হেমন্ত জানান দিচ্ছে শীতের আগমনী বার্তা
মুনতাহা ইসলাম।।
প্রভাতের সোনা রোদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে হেমন্তের। ঘাসের ডগা আর ধান শীষে জমাট বাঁধা স্নিগ্ধ শিশির ঝলমল করছে রোদের আলোয়। কুয়াশার চাদরে ঢাকা পথ-ঘাট, বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। গ্রামীণ জনপদে ঢেলে দেয়া হেমন্তের সৌন্দর্য উপভোগের সময় নেই খেটে খাওয়া মানুষের ভাগ্যে। উত্তরের কাঁপুনি ধরা শীতের আগমনী বার্তা যেন বাড়িয়ে দিচ্ছে তাদের দুশ্চিন্তা।
কার্তিক ও অগ্রহায়ণ এ দু’মাস হেমন্ত কাল। ষড়ঋতুর মধ্যে হেমন্ত ৪র্থ ঋতু। হেমন্তকে বলা হয় শীতের পূর্বাভাস। কৃত্তিকা ও আর্দ্রা এ দুটি তারার নাম অনুসারে নাম রাখা হয়েছে কার্তিক। ‘অগ্র’ ও ‘হায়ণ’ অংশের অর্থ যথাক্রমে ‘ধান’ ও ‘কাটার মওসুম’। সম্রাট আকবর অগ্রহায়ণ মাসকেই বছরের প্রথম মাস বা খাজনা তোলার মাস ঘোষণা দিয়েছিলেন।
বর্ষকালে লাগানো আগাম আমন ধানে পাক ধরেছে। ধানের গোছায় কাঁচি ধরতে শুরু করেছেন চাষিরা। কিন্তু হেমন্তের উৎসব আর ছুঁয়ে যায় না কৃষকের হৃদয়।
ফসলের মাঠ সেজেছে নতুন সাজে। দিগন্ত বিস্তৃত মাঠজুড়ে পাকা ধানের সোনালী আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে আলো। দখিনা বাতাস দোলা দিয়ে যাচ্ছে ধানের শীষে। এসময় ফসল ঘরে তুলতে বেড়ে যায় চাষীদের ব্যস্ততা।
হেমন্তের ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই নবান্ন উৎসবের সূচনা হয়। নবান্ন অর্থ নতুন ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব, যা সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর অনুষ্ঠিত হয়।
নগর থেকে দূরে গ্রামে বা মফস্বল শহরে সকাল বা রাতে ঘাসের ডগায় জায়গা করে শিশির বিন্দু। চোখের সামনে ধরা দেয় কুয়াশা।
শিশির বিন্দু ঝরার টুপটাপ শব্দ আর মৃদু শীতলতা জানান দিচ্ছে ঋতু পরিবর্তনের খবর। শিশিরস্নাত সকাল, কাঁচাসোনা রোদমাখা স্নিগ্ধসৌম্য দুপুর, পাখির কলকাকলি ভরা ভেজা সন্ধ্যা আর মেঘমুক্ত আকাশে জোছনা ডুবানো আলোকিত রাত হেমন্তকালকে যেন আরও রহস্যময় করে তোলে সবার চোখে; প্রকৃতিতে এনে দেয় ভিন্নমাত্রা। হেমন্তের এ মৌনতাকে ছাপিয়ে বাংলার মানুষের জীবনে নবান্ন প্রবেশ করে জাগরণের গান হয়ে, মানুষের জীবনে এনে দেয় সর্বজনীন উৎসবের ছোঁয়া।
হেমন্তকে বলা হয় বিচিত্র রঙের ঋতু। হেমন্তের শিশিরঝরা নিশিতে ফোটে গন্ধরাজ, মল্লিকা, শিউলি আর কামিনী। হেমন্তেই দীঘির জলে, বিলে, ঝিলে ফোটে কত না রঙের পদ্ম। হেমন্তের চরিত্র আর তার বাইরের রূপ নিয়ে জগৎজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে শত শত গল্প, শিল্প, গান ও কবিতা।
অসাধারণ সৌন্দর্যচেতনায় ভাবুক হৃদয়ের বিলাসিতায় এ ঋতুকে নিজের প্রিয়তমাৎরূপে কল্পনা করেছিলেন বিখ্যাত ইংরেজ কবি জর্জ এলিয়ট। বলেছিলেন, ‘হে অপরূপা সুন্দরী ঋতু হেমন্ত/তোমার সঙ্গে আমার অন্তরাত্মা এখন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ/যদি ডানাওয়ালা পাখির মতো পৃথিবীজুড়ে উড়ে বেড়াতে পারতাম/তোমার মনোলোভা রূপের এ সৌন্দর্যের বিস্তারে, তাহলে উপভোগ করতাম সর্বত্র।’
কাজী নজরুল ইসলাম হেমন্ত নিয়ে কবিতা লিখেছেন, ‘চাঁদের প্রদীপ জ্বালাইয়া নিশি জাগিছে একা নিশীথ/নতুনের পথ চেয়ে চেয়ে হলো হরিত পাতারা পীত।’
নবান্ন মানেই চারদিকে পাকা ধানের ম-ম গন্ধ, নতুন অন্ন, গ্রামের মাঠে মাঠে চলে ধান কাটার ধুম, হেমন্তে এ ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই ঘরে ঘরে শুরু হয় নবান্ন উৎসব। গৃহস্থবাড়িতে নতুন ধানে তৈরি পিঠাপুলির সুগন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। বর্ষার শেষ দিকে বোনা আমন-আউশ শরতে বেড়ে ওঠে। আর হেমন্তের প্রথম মাস কার্তিকে ধান পরিপক্ব হয়। হেমন্তের ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই নবান্ন উৎসবের সূচনা।