জীবনযাপনের ধরন বদলাতে হবে
নিজস্ব প্রতিবেদক।।
সব রোগের চিকিৎসাকে আমরা দুই ভাগে ভাগ করি—একটা সংক্রামক, আরেকটা অসংক্রামক। সংক্রামক রোগ একজন থেকে আরেকজনে যায়। পানিবাহিত হতে পারে, আবার বায়ুবাহিতও হতে পারে। আর অসংক্রামক রোগ হলো, যা সাধারণত একজনের কাছে থেকে অন্যজনের দেহে সংক্রমিত হয় না।
বর্তমানে আমাদের দেশে সংক্রামক রোগ কমে গেছে, কিন্তু অসংক্রামক রোগ বেড়েছে। এই বাড়ার পেছনে কারণ হচ্ছে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতি এবং আমাদের জীবনযাপনের ধরন। অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল এবং এই রোগগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয়। সঠিক ও পর্যাপ্ত চিকিৎসা না পেলে নীরবে জটিল আকার ধারণ করে, যা ব্যক্তিকে অকালমৃত্যু অথবা পঙ্গুত্বের দিকে ঠেলে দেয়। এ ক্ষেত্রে যদি জনসচেতনতা তৈরি করা না যায় তাহলে সরকার ও রোগী উভয়েই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
মূলত অসংক্রামক রোগের পাঁচটি ধারা আমাদের দেশে বেশি হয়—ডায়াবেটিস, কিডনির সমস্যা, ফুসফুসের সমস্যা, ক্যান্সার এবং হৃিপণ্ডের রক্তপ্রবাহ। এই রোগগুলো আমাদের এখানে বেশি হয়। এই রোগগুলো দিন দিন বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে রোগের সিভিয়ারিটি না হলে হাসপাতালে যাওয়ার দরকার হয় না। বাড়িতে থেকেও চিকিৎসা নেওয়া যায়। আমাদের প্রয়োজন হলো জনগণকে সচেতন করা। এর সঙ্গে দরকার জীবনযাপনের ধরন পরিবর্তন ও উন্নত পরিবেশ। মনে রাখতে হবে, পরিবেশগত সুযোগ-সুবিধা দেওয়া না হলে কখনোই অসংক্রামক রোগ থেকে আমরা বের হতে পারব না।
নিরাপদ খাদ্য ও উন্নত পরিবেশ : আমাদের ধারণা, খাওয়াদাওয়া শুরু করে শারীরিক ব্যায়াম। এই অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে স্কুল পর্যায় থেকে। রাস্তার চলাচলের লেন, পানি, বায়ু—এগুলোর মান উন্নয়ন করা জরুরি। এটি না হলে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তাই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও সব ধরনের ফাস্ট ফুড খাওয়া বন্ধে সরকারকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকার যদি সেই সুবিধাগুলো করে না দেয়, এটা কোনো ব্যক্তি দ্বারা সম্ভব হবে না। সুতরাং এই শিক্ষাটা স্কুলেই দিতে হবে।
যে খাদ্যগুলো অসংক্রামক রোগ বাড়ায় সেগুলো চিহ্নিত করা। একই সঙ্গে এসব খাদ্যের ক্যালরি নির্ণয় করা। ফাস্ট ফুডের ক্ষেত্র যখন আসে তখন সেটি আরো প্রকট হয়। আমরা ফাস্ট ফুড যা খাচ্ছি, কত ক্যালরি খাচ্ছি সেটা কেউ জানি না। এ ক্ষেত্রে নিরাপদ খাদ্য বিভাগের দায়িত্ব নিতে হবে।
হাসপাতালে পুষ্টিবিদ ও কাউন্সিলর নিয়োগ দরকার : অসংক্রামক রোগ যখন বাড়তে থাকে তখন রোগীর চিকিৎসার পাশাপাশি প্রয়োজন হয় কাউন্সেলিং ও পুষ্টিবিদদের পরামর্শ। কাউন্সিলর স্বাস্থ্যশিক্ষা প্রসঙ্গে বলবেন এবং পুষ্টিবিদ তাঁর খাদ্য বিষয়ে বলবেন। এ জন্য প্রতিটি হাসপাতালে পুষ্টিবিদ ও কাউন্সিলর নিয়োগ দরকার। আর এ জন্য দরকার সরকারি নিয়ম-কানুন পরিবর্তন। এসংক্রান্ত বিষয়ে সরকারের বাজেট দিতে হবে। এর সঙ্গে সচেতনতা ও সার্ভিস ডেলিভারি। সচেতনতার জন্য মিডিয়ার ভূমিকা থাকবে, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম থাকবে এবং স্কুলে স্কুলে প্রচার করতে হবে। একইভাবে তদারকি লাগবে। খাদ্য নিরাপদ কি না? ক্যালরির পরিমাণ কত আছে?
প্রবীণদের চিকিৎসায় সরকারের উদ্যোগ নেওয়া দরকার : জাপানে এখন কেয়ারগিবার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। আমাদের দেশে পারিবারিক বন্ধন যেহেতু ভালো, সে কারণে এখনো প্রকট আকার ধারণ করেনি। যেহেতু প্রবীণের সংখ্যা বাড়ছে, তাই প্রবীণদের চিকিৎসার বিষয়ে সরকারকে উদোগ নেওয়ার এখনই সময়। বিশেষ করে যাঁদের অসংক্রামক রোগ রয়েছে, যেমন—ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি ডিজিজ, সিওপিডি, ক্যান্সার। এসব রোগে অনেক ওষুধ লাগে এবং সেটা দীর্ঘদিন লাগে। সব হাসপাতালে এঁদের জন্য আলাদা চিকিৎসাব্যবস্থাও নেই। তাই এখন চিন্তা করতে হচ্ছে প্রবীণদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে।
সুস্থ-স্বাভাবিক নাগরিক হিসেবে যাঁরা এত দিন কর্মক্ষম ছিলেন তাঁরা সামাজিক সুবিধা পাবেন কি না, তাঁদের জন্য ইনস্যুরেন্সের প্রচলন করবে কি না—এই প্রশ্নগুলো কিন্তু আসবে। সুতরাং আমরা মনে করি, এখন যদি প্রবীণদের চিকিৎসার বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, ১০ থেকে ২০ বছর পরে দেশের প্রবীণরা সুবিধাগুলো পাবেন।
স্বাস্থ্য খাতে সংকট অনেক : আমাদের হাসপাতালগুলোতে কোয়ালিটি সার্ভিস নেই। আর কোয়ালিটি সার্ভিস এককথায় হবেও না। কারণ এর সঙ্গে অনেক বিষয় জড়িত। এ জন্য আমাদের প্রতিটি রাজনৈতিক দলের উচিত তারা স্বাস্থ্য বিষয়ে কী করতে চায় সেটি মানুষের সামনে প্রকাশ করা, যাতে তারা সমাজের মানুষের কাছে ওয়াদাবদ্ধ হয়। এখন আমরা বলি সর্বজনীন স্বাস্থ্যের কথা। এটা মুখের কথা—স্লোগান। সর্বজনীন সেবা নিশ্চিত করা—এটা হলো আমাদের চ্যালেঞ্জ। এখানে আমাদের একটা বড় ঘাটতি রয়ে গেছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অনেক মানুষ এখনো চিকিৎসাসেবা পায় না। একদিকে সরকারি হাসপাতালে সেবা পাচ্ছে না, অন্যদিকে প্রাইভেট হাসপাতালেও উচ্চ সেবামূল্য এবং নানা ধরনের প্রতারণার কারণে সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
স্বাস্থ্যব্যয়ে সরকারের তুলনায় ব্যক্তির ব্যয় অনেক বেশি। এটি প্রায় ৬৭ শতাংশ। ওষুধের দাম বেড়েই চলছে। স্বাস্থ্যব্যয় বৃদ্ধির এটি একটি প্রধান কারণ। এটি কমাতে হবে। বিশ্বের অনেক দরিদ্র দেশের তুলনায় বাংলাদেশে স্বাস্থ্য বাজেটে বরাদ্দ কম। এ ছাড়া বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় যেসব স্বাস্থ্যপ্রতিষ্ঠান আছে, সেগুলো সরকারের কঠোর নজরদারির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। বেসরকারি স্বাস্থ্যপ্রতিষ্ঠানগুলো নিজস্ব স্টাইলে চলছে। চিকিৎসাব্যয়ও পৃথক। চিকিৎসা নিতে গিয়ে মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছে। এসব বিষয় নিয়ে সরকারকে ভাবতে হবে।