৩৮ বিসিএসের নিয়োগে রেকর্ড সময় পার
নিউজ ডেস্ক।।
বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ থেকে নিয়োগ পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি বিসিএস পরীক্ষায় সব ধাপ শেষ করতে গড়পড়তা সময় লাগে আড়াই থেকে তিন বছর। কিন্তু ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষায় এসে এই দীর্ঘসূত্রতা আরও বেড়েছে। ইতিমধ্যে ৩ বছর ৯ মাস পার হলেও শেষ হয়নি নিয়োগ প্রক্রিয়া। ২০১৭ সালের মার্চে যে বিসিএস পরীক্ষার যাত্রা শুরু হয়েছিল তা শেষ হয়নি ২০২১ সালের জানুয়ারিতে এসেও। আগামী মার্চে এই বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের চার বছর পূর্ণ হবে, কিন্তু এখনো চূড়ান্ত নির্বাচিত ২ হাজার ২০৪ জনকে নিয়োগ দিতে পারেনি সরকার। নিয়োগের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে এসব চাকরিপ্রার্থী একদিকে যেমন ভুগছেন হতাশায়, তেমনি তাদের জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে তারুণ্য।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে গত ১৮ জানুয়ারি জনপ্রশাসন সচিব ইউসুফ হারুন বলেন, ‘আমাদের প্রস্তুতি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের কাজ প্রায় শেষ হয়েছে। আশা করি শিগগিরই আমরা ৩৮তম বিসিএসের জন্য বাছাই করা প্রার্থীদের নিয়োগ দিতে পারব। এটা ৮ থেকে ১০ দিনের মধ্যেও হতে পারে।’
জানা গেছে, ৩৮তম বিসিএসের জন্য সরকার ২০১৭ সালের ৫ মার্চ পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে (পিএসসি) চাহিদা পাঠায়। একই বছরের ২০ জুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে পিএসসি। শুরুতে ২ হাজার ২৪টি পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্য প্রস্তাব পাঠানো হলেও পরে আরও ১৮০ পদ বাড়ানো হয়। আর এই পদ বাড়াতে গিয়েই সময় বেশি লাগার প্রক্রিয়া শুরু হয়। পরে ২০১৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়া হয়। এতে ৩ লাখ ৮৯ হাজার ৪৬৮ জন আবেদন করেন, যা ছিল ওই সময় পর্যন্ত রেকর্ড সংখ্যক আবেদন। ১ মাস ২১ দিন পর প্রিলিমিনারির ফল প্রকাশ হয়। এতে উত্তীর্ণ হন ১৬ হাজার ২৮৬ জন। ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে এই বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়। ২০১৯ সালের ১ জুলাই লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়। সেখানে উত্তীর্ণ হয় ৯ হাজার ৮৬২ জন। লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ করতে সময় লাগে ১০ মাস। ২৯ জুলাই এই বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা শুরু হয়। সাড়ে ৯ হাজারের কিছু বেশি প্রার্থীর মৌখিক পরীক্ষা (ভাইভা) নিতে সময় লাগে যায় ৭ মাস। গত বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি সেই মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়। এরপর ফল প্রকাশের অপেক্ষা শুরু হয়। সবশেষে গত বছরের ৩০ জুন ২ হাজার ২০৪ জনকে চূড়ান্তভাবে নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করে পিএসসি।
২০১৭ সালের মার্চে যে বিসিএসের যাত্রা শুরু হয়েছে সেই বিসিএসের নিয়োগ শেষ হয়নি ২০২১ সালের জানুয়ারির শেষ দিকে এসেও। ৩ বছর ৯ মাসেও এই বিসিএসের নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে না পারার কারণ জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে এই বিসিএসের প্রার্থী চূড়ান্তভাবে বাছাই করতে বিলম্ব হয়েছে। পাবলিক সার্ভিস কমিশন সুপারিশ করার পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে খুব বেশি দিন ধরে আটকে নেই। সুপারিশ পাওয়ার ৬ মাসের মধ্যেই আমরা পুলিশ ভেরিফিকেশন, মুক্তিযোদ্ধা ও পোষ্যদের সনদ যাচাই-বাছাইয়ের কাজ শেষ করতে পেরেছি। সব মিলিয়ে হয়তো এই বিসিএসের প্রার্থীদের প্রায় চার বছর সময় লেগেছে, কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এখানে ভূমিকা খুব কম।’
পাবলিক সার্ভিস কমিশন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পক্ষে তাদের কিছু বলার সুযোগ কম উল্লেখ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘বিসিএসের জন্য সময় একটু বেশি লাগলেও পিএসসির পরীক্ষার গুণগত মান বেড়েছে। গত কয়েক বছর ধরে পিএসসির বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর পাওয়া যায়নি। এই স্বচ্ছতা এবং চাকরিগত সুযোগ-সুবিধার জন্য মেধাবীরা সরকারি চাকরিতে ঝুঁকছেন। এখন প্রায় প্রতিটি সাধারণ বিসিএসই চাকরিপ্রার্থীদের আবেদনের সংখ্যার দিক থেকে আগের বিসিএসকে টপকে যাচ্ছে। আগে তরুণদের স্বপ্ন ছিল আমেরিকা যাওয়া, এখন তরুণদের স্বপ্ন হচ্ছে বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরি নেওয়া। পিএসসির প্রতিশ্রুতি হচ্ছে প্রতি বছর একটি বিসিএস আয়োজনের। কিন্তু তা করতে পারছে না তারা।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পিএসসির একজন সদস্য বলেন, ‘আমরা প্রতি বছর বিসিএস আয়োজন করতে পারছি না, বিষয়টি পুরোপুরি সত্য নয়। কারণ যখনই দুই বিসিএসের মধ্যে সময়ের ব্যবধান বেড়ে যায় তখন একটা বিশেষ বিসিএস আয়োজন করা হয়। প্রতি বছর বিসিএসের হিসাব করতে হলে বিশেষ বিসিএসও আমলে নিতে হবে। হয়তো বিশেষ বিসিএসগুলোতে পূর্ণ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা হয় না। কিন্তু বিশেষ বিসিএসগুলোতে এদেশেরই বেকার ছেলে-মেয়েরা চাকরির জন্য আবেদন করছে এবং নিয়োগ পাচ্ছে।’
৩৮তম বিসিএসের চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও ক্যাডার পদে নিয়োগ পাননি ৬ হাজার ১৭৩ জন। তাদের নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে নন-ক্যাডার পদে নিয়োগের আবেদন নেওয়া হয়েছে। প্রথম শ্রেণির নিয়োগ শেষ হলে শুরু হবে দ্বিতীয় শ্রেণির নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ। বিসিএসের চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও যারা ক্যাডার পদে নিয়োগ পান না, তাদের মধ্য থেকে প্রথম শ্রেণির নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয় ৩১তম বিসিএস থেকে। আর বিসিএসে উত্তীর্ণদের মধ্য থেকে যারা ক্যাডার পদে নিয়োগ পাননি তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিতে ২০১৪ সালের ১৬ জুন নন-ক্যাডার পদের নিয়োগ বিধিমালা সংশোধন করে সরকার। বিসিএসের চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও যারা ক্যাডার পদে নিয়োগ পাননি তাদের মধ্য থেকে যারা প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ পেতে চান তাদেরকে আলাদাভাবে কমিশনে আবেদন করতে হয়।
এদিকে সাধারণ বিসিএসের চলমান কার্যক্রমের মাঝে বিশেষ বিসিএসের আয়োজন করতে গিয়ে ব্যাহত হচ্ছে পূর্ববর্তী বিসিএসগুলোর ধারাবাহিকতা। ৩৮তম বিসিএস শেষ না করেই ৩৯ ও ৪০তম বিশেষ বিসিএস শেষ করা হয়েছে। কম নম্বরের পরীক্ষা নিয়ে এসব বিশেষ বিসিএসের নিয়োগ দেওয়া হয়। এতে করে সাধারণ বিসিএসের ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়। এ কারণেই বিশেষ বিসিএসসহ প্রতিটি বিশেষ নিয়োগের জন্য আলাদা আলাদা কমিশন গঠনের দাবি উঠেছে। চাকরিপ্রার্থীরা বলছেন, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল কমিশনের মতো স্বতন্ত্র কমিশন গঠন করা যেতে পারে। শিক্ষক ও চিকিৎসক নিয়োগের জন্য এডুকেশন ও মেডিকেল কমিশন গঠনের মাধ্যমে বিশেষ বিসিএস কার্যক্রম আলাদা করা সম্ভব হলে বিসিএসে দীর্ঘসূত্রতা কমানো যাবে বলে তারা মনে করেন। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও পুলিশ ভেরিফিকেশনের মতো সময়সাপেক্ষ ও জটিল যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার সংস্কারেরও দাবি তাদের। অনেকে আবার খাতা মূল্যায়নে দীর্ঘ সময় ব্যয়কে বিসিএসে দীর্ঘসূত্রতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলে মনে করেন। ৩৮তম বিসিএস থেকে একটি খাতা দুজন পরীক্ষক দেখেছেন। একজন পরীক্ষকের খাতা দ্বিতীয় জন রি-একজামিন করছেন। কোনো কারণে সন্দেহ বা জটিলতার সৃষ্টি হলে সেই খাতা পাঠানো হয়েছে তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে। এ কারণেও ৩৮তম বিসিএসের নিয়োগ দিতে এত দীর্ঘ সময় লাগছে। অথচ ভারতের ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশন প্রতি বছর একটি করে বিসিএসে নিয়োগ দিচ্ছে। এক বছরের ব্যবধানে তারা প্রার্থী বাছাই করে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে পাঠিয়ে দেয়। সেই তুলনায় বাংলাদেশ ঢের পিছিয়ে।
পিএসসি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যতই দিন যাচ্ছে ততই বিসিএসে দীর্ঘসূত্রতা বাড়ছে। ১৯৮২ সালের বিসিএস থেকেই দেখা যাচ্ছে এক বছরের বিসিএসে নিয়োগ হয়েছে পরের বছর। ১৯৯০ সালের পর থেকে সব বিসিএস শেষ করতেই আড়াই থেকে তিন বছর লেগে যাচ্ছে। এর মধ্যে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ের ২৭তম বিসিএসে লেগেছে ৩৯ মাস সময়। ২৭তম বিসিএসের পর আবারও দীর্ঘ সময় লেগেছে ৩৪তম বিসিএসে। ওই বিসিএস শেষ করতে ৩০ মাস সময় লেগেছিল। ফল প্রকাশের দিক থেকে ৩৫তম বিসিএসে সবচেয়ে কম সময় লেগেছে। আড়াই বছরেই এই বিসিএসের নিয়োগ শেষ হয়েছে। ৩৬ ও ৩৭তম বিসিএসে লেগেছে তিন বছর সময়।
৪০তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল এ মাসেই : চলতি মাসেই ৪০তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল হতে পারে। লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশের জন্য সরকারি বন্ধের দিনগুলোতেও পিএসসি কাজ করে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। অনেক উত্তরপত্রে দুই পরীক্ষকের দেওয়া নম্বরের ব্যবধান বেশি হওয়ায় উত্তরপত্র মূল্যায়নে সময় বেশি লেগেছে। এ কারণেই এ বিসিএসের ফল প্রকাশ করতে বিলম্ব হচ্ছে। গত বছরের মে মাসে ৪০তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এই পরীক্ষায় আবেদন করেছিলেন ৪ লাখ ১২ হাজার ৫৩২ জন প্রার্থী। এর মধ্যে পরীক্ষা দিয়েছেন ৩ লাখ ২৭ হাজার পরীক্ষার্থী। তাদের মধ্যে প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হন ২০ হাজার ২৭৭ জন। ২০১৮ সালের আগস্টে ৪০তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে পিএসসি। ৪০তম বিসিএসে মোট ১ হাজার ৯০৩ জনকে ক্যাডার পদে নিয়োগ দেওয়ার কথা রয়েছে।
অন্যদিকে ৪১তম বিসিএসে প্রিলিমিনারি পরীক্ষার অপেক্ষায় আছেন সাড়ে ৪ লাখের বেশি চাকরিপ্রার্থী। গত বছরের ২৭ নভেম্বর ৪১তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে পিএসসি।
এরই মধ্যে দুই বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে পিএসসি। এর মধ্যে ৪২তম বিসিএসটি বিশেষ এবং ৪৩তমটি সাধারণ। ৪২তম বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে ২ হাজার চিকিৎসক নেওয়া হবে। আর ৪৩তম বিসিএসে বিভিন্ন ক্যাডারে ১ হাজার ৮১৪ জন কর্মকর্তা নেওয়া হবে।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘বাংলাদেশের শিক্ষিত মেধাবী তরুণ-তরুণীদের জীবনের একটি বড় অংশই চলে যাচ্ছে বিসিএস পরীক্ষা দিতে। আর কোনো দেশে এ ধরনের চাকরিতে এত সময় লাগে না। আইসিএস, সিএসপি পরীক্ষা প্রতি বছর হতো।’
পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়াই বিসিএসে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে মত দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘পদ্ধতিগত আরও কিছু সংস্কার করে প্রতি বছর বিসিএস আয়োজন ও শেষ করতে হবে। ইচ্ছা থাকলে এটা সম্ভব বলে আমি মনে করি।’ সুত্র দেশ রূপান্তর