শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ বছরের শুরুতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস শুরু হলেও এখন বেশির ভাগ শিক্ষার্থী হাতে পাঠ্য বই পায়নি। বইয়ের পিডিএফ থেকে প্রিন্ট করে পাঠ নিচ্ছেন শিক্ষকরা। শিক্ষার্থীদের হাতে বই না পৌঁছালেও বাজার সয়লাভ গাইড বইয়ে। গতকাল সরজমিন রাজধানীর নীলক্ষেত ও মিরপুর-১০ নম্বর বই বাজারে ঘুরে দেখা যায়, দোকানে দোকানে গাইড বই বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, পাঠ্য বই শিক্ষার্থীদের হাতে না পৌঁছায় গাইড-বই বিক্রি বেশি হচ্ছে। অনেকেই আসছেন পাঠ্য বই কেনার উদ্দেশ্যে। না পেয়ে গাইড বই কিনছেন। আবার অনেকে পুরনো বইও কিনছেন। নীলক্ষেত্রে পাঠ্যবই কিনতে আসা আরিফুর রহমান বলেন, তার মেয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী। বই এখনো মেলেনি। এদিকে স্কুলে ক্লাস ও প্রাইভেট শুরু হয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে গাইড বই কেনেন।
মিরপুর-১০ নম্বরেও একই চিত্র দেখা যায়। সেখানেও বিক্রি হচ্ছে গাইড বই। এনসিটিবি’র অনলাইনে প্রকাশ করা পাঠ্য বই ফটোকপি করে অধ্যায়ভিত্তিক বিক্রি হচ্ছে। বিশেষ করে শুরুর দিকে অধ্যায়গুলো বেশি বিক্রি হচ্ছে। আবার বাজারের একের ভেতর সব নামে বেশ কিছু গাইড-বই পাওয়া যাচ্ছে। সপ্তম শ্রেণির একের ভেতর সব গাইড বইয়ের দাম রাখা হচ্ছে ৭৩০ থেকে ৭৫০ টাকা। এগুলো আলাদা আলাদাভাবে কিনলে লাগছে এক হাজার থেকে ১২শ’ টাকা। সবুজ মিয়া নামে এক ব্যবসায়ী জানান, গাইড বই ঠেকাতে মোবাইল কোর্ট বসানোর ঘোষণা দেয়ার পর থেকেই বইগুলো লুকিয়ে রাখেন তারা।
সরকারের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নোট-গাইড বই ছাপা বন্ধে আরও কঠোর হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। নিষিদ্ধ এসব বই ছাপা বন্ধ করতে এবার ডিসিদের ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়। সমপ্রতি ঢাকা জেলা প্রশাসককে পাঠানো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়েছে, ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির নতুন পাঠ্য বই ছাপা পুরো জানুয়ারি জুড়ে চলবে। এই সময়ে ৪০ কোটি পাঠ্য বই ছাপার কাজে নিযুক্ত প্রেসসমূহে যেন নোট ও গাইড বই, ডায়েরি, ক্যালেন্ডার ইত্যাদি ছাপতে না পারে তা নিশ্চিত করতে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য বলা হলো। চিঠিতে ঢাকা জেলা প্রশাসককে ১১৬টি প্রেসের ঠিকানাও দেয়া হয়েছে। আরও কয়েকজন জেলা প্রশাসককে একই চিঠি পাঠানো হয়েছে।
এর আগে গত ৩রা ডিসেম্বর প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম ও সমমান শ্রেণির বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপা হয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানোর আগে সব ধরনের সহায়ক বই বা নোট-গাইড ছাপা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় এনসিটিবি।
এরপরও কীভাবে বাজারে আসছে এসব বই। একজন প্রকাশক বলেন, বাজারে সবাইতো বিনামূল্যে পাঠ্য বই ছাপানোর কাজ করেন না। এসব বই যারা ছাপানোর কাজ করেন তারা আর্থিকভাবে লাভবান হন। কিন্তু বছরের শুরুতে অন্যান্য প্রেসের লোকদেরও একটা আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার সময়। এনসিটিবি যেহেতু অনলাইনে প্রকাশ করেছে বই। আবার অনেকেই আগেই পেয়েছেন পাণ্ডুলিপি। তারা এসব প্রেসের মাধ্যমে এসব বই ছাপাচ্ছেন।
শিক্ষার্থীদের জন্য চলতি বছরে প্রয়োজন প্রায় ৪০ কোটি পাঠ্য বই। এরমধ্যে ইতিমধ্যে ছাপানো হয়েছে প্রায় ১১ কোটি বই। বাকি পাঠ্য বই ফেব্রুয়ারির মধ্যে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে সরকার। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে (এনসিটিবি) গণঅভ্যুত্থানের পর ঢেলে সাজানো হয়েছে। পাঠ্যবই পরিমার্জনের পর পাঠ্য বই ছাপানোর ক্ষেত্রে অল্প সময় পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের ৪০ কোটি বইয়ের মধ্যে ৬ই জানুয়ারি পর্যন্ত ১১ কোটি ১ লাখ ৪৪ হাজার ৭১৩টি পাঠ্যবই ছাপা হয়েছে। বিতরণ প্রক্রিয়া চলমান আছে। আগে বেশির ভাগ বই ভারতে ছাপানো হলেও এবার সব বই বাংলাদেশে ছাপা হচ্ছে। এজন্য দেরি হচ্ছে। এতে সরকার আন্তরিকভাবে দুঃখিত। তবে এর ইতিবাচক দিক হচ্ছে- পাঠ্য বইয়ের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকরা উপকৃত হচ্ছেন।
তিনি বলেন, বিগত সরকারের সময়ে তৈরি হওয়া অসাধু চক্র এবার বই ছাপাতে অসহযোগিতা করায় কাজে বিঘ্ন ঘটেছে। সরকার আশা করে চলতি মাসেই সব বই ছাপা সম্ভব হবে।
এদিকে চলতি শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীরা কবে নাগাদ সব নতুন পাঠ্যবই পাবে তা জানেন না বলে জানিয়েছেন শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। গত ৭ই জানুয়ারি তিনি বলেন, আমরা বই ছাপা কার্যক্রম শুরু করেছি দেরিতে। আমাদের বই পরিমার্জন করতে হয়েছে। বইয়ের সিলেবাস, কারিকুলাম নতুন করে করতে হয়েছে। বইয়ের সংখ্যাও অনেক বেড়েছে। বিদেশে কোনো বই ছাপানো হচ্ছে না। দেশের সক্ষমতা কত সেটি এবারই প্রথম দেখা যাচ্ছে। এতে করে তো দেরি হবেই।
ওদিকে পরিমার্জিত বইয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বিষয় নিয়ে লেখা পাঠে দেখা দিয়েছে অসন্তোষ। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে দেশের সবথেকে পুরাতন ও বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বলা হয়েছে একটি পাঠ্য বইয়ে। বিএনপি’র ক্ষেত্রে বলা হয়েছে দলটির জন্ম সামরিক শাসনামলে। জাতীয় পার্টির হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নামের পূর্বে যোগ করা হয়েছে সামরিক শাসক। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ক্ষেত্রে বলা হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দলটি পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার পক্ষে কাজ করেছে।
বিগত বছরের বইগুলোতে ছিল আওয়ামী লীগ নিয়ে বিষদ লেখনী। যাতে ছিল অতিরঞ্জিত আওয়ামী লীগ, শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ হাসিনার বন্দনা। এবারের পাঠ্য বইয়ে আগের তুলনায় ছোট হয়ে এসেছে ইতিহাস।
নবম-দশম শ্রেণির পৌরনীতি ও নগরিকতা বইয়ে আওয়ামী লীগকে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বলায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া রয়েছে। সেখানে আরও বলা হয়, ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন ঢাকায় আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৫৫ সালে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়া হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণ আওয়ামী লীগের মূলনীতি।
বিএনপি সম্পর্কে বলা হয়, সাবেক সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠিত হয়। এ দলটি ইসলামী মূল্যবোধ, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বিশ্বাসী। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ছাপা বইয়েও বিএনপি সম্পর্কে একই তথ্য ছিল। তবে পুরনো বইয়ে- বিভিন্ন দল ও আদর্শের নেতাকর্মীদের একত্রিত করে গঠিত। এই লাইনটি বাদ দেয়া হয়েছে।
এছাড়াও জাতীয় পার্টির ক্ষেত্রে তৃতীয় বৃহৎ দল বাদ দিয়ে প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদের নামের আগে সামরিক শাসক যোগ করা হয়েছে। বিগত পাঠ্যবইগুলোতে জামায়াত সম্পর্কে ছিল নানা নেতিবাচক কথা। এবার সেগুলো বাদ দেয়া হয়েছে। তবে পাঠ্য বইয়ে এবার দলটি সম্পর্কে বলা হয়েছে, জামায়াতে ইসলামী একটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশর স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দলটি পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার পক্ষে কাজ করেছে। এবার রাজনৈতিক দলের পরিচয় পর্ব থেকে বাদ দেয়া হয়েছে রাশেদ খান মেননের বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির নাম।
নবম-দশম শ্রেণির বাংলা ব্যাকরণ বইয়ে ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার করাকে কেন্দ্র করেও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি’- প্রতিবাদ জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন পর্যন্ত করেছে। তারা বলছেন, দাখিল ৯ম ও ১০ম শ্রেণির ‘বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি’ বইয়ের কভার পৃষ্ঠায় সংবিধানবিরোধী, বিতর্কিত ও রাষ্ট্রদ্রোহী পরিভাষা ‘আদিবাসী’ শব্দ অন্তর্ভুক্ত করায় জড়িতদের চিহ্নিত করে তাদের অপসারণ ও শাস্তি দিতে হবে। এই শব্দটি প্রত্যাহারের দাবিতে গতকাল এনসিটিবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ ও ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেন তারা।
এদিকে পাঠ্য বইয়ের বিষয়ে গত শনিবার বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, নবম-দশম শ্রেণির পৌরনীতি নতুন বইয়ে এনসিটিবি ভুল তথ্য তুলে ধরেছে। ফ্যাসিবাদের পতনের পরও পাঠ্য বইয়ে পতিত আওয়ামী লীগকে হিরো আর বিএনপিকে হেয়-প্রতিপন্ন করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির ষড়যন্ত্র চলছে। পতিত স্বৈরশাসকের অনুচররা হাসিনা পালানোর পর ভীষণ মনোকষ্ট নিয়ে দিনরাত্রি চক্রান্তে মেতে থাকছে। তারাই পাঠ্য বইয়ে সর্বাগ্রে আওয়ামী লীগের শ্রেষ্ঠত্ব, স্তুতি-বন্দনা আর বিএনপি সেনা ছাউনিতে জন্ম বলে হেয়-প্রতিপন্ন ও বিতর্কিত করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মগজ ধোলাইয়ের প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে।
এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. একেএম রিয়াজুল হাসান বলেন, আমরা পাঠ্যবই আবারও রিভিউ করে দেখবো। দ্রুত কাজ করায় ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে যেতে পারে। রিভিউর পর প্রয়োজনে সংশোধনী দেয়া হবে। সূত্র; মানবজমিন
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/১৩/০১/২০২৫
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.