আবুল কাসেম।।
চাকরি সম্পর্কিত একটি কথা বেশ প্রচলিত—চাকরি সোনার হরিণ। আর তা যদি হয় সরকারি, তাহলে তো কথাই নেই। কথাটার মধ্যে ষোলোআনা সত্য নিহিত। চাকরির পেছনে ছুটতে ছুটতে গলধঘর্ম হয়ে শেষে একদিন সে বলতে বাধ্য হয়, চাকরি সোনার হরিণ। তাকে ধরা ও ছোঁয়া সহজ নয়।
সরকার যদি হয় কোনো সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর স্বার্থের অনুকূলে গঠিত; সংখ্যাধিক্যবঞ্চিত গণমানুষের কল্যাণে নিয়োজিত না থাকে, তবে সেই দেশ বিশ্বে দারিদ্র্যপীড়িত হিসেবে চিহ্নিত হতে থাকবে সব সময়।
চাকরি কার না চাই? চাকরি ধনী-গরিব উভয়েরই চাই। খেয়ে-পরে সুস্থ জীবনযাপনের জন্য রুজিরোজগারের আবশ্যকতা অবশ্যই আছে। চাকরি বা অন্য যা কিছু হোক, তবে তা প্রথম বিবেচনায় বিশেষভাবে হওয়া দরকার, যাদের নেই বলতে কিছুই নেই, এমন পরিবারের জন্য। এসব পরিবারের মধ্যে কোথাও কোনো উচ্চশিক্ষিত অথবা ন্যূনতম যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থী থাকলে তারই চাকরি পাওয়াটা আগে দরকার। চাকরি পেতে টাকা চাই। মোটা টাকা। যারা গরিব মানুষ, তাদের টাকা নেই। তাদের শিক্ষালাভের অনুকূল পরিবেশ নেই, তাদের প্রতিযোগিতাপূর্ণ যোগ্যতা অর্জনের সুযোগ নেই। তাদের কথাই আমি বলছি। একটি গ্রাম্য প্রবাদ আছে, ‘যে খেয়ে আছে, তার জন্য বাড়ো, আর যে নাখেয়ে আছে, তার জন্য চড়াও।’ গরিব মানুষটি হয়তো তার কোনো সন্তানকে অত্যন্ত কষ্টেসৃষ্টে লেখাপড়া শিখিয়েছে। তার শেষ সম্বলটুকু খুইয়েছে। তার কপালে চাকরি নেই। হায় হায় করে সে কপাল চাপড়াচ্ছে। তার এই আহাজারির কী কোনো মূল্য আছে? সে যে মাথা কুটে মরছে, তবু সমাজ-রাষ্ট্র তার পাশে নেই। যার অর্থ-সম্পদ আছে, সে-ই নাগাল পাচ্ছে এই সোনার হরিণের।
আজ চূড়ান্ত প্রতিযোগিতার দিনে চাকরির ক্ষেত্রে সরকারি নীতিমালা প্রণয়নের দাবি রাখে। বহুবিধ কারণে এই যৌক্তিক দাবির অপরিহার্যতা দেখা দিয়েছে। কেননা, শিক্ষাগত যোগ্যতার সঙ্গে যাদের মামার জোর ও টাকার জোর আছে, তাদের বেলায়ই চাকরির শিকে ছিঁড়ছে। গরিব প্রার্থীটি তার বৈধ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। পর্দার আড়ালের যোগ্যতা তার একেবারেই নেই। অনেককে বলতে শোনা যায়, ৫ লাখ দিয়ে ঢুকলাম। কেঊ বলে ১০ লাখ। এসব আজ প্রকাশ্য গোপন। যেসব মানুষের টাকা নেই, তাদের কী হবে? এভাবে অধিকারবঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষিত দরিদ্র ছেলেমেয়েরা। তাই প্রায়ই বলতে শোনা যায়, লেখাপড়া শিখে কী হবে? চাকরি তো আর কপালে নেই! যার বেশি আছে, সে-ই সুবিধা পাচ্ছে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদের মালিক হচ্ছে। এভাবে বৈষম্য বেড়েই চলেছে।
জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণের কথা আমরা বলছি ঠিকই, অথচ সেই লক্ষ্য থেকে আমরা ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছি। ক্রমশ বললে ভুল হবে, তা যেন দ্রুততার সঙ্গেই হচ্ছে। সমাজ সুস্থভাবে বিকাশ লাভ করবে, সেই সুযোগ কোথায়? সুনীতিই তো জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের নিয়ামক শক্তি। এই সুুনীতি প্রতিষ্ঠা কি এমনি এমনি হবে? নীতি-নৈতিকতাবিবর্জিত মানুষ্য সমাজ ভালো হোক—এ তারা কখনো চায় না। আমি সরকারকে এই অসাধ্য সাধনে এগিয়ে আসতে বলব। সরকার যদি ভালো মনের করে, যদি সে চায় সমাজ তথা দেশটা ভালো হোক, তাহলে তা করা তার জন্য অসম্ভব কিছু নয়। হাজামজা পচা-এঁদো পুকুরে একটা পদ্ম ফুল যেমন পুকুরটির সুস্থতার পরিচয় নয়, তেমনি একটা দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ছাড়া গোটা কয় পরিবারের উন্নয়ন উন্নত দেশের পরিচয় বহন করে না। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক হতে হবে। সরকারকে হতে হবে পরশপাথর। তার স্পর্শে যেন সমাজ তথা দেশ সুন্দর হয়ে বিকাশ লাভ করে। দেশটাকে একটা আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হলে রাষ্ট্রের নিয়ন্তা শক্তিকে ভালো হতে হবে। তাদের তৃণমূল পর্যন্ত উদার দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ জরুরি।
অহরহ এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ অধিকারবঞ্চিত হচ্ছে, বিভিন্নভাবে বিপর্যস্ত ও প্রতারিত হচ্ছে। এর থেকে নিস্তার পাওয়ার পথ তারা খুঁজে পাচ্ছে না। অন্তত চাকরির ক্ষেত্রে দুর্নীতি বন্ধ করতে পারলে, স্বচ্ছ একটা আবহ সৃষ্টি হলে চাকরিবঞ্চিত অনেকেই চাকরি পেতে পারত।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে সরকার যেভাবে কাজ করছে, তাতে কিছুটা হলেও আশার আলো দেখা দিয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, মালয়েশিয়ায় লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে ডিজিটাল পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে। এটা সরকারের প্রশংসিত উদ্যোগ। মানুষ বিদেশে চাকরি পাওয়ার জন্য যেভাবে প্রতারিত হতো, তা বন্ধ হয়েছে। দেশে চাকরির বাজার অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতিমুক্ত নয়। তাদের এই দুর্নীতি সবার জানা। মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর ক্ষেত্রে ডিজিটাল পদ্ধতির মাধ্যমে দুর্নীতি উচ্ছেদ করা হয়েছে, সেটা দেশেও চাকরির ক্ষেত্রে গ্রহণ করা যুক্তিযুক্ত।
প্রতিটি অধিকারহারা পরিবার স্বাবলম্বী হয়ে গড়ে উঠুক—এরকম একটা সুযোগ তৈরি করা জরুরি। সরকার থেকে মাঝেমধ্যে চাকরি দেওয়ার কথা বলা হয়। অধিকারবঞ্চিত মানুষের কথা বিবেচনায় এনেই তা বলা হয়ে থাকে। আমি বলব, বলাটা যথার্থ। মনের সুপ্ত কল্যাণকামী চিন্তার বহিঃপ্রকাশে অনেকেই আশ্বস্তও হন। কিন্তু এই আশ্বস্তটুকুই যদি একমাত্র সম্বল হয়, তাহলে তো কোনো প্রাপ্তির আশা থাকে না। এখনই সময় এর একটা বিহিত করা। সরকারের বিশাল বিস্তৃত হাতে চাকরির ক্ষেত্রে উপজেলা-থানা-ইউনিয়ন তথা গ্রামভিত্তিক প্রার্থীর তালিকা তৈরি করে কোথায় চাকরিবঞ্চিত হতদরিদ্র অথচ শিক্ষিত যুবক-যুবতিরা অত্যন্ত কঠিন সময় পার করছে, তাদের চাকরির ব্যবস্থা করা। এটা করতে পারলে দুর্নীতির সহজ পথটা নিশ্চিত বন্ধ হয়ে যেত। চাকরির নাটাই থাকবে জাতীয় সংসদ সদস্যদের নিয়ে গঠিত চাকরিসংক্রান্ত জাতীয় কমিটির হাতে। এই কমিটির মাধ্যমে এলাকায় এলাকায় যেসব উচ্চশিক্ষিত গরিব প্রার্থী আছে, যাদের আয়-রোজগারের কোনো পথ নেই, শুধু তাদের জন্য যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরির ব্যবস্থা করা। যাতে করে চাকরি সোনার হরিণ না হয়। কেউ আর চাকরি নিয়ে দুর্নীতি করার সুযোগ না পায়। অন্যান্য কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রগুলোতেও যাতে সরকারের নজরদারি থাকে, তার ব্যবস্থা করা। বিদেশে চাকরির ব্যাপারে আদম ব্যাপারীদের খপ্পরে পড়ে অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়। এ ধরনের ঘটনা সমাজজীবনকে পঙ্গু করে দেয় হরহামেশা। সমাজের মধ্যে দুষ্টচক্রের ভিত যাতে গড়ে উঠতে না পারে, সে ব্যাপারে সরকারের কঠোর নজরদারি-খবরদারি থাকা আবশ্যক। ‘দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন’ই হবে সোনার বাংলা গড়ার একমাত্র মূলমন্ত্র।
সমাজবদলের কথা বলা হয়; কিন্তু সমাজ তো আর এমনি এমনি বদলায় না। সমাজবদলের কারিগর মানুষ। এই মানুষকে চিন্তা-চেতনায় না বদলালে কিছুতেই সমাজবদল সম্ভব নয়।
স্বাধীন দেশের অধিবাসী আমরা। নিজের চলাবলার মধ্যে একটা স্বাচ্ছন্দ্যময় ভাব বা অবাধ গতিময়তা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। নিজ দেশের প্রকৃতির মধ্যে প্রকৃতির সন্তানেরা যেন কত আপনতায় জড়িয়ে থাকে। প্রকৃতির উদারতা তাদের সততই মুগ্ধ রাখে। কিন্তু যখনই সে দেখে অত্যন্ত স্বার্থপর সুবিধাভোগী একটি শ্রেণি তার ওপর প্রভুত্ব বিস্তার করছে, তার অধিকার ছিনিয়ে নিচ্ছে, তাকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দিচ্ছে না, তার মৌলিক অধিকার ভুলুণ্ঠিত হচ্ছে, স্বাধীনতা তার কাছে অর্থবহ হচ্ছে না। তখনই সে হতাশার অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হচ্ছে। সমাজের দিকে তাকালে বৈষম্যের এই জীবনযাত্রার একই দশা আমরা দেখতে পাই। অপকৌশলে কাউকে পেছনে ফেলে, বৈষম্য সৃষ্টি করে বিপুুল জনগোষ্ঠীকে সব ক্ষেত্রে বঞ্চিত রেখে সোনার বাংলা গঠন করা কখনো সম্ভব নয়। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তো যথার্থই বলেছেন, ‘দুজনার হবে বুলন্দ নসিব, লাখে লাখে হবে বদনসিব, এ নহে বিধান ইসলামের।’
আমাদের দেশটা তো প্রাকৃতিকভাবে খুবই সুন্দর। অপার সম্ভাবনার দেশ। কবি বলেছেন, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রাণী সে-যে আমার জন্মভূমি।’ সুন্দর এই কথাটি মনের অতলে ঢেউ তোলে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের অমর সৃষ্টি—‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ আমাদের জাতীয় সংগীত। দেশকে ভালোবাসা মানে দেশের মানুষকে ভালোবাসা। এটাই তো দেশপ্রেম। এটা দিয়েই দেশটাকে আমরা সোনার বাংলা বানাতে পারি—এটাই আমাদের শপথ হওয়া উচিত। তিনি এই বঙ্গের রূপ-সুষমায় বিমুগ্ধ হয়ে বলেছেন, ‘হে মাতঃ বঙ্গ, শ্যামলা অঙ্গ ঝলিছে অমল শোভাতে।’ এঁদো-কাদা মাটি আর মেঘবৃষ্টির দেশ আমাদের বাংলাদেশ। চারদিকে সবুজে সবুজে ছাওয়া অপরূপ এই দেশ। কোথাও যেন রুক্ষতার লেশমাত্র নেই। এত সুন্দর দেশের মানুষ আমরা, আমাদের মন তো সুন্দর হওয়ারই কথা। বিনয় ভদ্রতা আমাদের অঙ্গের ভূষণ হবে—এটাই তো কাম্য। আমরা সবাই মিলে দেশটাকে গড়ে তুলব, বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াব, সাম্য-সৌভ্রাতৃত্ব হবে আমাদের চলার পথের পাথেয়—এই শপথে বলীয়ান হয়েই আমরা পৌঁছে যাব অভীষ্ট লক্ষ্যে। এটাই সোনার বাংলা গঠনে আমাদের একমাত্র শপথ হওয়া উচিত।
লেখক :কবি ও কথাসাহিত্যিক
শিক্ষাবার্তা/জামান/১১/০৫/২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.