হোমিওতে ডিপ্লোমা পাশেই মেডিকেল কলেজের সনদ!
বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক বোর্ডের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত দেশের ৬৩টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ডিপ্লোমা কারিকুলাম পড়ানো হয়।
যে কোনো বিভাগে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে বয়সের তারতম্য ছাড়াই যে কেউ এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারেন। এক্ষেত্রে ডিপ্লোমা পাঠ্যক্রমে উত্তীর্ণদের দেওয়া হয় মেডিকেল কলেজের সনদ।
ফলে তারা প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ছাড়াই শহর ও গ্রামাঞ্চলে চেম্বার খুলে চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। এ নিয়ে অ্যালোপ্যাথিতে এমবিবিএস এবং সরকারি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ থেকে ৫ বছর মেয়াদি ‘ব্যাচেলর অব হোমিওপ্যাথিক মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি’ (বিএইচএমএস) সম্পন্ন চিকিৎসকরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
তাদের অভিযোগ-দেশে অন্য ডিপ্লোমা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ইনস্টিটিউট হিসাবে পরিচিত হলেও হোমিওপ্যাথির ক্ষেত্রে মেডিকেল কলেজ নামকরণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথি বোর্ডের নীতিমালায় ডিপ্লোমা কলেজ লেখা হলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ হিসাবে অনুমোদন দিচ্ছে। পাঠদান কোর্সের নাম ‘ডিপ্লোমা ইন হোমিও মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি’ হলেও এসব প্রতিষ্ঠানে সার্জারি বিষয়ে হাতে-কলমে শিক্ষার সুযোগ নেই।
মেডিকেল কলেজ নামকরণ হলেও হাসপাতাল না থাকায় রোগী ভর্তি করা হয় না। দু-একটি প্রতিষ্ঠানে রোগীদের রোগ নির্ণয়ে নামসর্বস্ব ল্যাব থাকলেও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই। অর্গানোগ্রামে সার্জারি, গাইনি ও প্যাথলজি বিষয়ে শিক্ষকের পদ থাকলেও অনেক প্রতিষ্ঠানে এসব পদ শূন্য রয়েছে।
সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের (চিকিৎসা শিক্ষা শাখা) বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেসরকারি পর্যায়ে হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ (ডিপ্লোমা) স্থাপনে হোমিওপ্যাথিক বোর্ডের একটি নীতিমালা রয়েছে।
নীতিমালার ১০নং ধারায় বলা হয়েছে, ডিপ্লোমা কলেজে উপযুক্তভাবে সজ্জিত গবেষণাগার ও বহির্বিভাগীয় চিকিৎসা কেন্দ্র থাকবে। শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নশিপের জন্য কমপক্ষে ১০ শয্যার ইনডোর (হাসপাতাল) ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রত্যেক বিষয়ের জন্য পর্যাপ্ত বই সংবলিত গ্রন্থাগার এবং ল্যাবরেটরিতে ব্যবহারিক শিক্ষা ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরাঞ্জাম থাকতে হবে।
কিন্তু সরেজমিন দেখা গেছে, বেসরকারি হোমিও ডিপ্লোমা কলেজে রোগী ভর্তির ব্যবস্থা এবং গবেষণাগার নেই। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হওয়ার প্রাথমিক শর্ত হলো- প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা, আলট্রাসনোগ্রাম, ইসিজি, রক্ত পরীক্ষা, নেবুলাইজার, স্টেরিলাইজার, মাইক্রোস্কোপ, টেস্ট টিউব, টিউব হোল্ডার, জার, উচ্চ রক্তচাপ যন্ত্রের মতো উপকরণ থাকা বাধ্যতামূলক। নীতিমালা অনুযায়ী কলেজ পরিচালিত হচ্ছে কিনা তা তদারকিতে মন্ত্রণালয় ও হোমিও বোর্ডের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে টিম থাকবে। টিম প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শন করবে। কিন্তু সেখানে এসবের কিছুই হচ্ছে না।
সরকারি হোমিও মেডিকেল কলেজ ও বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করা একাধিক চিকিৎসক বলেন, ডিএইচএমএস পাঠদানের জন্য ডিপ্লোমা কলেজ হলেও কৌশলে এটার নাম বেসরকারি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ হিসাবে অনুমোদন নেওয়া হয়ে থাকে। অথচ অনেক কলেজের স্থাপনা বা অবকাঠামো নাই। শুধু খাতা-কলমে শিক্ষার্থী ভর্তি থাকে। যারা শুধু পরীক্ষা দিয়ে থাকেন। কোর্স করার ক্ষেত্রে বয়সের বাধ্যবাধ্যকতা না থাকায় যে কোনো বয়সে ভর্তি হয়ে ডাক্তার হওয়া যায়। যা চিকিৎসা শাস্ত্রের মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
সরকারি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক সহকারী অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ও লজ্জাকর যে যেসব প্রতিষ্ঠানে হোমিওপ্যাথিক ডিপ্লোমা দেওয়া হয় সেখানে ভর্তির বয়সসীমা নেই। যে কোনো বিভাগ থেকে এসএসসি পাশ করেই ভর্তি হওয়া যায়। এ কারণে শিক্ষার মান বজায় থাকে না। তবে আশার কথা হলো সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ অনুমোদিত হোমিওপ্যাথিক আইনে ডিপ্লোমা চিকিৎসার মানোন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে হোমিও বোর্ডকে বয়সসীমা নির্ধারণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত মানোন্নয়নে তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। শিক্ষার দিক থেকেও বোর্ডের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে ভর্তির বয়সসীমা ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত বিজ্ঞান বিভাগ বাধ্যতামূলক করা দরকার। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শেখার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে হাসপাতাল সুবিধা ও কারিকুলামের আধুনিকায়ন জরুরি।
হোমিও চিকিৎসকরা আরও বলেন, দেশে একটি সরকারি ও একটি বেসরকারি গ্র্যাজুয়েশন (সম্মান) হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ রয়েছে। রোগীদের চিকিৎসাদানে সরকারি হোমিও কলেজে ১০০ শয্যাবিশিষ্ট একটি হাসপাতালে রয়েছে। ইনডোর সার্ভিস বিভাগে গাইনি অ্যান্ড অবস, মহিলা, শিশু, পুরুষ, মেডিসিন ও সার্জারি ওয়ার্ডে জটিল ও পুরোনো রোগে আক্রান্তদের ভর্তির সুযোগ রয়েছে। প্রতিদিন বহির্বিভাগে গাইনি, শিশু, পুরুষ রোগীদের সেবা ছাড়াও জরুরি বিভাগে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। রোগ শনাক্তে হাসপাতালের নিজস্ব ল্যাব ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। সেখানে আলট্রাসনোগ্রাম, ইসিজি ও এক্সরেসহ প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সারা দেশে ৬৩টি বেসরকারি ডিপ্লোমা হোমিও কলেজ নামধারী প্রতিষ্ঠানে এসবের কিছুই নেই। ফলে সেখান থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীরা ডাক্তার পদবি ব্যবহার করে রোগী সেবা দিলে ভুল চিকিৎসা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
হোমিওপ্যাথিক বোর্ডের চেয়ারম্যান ডা. দিলীপ কুমার রায় বলেন, এ চিকিৎসা সেবাটি যুগ যুগ ধরে চললেও এর তেমন উন্নয়ন হয়নি। যদিও দেশের ৪০ শতাংশ মানুষ হোমিও সেবা নেন। আরেকটি বিষয় হলো-হোমিওপ্যাথি অ্যাক্ট, অর্ডিন্যাস ও রেগুলেশনে ডিপ্লোমা নয়, বরং হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল লেখা রয়েছে। সব কলেজে হাসপাতালে ইনডোর ও আউটডোর থাকার কথা। কিন্তু অনেক জায়গায় বেড থাকলেও রোগী ভর্তির ব্যবস্থা নেই। এ ব্যাপারে একটি আইন সম্প্রতি কেবিনেটে পাশ হয়েছে। পাশাপাশি ডিপ্লোমা কলেজের পরিবর্তে হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ নামকরণে আইন সচিবের সঙ্গে সভা হয়েছে। ডিপ্লোমা প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যায়ক্রমে ডিগ্রি সমমানের হলে হোমিও মেডিকেল কলেজ হবে। সেখানে বিএইচএমএস ও ডিএইচএমএস দুটোই পড়ানো হবে। কিন্তু বাজেট বরাদ্দ কম থাকায় মানোন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. এনায়েত হোসেন বলেন, চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠাগুলো দেখভাল করতে কিছুদিন হলো স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর যাত্রা শুরু করেছে। অধিদপ্তর খোঁজা নিয়ে জানতে পেরেছে হোমিওসহ অন্যান্য দেশজ চিকিৎসা শিক্ষা অনেকটা বিশৃঙ্খল অবস্থায় চলছে। তবে অল্টারনেটিভ মেডিকেল কেয়ারের শাখায় হোমিওপ্যাথি বোর্ডের ব্যাপারে নতুন একটা আইন হচ্ছে। আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিং হয়েছে। এটা হয়ে গেলে রেগুলেশন অনুযায়ী নজরদারিতে আনা হবে। হোমিও চিকিৎসা শিক্ষার মনোন্নয়নের চেষ্টা করা হবে। তখন ডিপ্লোমা কারিকুলাম ও প্রতিষ্ঠান পরিচালনার বিষয়ে নজরদারি বাড়ানো সম্ভব হবে।
হাবিপ্রবিতে শুরু হলো সশরীরে প্রাকটিক্যাল ক্লাস : দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, দীর্ঘ ১৯ মাস বন্ধ থাকার পর শুরু হলো দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (হাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীদের সশরীরে ক্লাস। প্রথম দিন প্রাকটিক্যাল ক্লাস হয়েছে। এর আগে গত ১৮ অক্টোবর থেকে ধাপে ধাপে খুলে দেয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো।
হাবিপ্রবির জনসংযোগ ও প্রকাশনা শাখার পরিচালক প্রফেসর ড. শ্রীপতি সিকদার জানান, বৃহস্পতিবার প্রাকটিক্যাল ক্লাসসমূহ শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে শুরু হয়েছে। তিনি জানান, গুচ্ছ পদ্ধতিতে ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার জন্য ইতিমধ্যেই বিভিন্ন ভবনে এমনকি বিভিন্ন প্রাকটিক্যাল ক্লাসরুমগুলোতেও ভর্তি পরীক্ষার সিট বসানো হয়েছে। গত ১৭ অক্টোবর বিজ্ঞান (এ) ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা হয়।
আগামী ২৪ অক্টোবর বাণিজ্য (বি) এবং আগামী ১ নভেম্বর মানবিক (সি) ইউনিটের পরীক্ষা রয়েছে। যেসব কক্ষে সিট বসানো হয়েছে সেসব কক্ষে প্রাকটিক্যাল ক্লাসও শুরু হয়নি। ভর্তি পরীক্ষা শেষ হলেই যথারীতি সশরীরে সব ক্লাস শুরু হবে বলে তিনি জানান। তিনি জানান, একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত হচ্ছে- আপাতত শিক্ষার্থীদের থিওরি ক্লাসগুলো চলবে অনলাইনে এবং প্রাকটিক্যাল ক্লাসসমূহ সশরীরে অনুষ্ঠিত হবে।সূত্র:যুগান্তর