এইমাত্র পাওয়া

শিক্ষকের গায়ে শিক্ষা কর্মকর্তাদের হাত: জাতির জন্য অমোচনীয় কলঙ্ক!

রেজাউল ইসলাম: গত ১৭-ই সেপ্টেম্বর মাউশিতে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাগণ কর্তৃক সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনাটি দেশব্যাপী শিক্ষক লাঞ্ছনার মুকুটে আরো একটি পালক যোগ করেছে।৫-ই আগস্টের ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের পরে দেশের শিক্ষাখাতে সংস্কারের নামে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের ব্যানারে কিছু শিক্ষার্থী বুঝেই হোক বা না বুঝেই হোক সারাদেশে শিক্ষক লাঞ্ছনার মতো ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছিল। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষকদেরকে পদত্যাগে বাধ্য করার খবর আসছিল। কিন্তু সেই যাত্রায় শুধু দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষকরাই মব জাস্টিসের শিকার হননি, তাদের সাথে অনেক নিরীহ ও নিরাপরাধ শিক্ষকও হয়রানি, অপমান ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছিলেন। ব্যাপারটা তখন এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে, চাইলেই যে কেউ তখন শিক্ষকদেরকে অপমান ও হয়রানি করতে পারছিল। সেই ধারাবাহিকতায় এখন শিক্ষকদের উপর আরেক দফা হামলে পড়েছে দেশের উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাগণ। একবার ভেবে দেখুন, শিক্ষকদেরকে যারা বুকে আগলে রাখবেন, নিরাপত্তা দিবেন, তারাই শিক্ষকদের উপর শারীরিক আক্রমণ করছেন, তারাই শিক্ষকদের উপর উন্মত্ত জনতার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ছেন!

আসলে শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা অন্য আর দশটি শ্রেণি-পেশার মানুষকে লাঞ্ছনা করার মতোই একটি সংক্রামক ব্যাধি। এটি দেশের যেকোনো একটি প্রান্তে ঘটলেই অতি দ্রুত তা দেশের অন্য প্রান্তেও একটি সংক্রামক রোগের মতো ছড়িয়ে পড়ে, যতক্ষণ না সেটির জন্য অপরাধী দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায়। যেহেতু ক’দিন আগেই দেশের শত শত শিক্ষক এমন লাঞ্ছনা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং অপরাধীরা তার জন্য শাস্তি পায়নি, সেহেতু আজ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাগণও শিক্ষকদের গায়ে হাত তোলার সাহস পেয়েছেন। কিন্তু, তখন যদি রাষ্ট্র শিক্ষক লাঞ্ছনাকারীদেরকে দেশের প্রচলিত আইনের আওতায় আনতে পারত, তবে আজ জাতিকে এমন লজ্জাজনক দৃশ্য দেখতে হতো না।

এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, আজকে যেসকল উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মাউশিতে জড়ো হয়ে সরকারি মাধ্যমিকের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলেছেন, তারা গত কয়েক দিন ধরেই সম্পুর্ণ বিধিবহির্ভূতভাবে ‘জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা’ পদে শতভাগ পদায়নের দাবিতে মাউশিতে হট্টগোল ও অরাজকতা সৃষ্টি করে আসছেন। তারা একপ্রকার মাউশির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অবরুদ্ধ করে ও ভুল বুঝিয়ে সম্পূর্ণ বিধিবহির্ভূতভাবে এই পদগুলো তাদের করায়ত্তে আনার চেষ্টা করেছেন।

কিন্তু, দেশের মাধ্যমিক শিক্ষার বিধি অনুযায়ী, ‘জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা’ পদের ৮০ শতাংশ নিয়োগ পাবেন সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ আর বাকী ২০ শতাংশ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নিয়োগ পাবেন সরাসরি পরীক্ষার মাধ্যমে।এই বিধি মোতাবেক, ‘জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা’ হিসেবে দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাগণের পদোন্নতি পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিধিতে তাদের পদোন্নতির বিষয়ে কোনো প্রকার কোনো উল্লেখও নেই। বস্তুত, ‘উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা’ নামক এই পদটি একটি ব্লক পোস্ট। এখানে এই কর্মকর্তাদের উপরের দিকে পদোন্নতির আর কোনো সুযোগ নেই। এখন,গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পুলিশ-প্রশাসনের সাময়িক অসহযোগিতার কারণে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দিক থেকে কিছুটা দুর্বল থাকায় সুযোগসন্ধানী এই উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাগণ ঘোলা জলে মাছ শিকার করতে চেয়েছিলেন। তারা প্রশাসনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মাউশির কর্মকর্তাদের উপর চাপ প্রয়োগ করে ‘জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা’ নামক পদগুলো নিজেদের নামে বাগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন যা অত্যন্ত দৃষ্টিকটু এবং বেআইনি।

এখানে আরো একটা বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, আজকে যারা দেশের উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োজিত আছেন, তাদের বেশিরভাগই একসময় মাধ্যমিকে প্রকল্প কর্মকর্তা হিসেবে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পেয়েছিলেন। নিয়োগ বিধিতে উল্লেখ ছিল যে, প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলে এসকল কর্মকর্তার চাকরির মেয়াদও শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু, ১৯৯৬ সালে নিয়োগ পাওয়া এসকল কর্মকর্তার প্রকল্পের মেয়াদ অনেক আগে শেষ হয়ে গেলেও তারা প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরকে মোটা অংকের উৎকোচ দিয়ে তাদের চাকরিকে স্থায়ী করে রাজস্ব খাতে ঢুকিয়ে নিয়েছেন। এটি আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ এবং একটি উন্নত ও মেধাভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের জাতীয় অভিলাষ ও আকাঙ্ক্ষার সাথে মশকরা করার শামিল।

অথচ, সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণের নিয়োগ কোনো প্রকল্প থেকে হয় না। তাদের নিয়োগ দেয় স্বয়ং বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন। ২০১৭ সাল থেকে বিসিএস নন-ক্যাডাররাও সরকারি মাধ্যমিকের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে আসছেন। অতএব, এখানে স্পষ্টভাবেই দেখা যাচ্ছে যে, সরকারি মাধ্যমিকের শিক্ষকগণ নূন্যতম যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেই এখানে চাকরিতে ঢুকছেন। তারা তাদের যোগ্যতা বলে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করতে যেমন দক্ষ , তেমনি তারা মাধ্যমিকের প্রশাসন চালাতেও সিদ্ধহস্ত। কিন্তু, সরাসরি প্রকল্প থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত এই উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাগণের নেই কোনো শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা। তারা না বোঝে শিক্ষকদের মনস্তত্ত্ব, না বোঝে বিদ্যালয়ের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের দাবি দাওয়া। তাহলে এই সমস্ত অযোগ্য ও অদক্ষ শিক্ষা কর্মকর্তাদের দিয়ে কীভাবে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন করা সম্ভব হবে! কীভাবে তাদের হাত দিয়ে একটি উন্নত রাষ্ট্র বিনির্মাণ করা সম্ভব হবে! কীভাবে তারা দেশের মুখকে গোটা বিশ্বের কাছে উজ্জ্বল করবেন!

বাংলাদেশের সরকারি মাধ্যমিকের একজন সচেতন শিক্ষক হিসেবে আমি নিজেও বারবার এমন অযোগ্য ও অদক্ষ শিক্ষা কর্মকর্তাদের দ্বারা বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছি। তারা না পারছেন আমার মেধার মূল্যায়ন করতে, না পারছেন শিক্ষক হিসেবে আমার প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে। তারা তাদের সীমাহীন অযোগ্যতার কারণে একজন উপযুক্ত শিক্ষকের নাম প্রশিক্ষণের তালিকায় ঢুকাতে পারেন না, তারা একজন যোগ্য শিক্ষকের নাম মাস্টার ট্রেইনারের তালিকায় ঢুকাতে পারেন না, তারা একজন যোগ্য শিক্ষককে বাছাই করতে পারেন না, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা সংক্রান্ত প্রোগ্রামগুলো যথাযথভাবে আয়োজন করতে পারেন না ইত্যাদি।

একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় গতিশীলতা ও উন্নতি আনতে হলে সেদেশের শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের হতে হয় অনেক মেধাবী, সৃজনশীল, দক্ষ ও অভিজ্ঞ। শিক্ষকতা পেশার সাথে যারা জড়িত থাকেন না, তারা সাধারণত এই জায়গাগুলোতে ভালো করতে পারেন না। এজন্যই, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রোভিসি, কোষাধ্যক্ষ, প্রক্টর, প্রভোস্ট নামক পদগুলোতে এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের বিভিন্ন পদে কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয় শিক্ষকদের মধ্য থেকেই। সরকার চাইলেই এসব পদে শিক্ষকদের বাইরে থেকে কর্মকর্তা নিয়োগ করতে পারে। কিন্তু ,সরকার তা করে না।কারণ, বাইরের কর্মকর্তারা এখানে কখনোই ভালো করতে পারেন না। এজন্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো শিক্ষা প্রশাসনের সকল স্তরে সাধারণত শিক্ষকরাই শিক্ষা প্রশাসনের দায়িত্ব পান। কিন্তু, বাংলাদেশের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির আড়ালে অনেক অযোগ্য ও অনভিজ্ঞ ব্যক্তি টাকার লেনদেন করে মাধ্যমিকের শিক্ষা প্রশাসনে ঢুকে পড়ে মাধ্যমিক শিক্ষার ভিত্তিকে আরো নড়বড়ে করে তুলছে।

লেখকঃ সহকারী শিক্ষক (ইংরেজি) পাইকগাছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, খুলনা

মতামত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে মতামত ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক ও আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের;- শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”

শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/২১/০৯/২০২৪


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.