্বের দক্ষতা বৃদ্ধি করে। সমাজবিজ্ঞান মানুষকে সমস্যা চিহ্নিত করা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা বাড়ায়।

সমাজবিজ্ঞান কেবল তাত্ত্বিক জ্ঞান নয়; এর ব্যাবহারিক প্রয়োগও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—যেমন, ১. গবেষণা : সমাজবিজ্ঞানের সঙ্গে গবেষণা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারণ জনমত জরিপ, জনসংখ্যা বিশ্লেষণ ও সামাজিক পরিবর্তনের কারণ চিহ্নিত করার জন্য গবেষণার বিকল্প নেই। ২. সামাজিক নীতি প্রণয়ন : গবেষণা থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান নিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও দারিদ্র্য বিমোচনে কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন। ৩. মানবাধিকার রক্ষা : সমাজবিজ্ঞান মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণ চিহ্নিত করে এবং তা প্রতিরোধে সহায়তা করে।

সমাজবিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করেছেন অনেক গুণী মনীষী। কার্ল মার্কস বলেছেন, ‘সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামোই তার সামাজিক রূপ নির্ধারণ করে।’ তার এই বক্তব্য আমাদের অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণ খুঁজে বের করতে সাহায্য করে। মননশীল সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার বলেন, ‘মানুষের সামাজিক আচরণ ও তাৎপর্য বোঝার জন্য সমাজবিজ্ঞান অপরিহার্য।’

বলা বাহুল্য, বর্তমান বিশ্ব দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও বিশ্বায়নের প্রভাবে সমাজে নতুন নতুন সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দক্ষতা অর্জন করতে সমাজবিজ্ঞান অপরিহার্য। সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ কেবল নিজেকে উন্নত করতে পারে না, বরং একটি উন্নত ও সচেতন সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে।

সমাজবিজ্ঞান একটি শক্তিশালী মাধ্যম, যা সমাজ ও মানুষের সম্পর্ককে গভীরভাবে অনুধাবন করতে সাহায্য করে। এটি শিক্ষার্থীকে জ্ঞানী, দায়িত্বশীল ও মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। বর্তমান বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সমাজবিজ্ঞান পড়া অত্যন্ত জরুরি। সুতরাং, যারা সমাজ, সংস্কৃতি ও মানুষের উন্নয়ন নিয়ে কাজ করতে চান, তাদের জন্য সমাজবিজ্ঞান একটি আদর্শ বিষয়। সমাজবিজ্ঞানের জনক অগাস্ট কোৎ বলেছেন, ‘সমাজবিজ্ঞান শুধু জ্ঞান নয়, এটি মানবজাতির উন্নতির পথে একটি হাতিয়ার। তাই, সমাজবিজ্ঞান অধ্যয়ন করুন এবং একটি উন্নত সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখুন ।

লেখক: প্রভাষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

শিক্ষাবার্তা /এ/২৫/০১/২০২৫


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.