এইমাত্র পাওয়া

শিক্ষকদের শুধু মহার্ঘ্য ভাতা নয়, পে স্কেল পাওয়া আইনগত অধিকার

ফিরোজ আলম: আহ! কেমন জীবন এটি।সগৌরবে বেঁচে থাকার জন্য কত আকুতি এদেশের শিক্ষকদের। অথচ সংবিধানের ২য় ভাগের (১৫ এর ক) আমাদের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দিয়েছে। রাষ্ট্র ও সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত ও অনুমোদিত সুযোগ বা সুবিধার সমষ্টিকে অধিকার বলে।আর যেসব অধিকার রাষ্ট্রের আইন কর্তৃক স্বীকৃত ও অনুমোদিত, সেগুলোকে আইনগত অধিকার বলে।সার্বজনীন মানবাধিকারের ২৫ নং অনুচ্ছেদ এবং সংবিধানের ২য় ভাগের (১৫ এর ক) অনুযায়ী একজন শিক্ষক ও মৌলিক অধিকার পাওয়ার কথা।সংবিধানের চতুর্থ পরিচ্ছেদের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগকে মৌলিক অধিকার বলবৎ করার এখতিয়ার দেওয়া আছে।নূন্যতম মাসিক বেতন ১২ হাজার পাঁচশত টাকা বেতনে কি খাচ্ছে একজন শিক্ষক,কেমন কাটছে তাদের জীবন সেটি দেখার কেউই নাই।সব সেক্টরে ব্যয় বাড়ার সাথে সাথে আয় বাড়ে।কিন্তু শিক্ষকদের ব্যয় বাড়লেও তুলনামূলক আয় বাড়তে দেয়না সরকার।এটি সংবিধান বিরোধী।কাগজে কলমে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৮৪ মার্কিন ডলার।অথচ খাবার কিনতে পারছেনা শিক্ষক।যে বেতন পায় মাসের পনের দিন যেতে না যেতেই দোকানীর বাকি খাতায় শিক্ষকের নাম থেকেই যায়।এ কেমন জীবন! দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শিক্ষকরা পিষ্ট। সাধারণ মানুষের মত শিক্ষকরা সংসারের ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। বেতন দিয়ে না চলায়, আগের জমানো অর্থ ভেঙে খরচ করছেন লক্ষ লক্ষ শিক্ষক।কিন্তু কত দিন এমন ভাবে চলবে।

দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় চাপ বিবেচনায় আয় বেড়েছে বড় স্কেলের (প্রধান শিক্ষকসহ ) ১০ ভাগ শিক্ষকের, আয় কমেছে ছোট স্কেলের(সাধারন শিক্ষক) ৮০ ভাগ শিক্ষকের। নিন্ম মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষের মত শিক্ষক সমাজ ও হতাশ ও কষ্টে ধুঁকছে।শিক্ষকদের মধ্যে বড় স্কেলে চাকুরী করা শিক্ষকগন কিছুটা ভাল আছেন।প্রতিষ্ঠান প্রধানগন তো আয় বেড়ে যাওয়াদের তালিকাতে শীর্ষে।মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের গনিত,ইংরেজী,রসায়ন,পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষকগন ও টিউশন পরিশ্রমের মাধ্যমে কিছুটা ভাল আছেন।যারা ভাল আছেন এমন শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশের কাছাকাছি।বাকী আশি ভাগ শিক্ষকই পরিবার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন।আরেকটু সহজ করে বললে শিক্ষকরা সীমাহীন কষ্টে জীবন যাপন করছেন।

এমতাবস্থায় বিশেষ ইনক্রিমেন্ট কিংবা মহার্ঘ্য ভাতা ও পে স্কেল চালুর বিকল্প নেই।বরং এটি এখন আইনগত অধিকার ও বটে। বিগত সরকারের প্রধান বলেছিলেন,ক্ষমতায় গেলে শিক্ষকদেরকে রাস্তায় নামতে হবেনা কিন্তু গত সতের বছর ক্ষমতায় থেকে ও শিক্ষকদের জন্য তেমন কিছুই করেননি।

যা কিছু করেছিলেন তা গতানুগতিক এবং বর্তমান সময়ে বেঁচে থাকার মত না। তাইতো গত ৫ ই অক্টোবর হারুন অর রশিদ- ফিরোজ আলম স্যারের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ মাদরাসা জেনারেল টিচার্স এসোসিয়েশান এবং অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়া স্যারের নেতৃত্বাধীন শিক্ষক কর্মচারী ঐক্যজোট শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা প্রদান, ১৬ বছর পূর্ণ হলে সব প্রভাষকের সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি, সরকারি চাকরিজীবীদের ন্যায় শিক্ষকদের মেডিক্যাল-বাড়ি ভাড়া, শিক্ষকদের বদলি প্রথা চালু, সহকারী শিক্ষকদের ৮ম গ্রেড, প্রশাসনিক পদে জেনারেল শিক্ষকদের নিয়োগ, ইএফটির মাধ্যমে বেতন প্রদান সহ নানা দাবীতে ঢাকায় সভা-সমাবেশ করেছে। ২০১৫ সালে সর্বশেষ জাতীয় বেতন কাঠামো ঘোষনা হয়েছিল যা এখন ও কার্যকর রয়েছে।অথচ এই সময়কালে জীবন যাত্রার ব্যায় প্রায় দ্বিগুনের বেশি হয়েছে।গত দুই বছরের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের পরিসংখ্যান করলে দেখা যায় যে দ্রব্যমূল্য, পরিবহন ব্যয়, বাসাভাড়া, শিক্ষার খরচ—সবই বেড়েছে হু-হু করে। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দাম আবারো বাড়ানোর প্রক্রিয়াও চলছে। বাসাভাড়া, সন্তানের স্কুলে যাওয়া-আসার রিকশাভাড়া, চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ সব পণ্যের দামই বাড়তি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়া-আসা করতেও বাসভাড়া বেশি দিতে হচ্ছে। কিন্তু একজন শিক্ষকের আয় দুই বছর আগে যা ছিল, এখনো প্রায় তা-ই আছে। সংসার চালাতে এখন প্রতি মাসেই ধারকর্জ করে চলতে হচ্ছেশিক্ষকদের।

সাধারণ মানুষের কথা নাই বা বললাম। মানুষের ব্যয়ের বড় খাত চারটি—খাদ্য ও গৃহ উপকরণ কেনা, বাসাভাড়া ও সেবার বিল, সন্তানদের পড়াশোনা এবং পরিবহন। দেশে এই চারটি খাতেই একসঙ্গে পণ্য ও সেবার মূল্য বেড়ে যাওয়ায় হিমশিম অবস্থা যাচ্ছে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএসের তথ্য পর্যালোচনা ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এর সাম্প্রতিক এক জরিপ থেকে জানা যায়, খাদ্য মূল্যস্ফীতি চলতি বছর রেকর্ড ১৫ শতাংশে পৌঁছেছে।গত দুই মাসে তা ১৮ শতাংশ।

অন্যদিকে, বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ-সিপিডির তথ্যমতে, দেশে গত পাঁচ বছরে শুধু ভোগ্যপণ্যের দাম ৩১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।

গত বছর ২৬শে জুন সংসদ অধিবেশন চলাকালে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য সাধারন মানুষের ক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন।

এখন দেশে ফ্যাসিজম নাই তারপরও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ঠেকানো যাচ্ছে না। ১৯৫৩ সালে প্রণীত মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও মজুদদারি-বিরোধী আইন ও ২০০৯ সালে প্রণীত হয় ভোগ্যপণ্য সংরক্ষণ আইন থাকার পরও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ঠেকানো যাচ্ছে না তা ভাবিয়ে তুলছে চরমভাবে।

২০২৪ সালে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এক গবেষণায় দেখিয়েছিল, একজন এমপিভুক্ত শিক্ষক গরীব শ্রেণিভুক্ত একজন মানুষ তাঁর ব্যয়ের ৩৮ শতাংশ খরচ করেন শুধু চাল কিনতে।

নিম্ন মধ্যবিত্তের ভরসা সবজিও এখন ‘বিলাসী পণ্য।একশত টাকার নিচে কোন সব্জিই কপালে জুটছে না।ডিমের বাজারে ও আগুন। একজন স্বল্প বেতনী শিক্ষক জীবন নির্বাহ কিভাবে করবেন তার উত্তর কে দিবে।

টিসিবি, বিআরইসি ও সরজমিনে বাজার পরিদর্শন সূত্র থেকে দেখা যায় ৭ জানুয়ারি ২০১৯ সালে সয়াবিন তেলের লিটার ছিল ১০৪ টাকা ,বর্তমানে তা ১৮০-২০০ টাকা, ৫লিটারের সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৪৬৫ থেকে ৫১০ টাকা,বর্তমানে তা৭৭০-৮০০ টাকা।চিনি দাম ছিল ৫৪ টাকা প্রতি কেজি, বর্তমানে তা ৭৭-৯০ টাকা,আটার দাম ছিল ২৮ টাকা, বর্তমানে ৩৫-৪০ টাকা প্রতি কেজি,মশুর ডাল প্রতি কেজি ছিল ৫৬ টাকা, বর্তমানে তা ১০০-১২০ টাকা,রান্নার গ্যাসের দাম ছিল ৮০০ টাকা ,বর্তমানে প্রায় ১৫৪০ টাকা,এভাবে গ্যাসের দাম প্রায় দ্বিগুন বেড়েছে,বিদ্যুৎ এর দাম ৬৬ শতাংশ বেড়েছে,পানির দাম প্রায় ২০ শতাংশ বেড়েছে,পরিবহন ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ।এভাবে সব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের দাম বেড়েছে।অথচ গত নয় বছরে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন কাঠামোতে তেমন বৃদ্ধি দেখা যায় নি।এমতাবস্থায় চরম দিশেহারা শিক্ষক সমাজ।এই সমস্যা সমাধানে এখনি বিশেষ ইনক্রিমেন্ট, ৩০ শতাংশ মহার্ঘ্য ভাতা এবং পে স্কেল চালু করা অতীব জরুরী এবং তা আইনগত অধিকারও বটে।এমনটি না হলে ফ্যাসিজম দূরকরনে আগামী নির্বাচনে এটির প্রভাব পড়বে সারাদেশের মানুষের মধ্যে।কারন এদেশের মানুষ এখনো শিক্ষকদের কে ভালবাসেন,বিশ্বাস করেন,তাদের কথা গুলো মূল্যায়ন করেন।

লেখকঃ মহাসচিব,বাংলাদেশ মাদরাসা জেনারেল টিচার্স এসোসিয়েশান কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি ও বিভাগীয় প্রধান(অনার্স,এম এ শাখা) আয়েশা( রা:) মহিলা কামিল(অনার্স,এম.এ) মাদ্রাসা, সদর ,লক্ষীপুর।

মতামত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে মতামত ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক ও আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের;- শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”

শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/১২/১০/২০২৪


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Leave a Reply