হয়রানি, দুর্নীতির কেন্দ্র এনটিআরসিএ
পিয়াস সরকার।।
বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগে জটিলতা ও দুর্নীতি নিরসনে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা চালু করা করা হয় দেড় দশক আগে। আর এসব শিক্ষক নিয়োগের জন্য সরকার ২০০৫ সালে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু জটিলতা নিরসন উদ্দেশ্য হলেও জটিলতা আরও বাড়ছে। শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার পর নিয়োগের অপেক্ষার প্রহর গোনা, আন্দোলন, আদালতের শরণাপন্ন হওয়া এ যেন নিত্যদিনের ঘটনা। প্রতিষ্ঠানটি যেন দিনে দিনে হয়রানি ও দুর্নীতির কেন্দ্র হয়ে উঠছে।
দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য আবেদন একবার করতে হলেও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম এনটিআরসিএ। তাদের নিয়ম জটিলতায় কয়েকধাপে আবেদন করতে হয় প্রার্থীদের। চলতি বছরের জুনে এনটিআরসিএ কর্তৃক বৈধ সনদ পান মো. আশরাফুল ইসলাম। তিনি বলেন, প্রায় তিন বছর অপেক্ষা ও টেবিলে টেবিলে ঘুরতে হয়েছে। এমনকি করতে হয়েছে দলগত আন্দোলন। এরপর সনদ পাওয়ার পরও স্বস্তি মেলেনি আমাদের।
শূন্যপদ থাকা সাপেক্ষে করতে হয়েছে আবেদন। এরপর আমাকে প্রায় ৪০০ পদের জন্য আবেদন করতে হয়েছে। যাতে আমার খরচ হয়েছে প্রায় ৬০ হাজার টাকা। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন- আমাকে কেন আলাদা আবেদন করতে হবে। আমি সনদ দেখিয়ে আবেদন করবো, পছন্দক্রম দেবো এটাতো হওয়ার কথা।
আশরাফুলের মতো হাজারো প্রার্থীকে গুনতে হয়েছে হাজার হাজার টাকা। যাতে আকাশচুম্বী আয়ও হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। সর্বশেষ ৩৪ হাজার শিক্ষক নিয়োগের আগে এসব আবেদনের প্রেক্ষিতে এনটিআরসিএ আয় করে প্রায় ২০৩ কোটি টাকা।
এনটিআরনিএ’র নিয়মই যেন এক একটা ফাঁদ। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শূন্যপদের প্রেক্ষিতে নিয়োগের জন্য প্রিলিমিনারি, লিখিত, মৌখিক ও জাতীয় সম্মিলিত মেধা তালিকায় স্থান পেতে হয়। এরপর নিয়োগের জন্য গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের জন্য প্রার্থীদের কাছে আবেদন নেয়া হয়।
এরপর শেষ ধাপে মেধা তালিকার শীর্ষ সারি থেকে শূন্যপদে একজন শিক্ষককে সুপারিশ করা হয়। এসব ধাপে ভোগান্তি চরম মাত্রায় ঠেকেছে। এসব নিয়োগের ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি পর্যায়েই মামলার খড়গে আটকে গেছে প্রায় সকল সিদ্ধান্ত। বেকার চাকরি প্রত্যাশীদের আশা দেখিয়ে নিয়মের মারপ্যাঁচে আটকে রাখা হয়।
এনটিআরসিএ শিক্ষক হিসেবে নিবন্ধিত হওয়ার জন্য প্রথম ধাপে পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। সেখানে স্কুল বা কলেজ ক্যাটাগরিতে প্রার্থীরা আবেদন করেন। একটি আবেদনের খরচ ৩৫০ টাকা। আবার শিক্ষক হিসেবে চূড়ান্ত উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য প্রতিটি শূন্যপদের বিপরীতে আবেদন ফি-১০০ টাকা।
দিনাজপুরের রাজীব হাসান বর্তমানে শরীয়তপুরে কর্মরত আছেন। তিনি বলেন, আমি পূর্বে একটি কিন্ডার গার্টেনে চাকরি করতাম। করোনার সময় চাকরিটা চলে যায়। এরপর আমি কাঠের দোকানে ও সবজি দোকানে কাজ করে কোনো রকম সংসার চালাই। এরপর সনদ পাওয়ার পর আমাকে ৮১ হাজার টাকার আবেদন করতে হয়েছে। আমি ৫০ হাজার টাকায় একটা জমি বন্ধক রাখি। আরও ২০ হাজার টাকা ধার করি। যোগদানের পরপরই আমার একটা মেয়ে হয়। ঋণের বোঝা আমাকে এখনো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। আবার এসব নিয়োগ প্রত্যাশীদের নিয়মের জটিলতা ব্যাপক। ১৫তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার সময় আগের আবেদকারীরা ও উত্তীর্ণ প্রার্থীরা নিয়োগের সুপারিশ চেয়ে আদালত পাড়ায় যান।
আদালতের সিদ্ধান্তে ২০১৮ সালে প্রকাশিত দ্বিতীয় গণবিজ্ঞপ্ততিতে ৪০ হাজার শিক্ষক পদে নিয়োগ দেয় এনটিআরসিএ। এরপর বিভিন্ন ব্যাচের চাকরি প্রত্যাশীরা আদালতের দ্বারস্থ হন। এনিয়ে ১৬৬টি রিট হয়। এমনকি এসব নিষ্পপ্তি হওয়ার পরও ১৩তম নিবন্ধনধারীদের নিয়ে দুইরকম আদেশ আশায় সেটি নিয়েও ধোঁয়াশা তৈরি হয়। শুধু এটি নয়, জটিলতা ছিল ২০১৮ সালে নিয়োগ পাওয়া প্রার্থীরা ছিলেন ২০১৫ সালে সনদধারী। ফলে পিছিয়ে থাকায় দ্বিতীয় এবং তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে তারা শত শত বিদ্যালয়ের শূন্য পদে আবেদন করেও চাকরির সুপারিশ পাননি। কিন্তু প্রত্যেকে অনেক অর্থ ব্যয় করেছেন। বেঁধে দেয়া ছিল না কোনো বয়সের সীমাও।
তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তি প্রত্যাশীরা আরও কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে সময় পার করেন। তারা পরীক্ষার উত্তীর্ণ হওয়ার পর দেশে করোনার স্থবিরতা চলে আসে। এ সময়টায় তারা দীর্ঘ সময় আন্দোলন করেন। শুধু তাই নয়, এই নিয়োগ প্রক্রিয়া এতোটাই জটিল যে, কোনো কোনো পক্ষকে আন্দোলনের মাঝেই থাকতে হয়। সর্বশেষ প্রায় ১০০ দিনের মতো অনশন করেছেন নিবন্ধনধারীরা। এমনকি ঈদের দিনও তারা সড়কে কাটিয়েছেন। তাদের দাবি প্যানেল ভিত্তিতে প্রথম নিবন্ধনধারীদের অগ্রাধিকার দিয়ে ক্রমান্বয়ে সকলকে নিয়োগ দেয়া। আবার এই ৩৪ হাজার শিক্ষকের মধ্যে প্রায় ২০ হাজার ইনডেক্সধারী আবেদন করেন।
ফলে এতে নতুন ঝামেলা দেখা দেয়। এসব শিক্ষক নতুন প্রতিষ্ঠানে যোগ দিলে আগের প্রতিষ্ঠানে খালি হচ্ছে শিক্ষক। আর আবেদনের পর যোগ না দেয়ায় নতুন সৃষ্ট প্রতিষ্ঠানেও শিক্ষক সংকট থেকেই যাচ্ছে। নতুন ইনডেক্সধারীদের জন্য আলাদা গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের কথা একাধিকবার বলা হলেও তা এখানেই সীমাবদ্ধ।
নিয়মের মারপ্যাঁচের বাইরেও আছে প্রতিষ্ঠানটির দুর্নীতি। সম্প্রতি এনটিআরসিএন’র একটি গাড়িচালকের দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ হয়। এরপর সনদ বাণিজ্য নিয়ে কথা বলেন একাধিক নিয়োগ পাওয়া ও নিয়োগ প্রত্যাশী শিক্ষক। মাগুরায় নিয়োগ পাওয়া এক শিক্ষক বলেন, সনদেই মূলত প্রধান বাণিজ্য হয় তাদের। ২০২০ সালে সনদের আবেদন রিজেক্ট হয় আমার। সনদ পাইয়ে দেয়ার জন্য কয়েক শ্রেণির দালাল থাকে। তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতো। তারা সর্বনিম্ন্ন এক লাখ টাকা থেকে শুরু করে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত রাখতো।
এনটিআরসিএ’র বাইরে ক’জন দালালের সঙ্গে কথা হয়। রফিক, সবুজ নিজেদের এনটিআরসিএ’র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে বলে জানাতেন। এই শিক্ষকের মাধ্যমে সনদ নেয়া আরেকজন মহিলা শিক্ষিকার কথা জানা যায়। এই শিক্ষিকাকে ফোন দেয়া হলে তিনি জানান, আমার সনদে ম্যানেজিং কমিটির এডহক কমিটির স্বাক্ষর ছিল না। আমি চেষ্টা করেও তা জোগাড় করতে পারছিলাম না। এরপর সবুজ নামে একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি আমাদের তিন লাখ টাকার বিনিময়ে সহজে পাইয়ে দেন।
আবার এনটিআরসিএ’তে অর্থের বিনিময়ে প্রাপ্ত নম্বর বাড়িয়ে নেয়ার অভিযোগের কথাও জানা যায়। অভিযোগ আছে অর্থের বিনিময়ে জাল সনদ পাইয়ে দেয়ারও। আবার এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে চাকরি পাইয়ে দেয়ার সুপারিশেরও অভিযোগ পাওয়া যায়। আরেকজন নিয়োগ প্রত্যাশী একটি কলরেকর্ড পাঠান। সবুজের সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, এতো অধৈর্য্য কেন আপনি আগে বিজ্ঞপ্তি হোক তারপর যোগাযোগ করিয়েন। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে এনটিআরসিএ চেয়ারম্যান এনামুল কাদের খান বলেন, অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্তের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এসব নানা কারণে ও নিয়োগপ্রাপ্তদের হয়রানি রোধে এনটিআরসিএ তুলে দিতে মত দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সিদ্ধান্ত মতে, সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) আদলে বেসরকারি শিক্ষকদের নিয়োগ দিতে নতুন কমিশন গঠন করা হবে। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি খসড়া আইন তৈরির নির্দেশ দিয়েছে। এনটিআরসিএ বিলুপ্ত করে বেসরকারি শিক্ষক নির্বাচন কমিশন (এনটিএসসি) গড়ে তোলা হবে।
বর্তমান কাঠামোর আদলেই জনপ্রশাসনের একজন অতিরিক্ত সচিবকে চেয়ারম্যান ও পাঁচজন যুগ্ম সচিবকে সদস্য করে এনটিএসসি গঠিত হবে। এ কমিশন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিয়োগের জন্য যোগ্য প্রার্থী বাছাই করে তাদের চাকরির সুপারিশ করবে। সে ক্ষেত্রে আর শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা আয়োজন করা হবে না। সারা দেশ থেকে শূন্য আসনের তালিকা সংগ্রহ করে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা আয়োজন করবে এনটিএসসি। পিএসসি’র আদলে যোগ্য প্রার্থীদের শূন্য আসনে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করবে তারা।
এনটিআরসিএ চেয়ারম্যান বলেন, আমরা এনটিআরসি’কে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছি। এজন্য বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হচ্ছে। আমরা সবকিছুই পিএসসি’র আদলে করি। তবুও অনেক শিক্ষক যোগদান করতে পারেন না। আবার প্রতিষ্ঠানগুলোর ভুল চাহিদার কারণে অনেকের এমপিও হচ্ছে না। আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি খসড়া পাঠিয়েছি। তিনি আরও বলেন, যেহেতু নতুন এমিপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অর্থের একটি বড় অংশ রাজস্ব খাত থেকে দেয়া হয়। সেজন্য এই প্রক্রিয়া সহজ করা দরকার। এজন্য আমরা বর্তমান আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছি।