শিক্ষাবার্তা ডেস্কঃ শারমিন আক্তার আঁখি। শৈশব-কৈশোর কেটেছে অভাব আর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। সংসারের বড় সন্তান হওয়ায় তাকে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয়েছে। সেই যুদ্ধে আজ তিনি জয়ী। একজন সফল নারী। তার নেতৃত্বে বর্তমানে শতাধিক নারী পেয়েছেন কাজের সন্ধান। আঁখি মাদারীপুরের কালকিনি পৌরসভার চরঠেঙ্গামারা এলাকার মো. হাসিবুল ইসলাম হাসানের স্ত্রী।
কথা বলে জানা গেলো, বরিশালের গৌরনদী উপজেলার মাহিলাড়া জঙ্গলপট্টি গ্রামের আ. হক গোমস্তার মেয়ে আঁখি। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বাবা ক্যানসারে আক্রান্ত হন। এরপর থেকে সংসারে অভাব দেখা দেয়। একদিকে সংসারের খরচ পাশাপাশি ছোট ছোট ভাই-বোনদের পড়াশোনার খরচ। সব মিলিয়ে যেন তাদের জীবনের অন্ধকার নেমে আসে। কোনো উপায় না পেয়ে শিশুকালেই প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো শুরু করেন। পাশাপাশি একটি সেলাই মেশিন কিনে তা দিয়ে কাপড় তৈরির কাজ করতেন। তাতে যে টাকা আয় হতো, তা দিয়েই কোনোভাবে সংসার চলতো।
এভাবেই সংগ্রাম করে তিনি স্নাতকে পড়ার সময় হাতের কাজ করার সুবাদে পরিচয় হয় মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার রমজানপুর ইউনিয়নের উত্তর রমজানপুর গ্রামের হাসিবুল ইসলাম হাসানের সঙ্গে। সেই পরিচয়ের সূত্র ধরেই ২০১৮ সালে আঁখি ও হাসানের বিয়ে হয়। এরপর তাদের সংসারে একটি মেয়ের জন্ম হয়।
স্বামী হাসানের সহযোগিতায় বিয়ের পর ২০১৮ সালেই তিনি গড়ে তোলেন ‘নতুন জীবন নারী উন্নয়ন সংস্থা’। এরপর ২০১৯ সালে কালকিনি মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর থেকে সংস্থার রেজিস্ট্রেশন নিয়ে পুরোদমে লেগে পড়েন কাজে। কালকিনি উপজেলা থেকে খুঁজে খুঁজে বের করেন অসহায় নারীদের। বিধবা, স্বামী পরিত্যক্ত নারীসহ সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের নিয়ে কাজ শুরু করেন। প্রথমে নিজের বোন, মা, শাশুড়িসহ অন্য আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে কুটির শিল্পের কাজ শুরু করেন। এরপর সমাজের অসহায় নারীদের নিয়ে ধীরে ধীরে কাজের বিস্তার ঘটান। আস্তে আস্তে কাজের পরিধি বাড়ে। বাড়তে থাকে সদস্য সংখ্যা।
শারমিন আক্তার আঁখি বলেন, আমার এই কুটির শিল্পে নিয়মিত শতাধিক নারী কাজ করেন। এছাড়া যারা যে সময় সুযোগ হয় কাজ করেন, এমন নারীর সংখ্যা তিন হাজার। এই তিন হাজার সদস্য কালকিনি উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের গ্রামগুলোর অসহায় নারীরা। তাদের বিভিন্ন সময় মহিলা অধিদপ্তর ও যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সহযোগিতায় বিভিন্ন ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে কালকিনি উপজেলার চরঠেঙ্গামারা এলাকায় আমাদের ট্রেনিং সেন্টারে নারীদের হাতের কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রায় ২০টির মতো সেলাই মেশিন আছে। তাছাড়া আমাদের প্রধান কাজ হলো বাংলার ঐতিহ্যকে সবার মাঝে তুলে ধরা। বিশেষ করে হারিয়ে যাওয়া শিল্পকে নতুন রূপে উপস্থাপন করা। আমরা পাট, বেত, হোগলাপাতা, কচুরিপানা, তালপাতা, নারিকেলের সলা, কাগজ, পুরোনো শাড়িসহ নানা উপাদান দিয়ে ব্যাগ, গহনার বক্স, ঝুড়ি, কুলা, ডালি, মাদুর, টেবিল ম্যাট, কলমদানিসহ নানা জিনিসপত্র তৈরি হয়। সেইসঙ্গে নকশিকাঁথা, ব্লক-বাটিক, হাতের কাজের বিছানার চাদর, পাঞ্জাবিসহ নানা পোশাকও তৈরি করা হয়। এছাড়া খাবারও হোম ডেলিভারি দেওয়া হয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গ্রাহকের চাহিদামতো খাবার সরবরাহ করা হয়।
শারমিন আক্তার আঁখি বলেন, কুটির শিল্পের বিভিন্ন পণ্য তৈরি করতে খরচ একটু বেশি পড়ে। তবুও আমাদের পণ্যের চাহিদা আছে। বিভিন্ন মেলায় আমরা এই পণ্য বিক্রি করে থাকি। পাশাপাশি আমাদের জেলাসহ ঢাকার বিভিন্ন সংস্থা অর্ডার দিয়ে থাকে। আমরা তাদের কাছে সেই পণ্য বিক্রি করি। এছাড়া মাদারীপুর শহরের সেলিনা কমপ্লেক্সে আমাদের একটি শো-রুম আছে। সেখানেও আমাদের পণ্য বিক্রি করা হয়। প্রতি মাসে আমাদের ২৫ থেকে ৩৫ হাজার টাকা লাভ হয়। এই আয় দিয়ে আমার সংসারের খরচ মেটানোসহ ছোট ভাইবোনের পড়াশোনার খরচ যোগাড় করি।
তিনি আরও বলেন, আমি সংসারের বড় মেয়ে ও বড় বউ হওয়ায় দুই পরিবারকে আমার দেখতে হচ্ছে। বাবা দুই বছর আগে মারা যাওয়ায় আমাকেই সব সামলাতে হচ্ছে। আর তা সম্ভব হয়েছে নারীদের নিয়ে এই কুটির শিল্পের মাধ্যমে। আসলে একটা সময় আমি একা একা কাজ করেছি। আজ আমার নেতৃত্বে বহু নারী কাজ করছেন। তাদের আয় হচ্ছে। তারা সংসারের কাজ শেষে এই কুটির শিল্পের কাজের মধ্যমে বাড়তি টাকা আয় করছেন। এসব অসহায় নারীদের কাজগুলো দেশের পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি করার ইচ্ছা আছে।
আঁখির স্বামী হাসিবুল ইসলাম হাসান বলেন, কুটির শিল্পের কাজটি প্রথমে আমি শুরু করেছিলাম। পরে আঁখি এসে এর হাল ধরেছে। একটু একটু করে অনেক পরিশ্রম করে আজ আমাদের নেতৃত্বে শতাধিক নারী নিয়মিত কাজ করছেন। আর এসময় নারীরাও বিভিন্ন ট্রেনিং পেয়ে একটু একটু করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। এছাড়া আঁখি এই কাজের জন্য দক্ষিণবঙ্গের নারী উদ্যোক্তা পুরস্কার, দুইবার জয়িতা পুরস্কারসহ নানা পুরস্কার পেয়েছে।
কুটির শিল্পের কাজ করা লিয়া বলেন, আমি কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। পড়াশোনার পাশাপাশি আঁখি আপার সঙ্গে কাজ করি। হোগলাপাতা দিয়ে ব্যাগ ও বিভিন্ন ধরনের ডালি তৈরি করি। একদিন এসে আঁখি আপার কাছ থেকে কাজ বুঝে নিই। তারপর নিজ বাসায় বসে অবসরে কাজগুলো করে থাকি। কাজ শেষ হলে সেই পণ্যটি আঁখি আপার কাছে বুঝিয়ে দিই। এতে করে মাসে আমার তিন হাজার টাকার মতো আয় হয়।
কুটির শিল্পের কাজ করা অহিদা বেগম বলেন, আমি একজন গৃহিনী। আমার একটি মেয়ে আছে। ক্লাস ওয়ানে পড়ে। সংসারের কাজ শেষে আমি পাট, বেত ও হোগলাপাতা দিয়ে বিভিন্ন ব্যাগসহ নানা ধরনের পণ্য তৈরি করি। আঁখি আপা আমাদের ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে এই কাজগুলো শিখিয়েছেন। আমি মাসে প্রায় পাঁচ হাজার টাকার মতো আয় করি, যা আমার সংসারে সচ্ছলতা এনেছে।
আকলিমা বেগম নামে আরেকজন বলেন, আমার সংসারে অভাব লেগেই থাকতো। স্বামীর রোজগারে সংসার চালাতে কষ্ট হতো। পরে আঁখি আপার এখানে এসে প্রথমে কাজ শিখেছি। এখন এই কাজ করে প্রতিমাসে চার থেকে ছয় হাজার টাকা আয় করি।
প্রতিবেশী রফিকুল ইসলাম মিন্টু বলেন, আমি নিজেই দেখেছি অল্প কয়েকজন সদস্য নিয়ে আঁখি এই কাজ শুরু করেছিলেন। আজ তার সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়েছে। আসলে আঁখির নিজ প্রতিষ্ঠানে বসে কাজ করতে হবে, এমন নিয়ম না থাকায় নারীরা বেশি আগ্রহী হচ্ছেন। নারীরা কাজ বুঝে নিয়ে নিজের বাসায় বসেই অবসরে এই কাজ করছেন। এতে করে অসহায় নারীরা স্বাবলম্বী হচ্ছেন। তারা ঘরে বসেই আয় করতে পারছেন। আঁখি অনেক পরিশ্রম করে আজ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। পাশাপাশি অন্য নারীদেরও প্রতিষ্ঠিত করছেন। তিনি আমাদের নারী সমাজের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
কালকিনি মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা হামিদা খাতুন বলেন, আঁখি অনেকদিন ধরেই অসহায় নারীদের নিয়ে কাজ করছেন। তিনি অসহায় নারীদের নিয়ে ‘নতুন জীবন নারী উন্নয়ন সংস্থা’ নামের একটি সংগঠন তৈরি করেছেন। সেই সংগঠনটি মহিলা অধিদপ্তর থেকে রেজিস্ট্রেশন নেওয়া। এই সংগঠনের মাধ্যমে আমরা বহু নারীকে নানা ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি।
কালকিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পিংকি সাহা বলেন, নতুন জীবন নারী উন্নয়ন সংস্থাটি অনেকদিন ধরেই অসহায় নারীদের স্বাবলম্বী করতে কাজ করে যাচ্ছে। তারা এ বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো সহযোগিতা চাইলে, আমরা ব্যবস্থা করে দেবো।
মাদারীপুর মহিলা অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক মাহমুদা আক্তার কণা বলেন, আমি বেশ কয়েকবার উদ্যোক্তা আঁখির প্রতিষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেখানে অনেক অসহায় নারী কাজ করেন। আঁখি গ্রামের মেয়ে হয়েও অনেক সংগ্রাম করে আজ নিজেকে একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেয়েছেন। তাকে দেখে অনেক নারী উৎসাহ পাবেন।
মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন বলেন, বর্তমান সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। যেসব নারীরা সমাজের জন্য কাজ করছেন, তারা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার সহায়ক। সারাদেশে আঁখির মতো এমন হাজারও নারীদের সহায়তায় খুব দ্রুত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে উঠবে।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৮/০৩/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়