৬ষ্ঠ এবং ৭ম শ্রেণি: শেখা ও শেখাতে গলদঘর্ম শিক্ষার্থী-শিক্ষক
ঢাকাঃ ষষ্ঠ এবং সপ্তম শ্রেণির নতুন কারিকুলামের বই দেওয়া হয়েছে এ বছরের জানুয়ারি মাসে। শিক্ষাবর্ষের অর্ধেকে এসে জুন মাসে অর্ধবার্ষিক মূল্যায়ন করা হচ্ছে স্কুলে স্কুলে। নতুন পদ্ধতির শিক্ষণ-শিখন নিয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা অনেকটা গলদঘর্ম হচ্ছেন। সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণে ‘নতুন পদ্ধতি’ অনেক শিক্ষকই আয়ত্ত করতে পারেননি। পাঠ নির্দেশিকা অনুযায়ী শিক্ষণ প্রক্রিয়া শেষ করার জন্য পর্যাপ্ত সময় মেলেনি স্কুলগুলোতে। গতানুগতিক পরীক্ষা না থাকায় ক্লাসের প্রতি আগ্রহ কম শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়েরই। নতুন ধারায় ‘প্রতীকী’ মূল্যায়ন হওয়ায় শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে দুর্বল শিক্ষার্থীরা নতুন ধারায় মানিয়ে নিতে বেশি আগ্রহী হচ্ছে না। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণির এক জ্যেষ্ঠ শিক্ষক বলেন, নতুন কারিকুলামের ধারাণা ভালো। এটি বাস্তবায়ন করাই চ্যালেঞ্জ। কারণ আমাদের প্রতিটি শ্রেণিতে যে পরিমাণ শিক্ষার্থী থাকে তাদের সবার গ্রুপ অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে পর্যবেক্ষণ করার জন্য সময়টা পর্যাপ্ত নয়। তা ছাড়া বাচ্চাদের (শিক্ষার্থী) ধারণা তাদের পরীক্ষা নেই। এজন্য ক্লাসের প্রতি আগ্রহ কম।
কারিকুলাম প্রসঙ্গে এই স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ৪-৫ জন শিক্ষার্থী নাম না প্রকাশ করার শর্তে জানায়, মূল্যায়ন করছেন শিক্ষকরা, কোনো নম্বর তাদের দেওয়া হয় না। কী সব লিখে রাখেন খাতায়। তারা কিছুই বোঝেন না। সে কি পাস না ফেল কিছু তাদের জানানো হয় না। দুজন শিক্ষার্থী জানায়, এখন আগের মতো পরীক্ষা নেই, টিচাররা এমনিতে পাস নম্বর দিয়ে দেবেন।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষকদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, নতুন ধারার মূল্যায়নে তো কোনো শিক্ষার্থীকে পাস কিংবা ফেল নম্বর দেওয়া হয় না। তাদের প্রতীকী মূল্যায়ন হয়। যেমন- ভালো প্রতীক হচ্ছে ‘চতুর্ভুজ’, খুব ভালো ‘বৃত্ত’, অনেক ভালো ‘ত্রিভুজ’। এ থেকে একজন শিক্ষার্থীর শিখন, পঠন, উপস্থাপনা, দক্ষতা নিরূপণ করা হয়।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর এ কে স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী জানায়, তার ক্লাসে ৭০ জনের জন্য ১০ জন করে সাতটি গ্রুপ তৈরি করে দিয়েছেন শিক্ষকরা। তারা নিয়মিত নাটক, উপস্থাপনা, অ্যাসাইনমেন্ট, পোস্টার তৈরি-লাগানোসহ নানা ধরনের কাজ করে। তবে গ্রুপের সবাই কাজ করে না। তিন-চার জনই অ্যাকটিভ থাকে। তার অভিযোগ, গ্রুপ লিডারের সঙ্গে যাদের ভালো সম্পর্ক থাকে সে তাদের নিয়ে কাজ করতে চায়। কেউ স্কুলে কয়েক দিন অনুপস্থিত থাকলে তাকে দলের মধ্যে রাখতে চায় না। কেউ কোনো প্রজেক্টের কাজ বুঝতে না পারলেও স্যাররা ভালোভাবে বুঝিয়ে দিতে চান না। আমরা যা বুঝি সেভাবে করে আনতে বলেন। অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিলেও কে কী ভূমিকা রেখেছে সেটি পৃথক মূল্যায়ন জরুরি।
এ স্কুলের সপ্তম শ্রেণির এক শিক্ষক বলেন, ৪৫ মিনিটের ক্লাসে আলাদাভাবে কে কী শিখছে তা খুঁজে বের করা সম্ভব হয় না। গ্রুপ লিডারকে দায়িত্ব দিয়ে তার নেতৃত্বে সেই দলকে কাজ করতে বলা হয়। গ্রুপের কেউ কেউ সেসব কাজ বুঝতে পারে না। তাদের কোনো ভূমিকাও থাকে না। তারা শুধু ক্লাসে আসছে-যাচ্ছে। আমরা তাদের জোর করেও কিছু করাতে পারি না। সুযোগ পেলে মাঝেমধ্যে কাউকে আলাদা করে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়।
ক্লাসের পাঠ প্রসঙ্গে রাজধানীর একটি স্কুল অ্যান্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র মুন্না (ছন্দনাম) জানায়, তার ক্লাসে আটজন করে নয়টি গ্রুপ তৈরি করা হয়েছে। একটি গ্রুপের লিডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে সে। মুন্না বলেন, গ্রুপে আটজন করে থাকলেও প্রজেক্ট তৈরির কাজ সবাই করতে চায় না। কেউ কেউ বুঝতে পারে না, কেউ আবার ফাঁকি দেয়।
এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এক শিক্ষক বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর থেকে নির্দেশনার ভিত্তিতে আমরা কোনো শিক্ষার্থীকে জোর করে কিছু করাতে পারি না। ক্লাসে টিমওয়ার্ক করে কাজ করতে দেওয়া হয়। তাতে যদি কেউ করতে না চায় তাকে বুঝিয়ে বলা ছাড়া আমাদের কিছুই করার থাকে না।
নতুন পদ্ধতি সম্পর্কে অধিকাংশ শিক্ষকদের স্বচ্ছ ধারণা নেই বলে মনে করেন শিক্ষাবিদ প্রফেসর মোহাম্মদ কায়কোবাদ। তিনি বলেন, নতুন পদ্ধতি সম্পর্কে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ প্রয়োজন ছিল শিক্ষকদের। তাদের যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, তাতে পুরোপুরি বিষয়টি আয়ত্ত করতে পারেননি বলে মনে হয়। আর শিক্ষার্থীদের ক্লাসে আগ্রহ কম থাকে যখন শিক্ষক ওই বিষয়টি ভালোভাবে উপস্থাপন করতে পারেন না। এটির ঘাটতি হলে ছেলেমেয়েরা ক্লাসে মনোযোগী থাকে না।
তিনি বলেন, আমাদের ছেলেমেয়েরা আগের পরীক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। কিন্তু এখন নতুন একটা পদ্ধতির মধ্য দিয়ে তাদের শিখতে হচ্ছে- এটায় তারা সহজে মানিয়ে নিতে পারছে না। তাদের কাছে মনে হয় গতানুগতিক কোনো পরীক্ষা নেই, ক্লাসে পড়াশোনারও দরকার নাই। বাস্তব হচ্ছে তাদের এখন লেখাপড়ায় আরও বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত।
সম্প্রতি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যথাযথ উপায়ে নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ক্লাস ও মূল্যায়ন না হওয়ার বিষয়টি শিক্ষা প্রশাসনের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এ বিষয়ে ১৮ জুন একটি নোটিশ জারি করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)।
এতে বলা হয়েছে, মাধ্যমিক স্তরের ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েও আগের পদ্ধতিতে যারা পাঠদান করাচ্ছেন তাদের তালিকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে চেয়েছে মাউশি।
মাউশির নোটিশে বলা হয়, সম্প্রতি লক্ষ করা যাচ্ছে মাধ্যমিক স্তরের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোনো কোনো শিক্ষক ক্লাসে তা যথাযথ অনুসরণ করছেন না।
একই সঙ্গে বলা হয়েছে, শিক্ষকদের শ্রেণি পাঠদান ও মূল্যায়ন সংক্রান্ত প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষক সহায়িকা অনুসরণ করে পাঠদানের জন্য অনুরোধ জানানো যাচ্ছে।
প্রশিক্ষণ প্রসঙ্গে মাউশির পরিচালক (প্রশিক্ষণ উইং) ড. প্রবীর কুমার ভট্টাচার্য্য বলেন, মাউশির আওতাধীন মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য পাঁচ দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ, শিক্ষক সহায়িকা ও মূল্যায়ন নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মুক্ত পাঠের মাধ্যমে মূল্যায়ন সংক্রান্ত অনলাইন কোর্স সম্পন্ন করা হয়েছে।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২১/০৬/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়