১০ ডিসেম্বর সরকারকে লালকার্ড
নিউজ ডেস্ক।।
শত বাধা উপেক্ষা করে রাজশাহীর বিভাগীয় গণসমাবেশ সফলভাবে শেষ করেছে বিএনপি। লাখ লাখ নেতাকর্মীর উপস্থিতিতে সমাবেশের মাঠ থেকে শুরু করে রাজশাহী শহরের আশপাশের রাস্তা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। বিএনপি নেতাদের দাবি- রাজশাহীর সমাবেশ থেকে জনগণ সরকারকে হলুদ কার্ড দেখিয়েছে। আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিভাগীয় গণসমাবেশ থেকে জনগণ সরকারকে লাল কার্ড দেখাবে।
নগরীর হাজী মুহম্মদ মুহসীন সরকারি উচ্চবিদ্যালয় মাঠে (মাদরাসা মাঠ) শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় সমাবেশ শুরু হয়। বেলা ২টায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও নেতাকর্মীর বিপুল উপস্থিতির কারণে সাড়ে তিন ঘণ্টা আগে কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে সমাবেশের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়ে যায়।
সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকার দুঃস্বপ্ন দেখছে- এই বুঝি তাদের গদি গেল। যেটাকে আমরা বলি ‘চোরের মন পুলিশ পুলিশ’। তারা হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করছে। আওয়ামী লীগ এখন লুটেরা দলে পরিণত হয়েছে। বাংলার মানুষ কখনো অন্যায় সহ্য করেনি এখনো করবে না। তিনি বলেন, সরকার জনগণের পক্ষে থাকা কর্তব্য। আমরা এখানে মঞ্চে যারা বসে আছি অধিকাংশই মুক্তিযোদ্ধা। ধানের শীষে আজকে রক্ত জমেছে। এই রক্ত পরিষ্কার করতে আমরা আন্দোলনে নেমেছি। আমরা আন্দোলন শুরু করেছি, শেখ হাসিনা পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে।
তিনি আরো বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া আমরা নির্বাচনে যাবো না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন পরিচালনা করবে এবং তাদের অধীনে সব দল নির্বাচনে অংশ নেবে। তরুণদের দুর্বার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটবে বলে তিনি আশাবাদী।
মির্জা ফখরুল বলেন, এই সরকার ব্যাপক লুটপাট করছে আর সাধারণ মানুষকে নিঃস্ব করছে। দেশের রাজনৈতিক কাঠামো, আর্থসামাজিক কাঠামো ধ্বংস করছে। আওয়ামী লীগের পাতিনেতারাও এখন হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। তাহলে বোঝেন বড় বড় নেতাদের কী অবস্থা। তারা দেশটাকে একেবারে ধ্বংস করে দিচ্ছে। তিনি আরো বলেন, সরকার জনগণের পক্ষে না থেকে লুটপাটে মেতেছে। তাদের দায়িত্ব ভুলে গেছে।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, জনগণের যখন জোয়ার ওঠে তখন কেউ ঠেকাতে পারে না। সরকার মনে করেছে- বাস বন্ধ করে দিয়ে জনগণের স্রোত ঠেকিয়ে দিবে; কিন্তু মানুষ হেঁটে সমাবেশে এসেছে। যারা আসার সবাই এসেছে। এরাই বিএনপির আসল নেতা, আসল কর্মী। তিনি বলেন, এই সরকার বিনা ভোটের সরকার। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সহযোগিতায় তারা দিনের ভোট রাতে করেছে। এখন সারা পৃথিবীর মানুষ সেটি জানে। ক’দিন আগে জাপানের রাষ্ট্রদূতও সেটি বলেছে; কিন্তু সরকারের কোনো লজ্জা নেই। তবে তাদের লজ্জা থাকুক আর না থাকুক আমাদের জনগণের ভোটে নির্বাচিত একটি জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক সরকার চাই। সে জন্য আমাদের আন্দোলন করতে হবে, এই সরকারকে বিদায় করতে হবে।
স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, আজ জনস্রোতে রাজশাহী শহরের সব অলি-গলি স্তব্ধ হয়ে গেছে। একটাই আওয়াজ উঠেছে- শেখ হাসিনার পদত্যাগ। কারণ এই সরকার দেশকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছে। তাই এই সমাবেশ থেকে মানুষ জানিয়ে দিচ্ছে তারা সরকার পতনের একদফা আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত। তারা এই সরকারকে লাল কার্ড দেখিয়ে দিয়েছে। স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিরা হামলা করায় মার্চ মাসে পুরো বাঙালি জাতি স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে ডিসেম্বরে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। আমরা যে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছিলাম আজ ৫০ বছর পর সেই গণতন্ত্রের জন্য আমাদের আবার যুদ্ধ করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, গত শুক্রবার বিমানবন্দর থেকে রাজশাহী শহরে যখন এসেছি তখন পুলিশ আমাদের গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞেস করেছে কোথায় যাচ্ছি? আমি বলেছি তোমরা যে ভোট রাতে চুরি করেছো আমরা তা ডাকাতি করে ফিরিয়ে আনতে যাচ্ছি। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করেছিলাম, এই বয়সে এখনো আবার যুদ্ধ করব গণতন্ত্রের জন্য।
এ সময় পুলিশের উদ্দেশে তিনি বলেন, যদি আওয়ামী লীগ করেন তাহলে সেটি করতে পারেন। আপনার গণতান্ত্রিক অধিকার। তবে সেটি করলে পোশাক খুলে করেন। তারপরে রাস্তায় আসুন। দেখি কারা জয়লাভ করে। কিন্তু আমার টাকায় আমার অস্ত্র দিয়ে হায়েনার মতো আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন না।
সকাল থেকেই সমাবেশস্থলে রাজশাহী নগরী ও জেলার বিভিন্ন ইউনিটের বিএনপি ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে সমাবেশের মাঠে আসে। মাঠ পরিপূর্ণ হয়ে গেলে আশপাশের রাস্তায় অবস্থান নেয় বিএনপি নেতাকর্মীরা। ফলে সমাবেশস্থল, পশ্চিমে সিঅ্যান্ডবি মোড়, লক্ষ্মীপুর, পূর্বে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর, সাহেব বাজার, সোনাদীঘি মোড়, দক্ষিণে পদ্মা নদীর পাড় ও উত্তরে ঘোষপাড়া মোড়সহ বিভিন্ন স্থান বিএনপি নেতাকর্মীদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে।
এ সময় বিএনপির নেতাকর্মীরা মিছিল থেকে সরকারবিরোধী বিক্ষুব্ধ স্লোগান দেন। তাদের হাতে দেখা যায় প্ল্যাকার্ড, ব্যানার, ধানের শীষ। অনেকে রঙিন গেঞ্জি ও ক্যাপ পরে দলীয় ও জাতীয় পতাকা নিয়ে শোভাযাত্রা করে জনসভাস্থলে পৌঁছেন।
সকাল থেকে গণসমাবেশে আসা নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করতে জাসাসের পক্ষ থেকে গান পরিবেশন করা হয়।
রাজশাহী মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট এরশাদ আলী ঈশার সভাপতিত্বে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের জন্য প্রতীকী চেয়ার রেখে গণসমাবেশে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়াও বক্তব্য রাখেন- বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনু, অ্যাডভোকেট কবির হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল, সাবেক সংসদ সদস্য সৈয়দা আসিফা আশরাফী পাপিয়া, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ শাহিন শওকত, সহ-প্রচার সম্পাদক আমিরুল ইসলাম খান আলীম, সহ-দফতর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু, ত্রাণ ও পুনর্বাসনবিষয়ক সহ-সম্পাদক শফিকুল হক মিলন, যুবদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, কৃষকদল সভাপতি হাসান জাফির তুহিন, মহিলাদল সভানেত্রী আফরোজা আব্বাস, ছাত্রদল সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েলসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা।
প্রসঙ্গত, বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে গত বৃহস্পতিবার থেকে রাজশাহী বিভাগে পরিবহন ধর্মঘট ডাকে পরিবহন মালিক সমিতি ও থ্রি-হুইলার মালিক সমিতি। পরিবহন ধর্মঘট ও নানান ধরনের প্রতিবন্ধকতা এড়াতে নির্ধারিত সময়ের আগেই বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে নেতাকর্মীরা এসে জড়ো হন রাজশাহীতে। সমাবেশস্থলের পাশেই ঈদগাহ মাঠে বিভিন্ন জেলা থেকে আগত নেতাকর্মীরা সামিয়ানা টানিয়ে অবস্থান করেন।
দ্রব্যমূল্য, লোডশেডিং, দুর্নীতি, লুটপাট, ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, বেগম খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে সাংগঠনিক বিভাগে ধারাবাহিক গণসমাবেশ করছে বিএনপি।
গত ৮ অক্টোবর চট্টগ্রামে প্রথম সমাবেশ হয়। এরপর ১৫ অক্টোবর ময়মনসিংহে, ২২ অক্টোবর খুলনায়, ২৯ অক্টোবর রংপুর, ৫ নভেম্বর বরিশালে, ১২ নভেম্বর ফরিদপুর, ১৯ নভেম্বর সিলেট, ২৬ নভেম্বর কুমিল্লøায় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় গণসমাবেশের মধ্য দিয়ে বিএনপির গণসমাবেশ- এই দফা কর্মসূচি শেষ হবে।
গণসমাবেশ স্থলে উপচে পড়ে জনস্রোত
রাজশাহী ব্যুরো জানায়, গতকাল শনিবার সকাল ৮টা। এরই মধ্যে রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদরাসা মাঠে (হাজী মুহম্মদ মুহসীন সরকারি উচ্চবিদ্যালয় মাঠ) লোকে লোকারণ্য। বেলা বাড়ার সাথে সাথে লোকসমাগমও বাড়তে থাকে। বেলা ১১টার মধ্যেই মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উপচে পড়ে জনস্রোত। মাঠে ঠাঁই না পেয়ে আশপাশের এলাকায় মানুষ ছড়িয়ে পড়ে।
সরকারের পদত্যাগ, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি, তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনা, জ্বালানি তেল-গ্যাস, বিদ্যুৎসহ নিত্যপণ্যের দাম কমানোর দাবিতে নানা ধরনের সেøাগান দিতে থাকেন নেতাকর্মীরা। গায়ে গেঞ্জি, হাতে জাতীয় ও দলীয় পতাকা, ব্যানার ও ফেস্টুন নিয়ে গণসমাবেশে যোগ দেন তারা।
৪৬ বছর আগে ১৯৭৬ সালের ১৬ মে মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে রাজশাহীর এই ঐতিহাসিক মাঠ থেকেই মারণ বাঁধ ফারাক্কা অভিমুখে লাখো জনতার লংমার্চ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই দিন মাদরাসা মাঠ থেকে লংমার্চ শুরু হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে গিয়ে শেষ হয়।
দেশব্যাপী ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে আগামী ১০ ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠেয় গণসমাবেশের আগে সর্বশেষ গণসমাবেশ ছিল রাজশাহীতে। বিএনপি নেতারা আগেই জানিয়েছিলেন, রাজশাহীর গণসমাবেশ হবে স্মরণকালের সর্ববৃহৎ। এতে ১৫ লাখ মানুষের সমাগম ঘটানো হবে।
গণসমাবেশে ব্যাপক লোকসমাগম ঠেকাতে গত বৃহস্পতিবার থেকে রাজশাহী বিভাগে অনির্দিষ্টকালের জন্য পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হয় বলে বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেন। তাই গত বুধবার সকাল থেকেই বিভাগের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে নেতাকর্মীরা রাজশাহীতে আসতে শুরু করেন। তারা রাজশাহীর আবাসিক হোটেল ও কমিউনিটি সেন্টারে থাকার সুযোগ না পেয়ে খোলা আকাশের নিচে রাত যাপন করেন। যারা যেভাবে পেরেছেন নিজেদের মতো করে অবস্থান নিয়ে থেকেছেন। পথে পথে পুলিশি বাধার কারণে অন্তত ১০ থেকে ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত হেঁটে গণসমাবেশে আসেন নেতাকর্মীরা। কিন্তু তার পরও তাদের মধ্যে যেন কোনো ক্ষোভ ও আক্ষেপ নেই। একে তো পরিবহন ধর্মঘট, তার ওপর নিজস্ব ও ভাড়া করা পরিবহনে বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্রবার দিন ও রাতে রাজশাহী আসার পথে বিভিন্ন স্থানে পুলিশি বাধায় তারা চরম ভোগান্তিতে পড়েন।
বিভিন্ন দূরবর্তী এলাকা থেকে বহু কষ্টে নেতাকর্মীরা রাজশাহী পৌঁছার পর শাহমখদুম ঈদগাহ মাঠ, পদ্মা নদীর ধারে ও নগরীর অন্যান্য ফাঁকা জায়গায় খোলা আকাশের নিচে রাত কাটান। এরই মধ্যে লাখ লাখ মানুষ খোলা আকাশের নিচে রাত কাটিয়েছেন বলে নেতারা দাবি করেছেন। কেউ কেউ না ঘুমিয়েই রাত পার করেছেন। চিঁড়া, মুড়ি খেয়ে অনেকে সকালের নাশতা সেরেছেন।
পথচারী ও উৎসুক মানুষের মন্তব্য ছিল- দল ও দলের নেতাকে কতটা ভালোবাসলে পুলিশি বাধা, ধর্মঘট ও নানা ভোগান্তি সত্ত্বেও গণসমাবেশে মানুষের এ ধরনের স্রোত নামে তা সত্যিই আশ্চর্যজনক। আগামীতে ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে রাজশাহীতে বিএনপির এই গণসমাবেশ।