২০২০ সালের প্রত্যাশা
ড. এম এ মাননান উচ্চশিক্ষার ভুবনে বুধবার ভোরের আলো ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী হয়ে থাকল নতুন বছরটি। বাংলাদেশের জন্য বিশাল সম্ভাবনা, আনন্দোজ্জ্বল আর স্মৃতিকাতর বছর ২০২০ সাল। এ বছরই দেশব্যাপী পালিত হবে বাংলাদেশের স্থপতি, রূপকার ও স্বাধীনতার ঘোষক বাঙালি জাতির নয়নমণি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী। বছরটা তাই পরিচিতি পাবে ‘মুজিববর্ষ’ নামে। এ কারণে ২০২০ সাল সব বাঙালির স্মৃতির পটে গেঁথে থাকবে চিরকাল জাতির পিতার অবিস্মরণীয় অবদান স্মরণে। অনেক কিছুর সঙ্গে জাতির জনক স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীন দেশটাকে একটি সুখী-সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে, যা হবে অশিক্ষামুক্ত এবং সুশিক্ষিত দক্ষতাসম্পন্ন যোগ্য মানুষের আবাসভূমি। তাঁর স্বপ্ন পূরণ তিনি করতে পারেননি, সে সময়টা তাঁকে দেয়নি স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি কুচক্রী মহল। তবে তাঁর স্বপ্ন পূরণে তত্পর হয়েছেন তাঁরই যোগ্য কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দেশের বিভিন্ন সেক্টরের অভাবনীয় উন্নয়নের ন্যায় শিক্ষাক্ষেত্রেও হয়েছে দৃশ্যমান অগ্রগতি, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষায়। বিগত বছরে আমরা ১৭ কোটি মানুষ পেয়েছি, দেখেছি আর অনুভব করেছি অনেক কিছু। বছরের প্রথমেই পেয়েছি নতুন অঙ্গীকার নিয়ে এসেছে নতুন সরকার, যার নেতৃত্বে রয়েছেন বাংলাদেশের টানা তৃতীয়বারের এবং দেশের চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিশ্বস্বীকৃত অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তাঁর সরকারে পূর্বে শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন শিক্ষার উন্নয়নে নিবেদিতপ্রাণ নুরুল ইসলাম নাহিদ, যিনি দিয়েছেন একটি বাস্তবমুখী সর্বজনগ্রাহ্য শিক্ষানীতি, যার মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনা, যা লালন করছেন তাঁর কন্যা। তারই সময়ে তার একাগ্রতায় মঞ্জুরি কমিশন বাস্তবায়ন করেছে উচ্চশিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে প্রথমবারের মতো গৃহীত বিশ্বব্যাংক কর্তৃক অর্থায়নকৃত ২০৫৪ কোটি টাকার ‘হেকেপ’ প্রকল্প এবং পার্লামেন্টে পাশ হয়েছে এক্রেডিটেশন কাউন্সিল আইন। এবারের কেবিনেটে শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে স্থান পেয়েছেন সফল কূটনীতিক এবং সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তার নেতৃত্বে ইতিপূর্বেকার অর্জনের ধারাবাহিকতায় সার্বিকভাবে শিক্ষাজগত্ দেখছে পরিবর্তনের হাওয়া আর বিশেষভাবে উচ্চশিক্ষা জগতে ছড়িয়ে পড়ছে উন্নয়নের আলোর ছটা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের প্রচেষ্টায় প্রণীত দশ বছর মেয়াদি স্ট্র্যাটেজিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ চলছে জোরেশোরে। ইতোমধ্যে প্রথমবারের মতো উচ্চশিক্ষা এক্রেডিটেশন কাউন্সিলও কাজ শুরু করেছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ২ হাজার ২৬০টি কলেজের ১৬ হাজার ৫০০ শিক্ষককে নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের টিচিং ও নেতৃত্বের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ২৮ লক্ষাধিক শিক্ষার্থীর শিক্ষার মানোন্নয়নের অভিপ্রায়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বাস্তবায়িত হচ্ছে কলেজ শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্প (সিইডিপি)। উচ্চশিক্ষার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিগত ১০ বছরে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সর্বাধিকসংখ্যক পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রায় দেড় ডজন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আর ছয়টি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়। উচ্চতর মাদ্রাসাশিক্ষাকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সংসদে আইন পাশ করে দাওরায়ে হাদিসের সনদকে ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি বিষয়ের মাস্টার ডিগ্রির সমতুল্য করা হয়েছে, যা করার মতো দৃঢ়তা দেখাতে পারেনি আগের কোনো সরকারই। প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে গবেষণায় (এমফিল/পিএইচডি) আর্থিক সহায়তা দেয়ার উদ্যোগ একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ। দেশবাসী লক্ষ করেছেন, বিগত বছরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে র্যাগিং, বুলিং আর গণরুম কালচার বিতাড়নের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দীর্ঘ ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচন সুুষ্ঠু পরিবেশে, সব ছাত্র সংগঠনের অংশগ্রহণে, কোনো রকমের হাঙ্গামা ছাড়াই। এত কিছুর পরও আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই। করণীয় আছে আরো অনেক। শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু আবাসন-সংকট কাটছে না। গণরুম নামক অমানবিক ‘আবাসন ব্যবস্থা’ চিরতরে নির্মূল করতে হলে আবাসিক হলের সংখ্যা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। সুচিন্তিত পরিকল্পনা ছাড়া বিভিন্ন বিভাগে সিট সংখ্যা বাড়ানোর প্রবণতার বিষয়টিও বিবেচনার দাবি রাখে। বিভাগভিত্তিক সিট সংখ্যার সঙ্গে আবাসিক হলগুলোর ধারণক্ষমতার সামঞ্জস্য রাখতেই হবে আবাসন নিয়ন্ত্রণ-সীমার মধ্যে রাখার স্বার্থে। শিক্ষার সুযোগ যেমন সংকোচন করা যাবে না, তেমনি অপরিকল্পিত সম্প্রসারণের কারণে যেন শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ বৃদ্ধি না পায় সে দিকটিও বিবেচনায় রাখা অপরিহার্য। বেশি দুর্ভোগ যেখানে, অনিয়ম আর অনাচারের সহজ প্রবেশও সেখানে। নতুন বছরে আমাদের প্রত্যাশা আবাসিক হল-হোস্টেল প্রাধ্যক্ষ আর আবাসিক শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণে থাকুক; শিক্ষার্থীদের সিট বরাদ্দে অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধ হোক; হল-হোস্টেলে সাংস্কৃতিক চর্চার সুযোগ সৃষ্টিসহ সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা করা হোক; গণরুম কালচার চিরতরে নির্মূল হোক; র্যাগিং-বুলিং শব্দযুগল শিক্ষার্থীদের ‘ব্যক্তিগত অভিধান’ থেকে মুছে যাক; ক্যাম্পাসে ‘বড়ো ভাই’ প্রথা কবরস্থ হোক; জোর করে জুনিয়র শিক্ষার্থীদের মিছিলে নেওয়ার মনোবৃত্তি বড়োদের মন থেকে উধাও হোক; হল-হোস্টেলে সব শিক্ষার্থীর সহ-অবস্থান নিশ্চিত হোক; শিক্ষার্থীরা নিজেদের শিক্ষাস্বার্থ সংরক্ষণের জন্য রাজনীতি করুক, তবে জাতীয় রাজনীতির আঁচড় তাদের গায়ে না লাগুক। আমরা আরো চাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে শ্রদ্ধাপূর্ণ সম্পর্ক বৃদ্ধি পাক, দায়িত্বশীল সহযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি হোক; শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবার মনোজগতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসুক; গবেষণার মান বাড়ুক, গবেষণার সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী হোক, গবেষণা খাতে সরকারি বরাদ্দ বৃদ্ধি পাক, বিশ্ববিদ্যালয়-শিল্পপ্রতিষ্ঠান সহযোগিতা উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে গবেষণাকে সমৃদ্ধতর করুক যাতে আমরা একদিন চীনের মতোই বিদেশি প্রযুক্তি দেশে আমদানি করা নিষিদ্ধ করার মতো অবস্থানে আসতে পারি। এমন শিক্ষার্থী তৈরি হোক যারা ‘প্রকৌশলী থেকে জঙ্গি’ হবে না, শিক্ষা নিয়ে জঙ্গিপনা আর সহিংসতায় জড়িয়ে শিক্ষার অপমান করবে না আর মা-বাবার মুখে কালি লেপে দিয়ে পরিবারকে কলঙ্কিত করবে না। এমন ছাত্রের ‘সৃষ্টি’ হোক যারা রাজনীতির খুঁটি ব্যবহার করে আবরার হত্যাকাণ্ডের মতো দুষ্কর্ম করে নিজের জীবন বিনষ্ট করবে না, মঞ্জুরিত হওয়ার আগেই ফুলের বুকে পদদলনের ছোঁয়া লাগাবে না এবং একই সঙ্গে নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কলঙ্কিত করবে না। প্রত্যাশা করি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা প্রস্ফুটিত পলাশ ফুলের মতো সুন্দরের আভা ছড়িয়ে দিক আকাশে বাতাসে; হয়ে উঠুক সৃজনশীল, উদ্ভাবনী শক্তিসম্পন্ন আর নীতিনৈতিকতার পরশে সৃষ্টিশীল সুযোগ্য নাগরিক যারা দেশকে আগামীতে নেতৃত্ব দিবে, উদীয়মান অর্থনীতির এ দেশটিকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের মর্যাদায় আসীন করবে এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তুলবে। নিজের এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যতকে নিরাপদই শুধু নয়, নিষ্কণ্টকও করবে। এ বছরটিতে আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে সব অপশক্তি দূর হোক; ক্যাম্পাসের ভেতরে ‘মিথ্যা তৈরির কারখানা’ নির্মূল হোক; মিথ্যাচারের মাধ্যমে সহকর্মী কিংবা প্রশাসনকে বিব্রত করার অপতত্পরতা বিদূরিত হোক; মিথ্যাকে দুই হাতে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিয়ে সত্যের চর্চা হোক; বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে অনাচারের পরিবর্তে সদাচারের সয়লাব ঘটুক; পরচর্চা, পরনিন্দা আর নিষ্প্রয়োজনীয় সমালোচনার সলিল সমাধি হোক। নতুন বছরটি উচ্চশিক্ষার অঙ্গনে সৃষ্টি করুক নতুন নতুন সম্ভাবনার, বিশ্বজয়ী আইডিয়ার, সৃজনশীল কর্মতত্পরতার আর উদ্দীপ্ত তারুণ্যের আলোক সম্ভার। লেখক: কলামিস্ট; উপাচার্য,বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়