হার না মানা অদম্য তপু
শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ ইসমাইল রহমান তপু। বয়স ২৭। জন্মের পর থেকে দুপায়ে ভর করে হাঁটতে পারে না। স্বাভাবিক নয়, তার হাতও। তবে অদম্য ইচ্ছাশক্তি তার সব শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে এ বছর দিয়েছেন মাস্টার্স পরীক্ষা, অংশগ্রহণ করেছেন এবারের বিসিএস পরীক্ষায়ও। অদম্য ইচ্ছাশক্তির উপর ভর করে স্বপ্ন দেখেন ফ্রিল্যান্সার হয়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবেন। হাল ধরবেন পরিবারের।
ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার কলাকোপা ইউনিয়নের পশ্চিম সমসাবাদ গ্রামের বাবুল হোসেন ও ইয়াসমিন দম্পত্তির ছেলে ইসমাইল রহমান তপু। তিন সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় সে। ১৯৯৬ সালে জন্মের পর থেকে পরিবারের সদস্যরা ভেবেছিলেন অন্য দশজনের মতো তপুও স্বাভাবিক। কিন্তু জন্মের ১৩ মাসেও হাঁটতে না পারায় দুশ্চিন্তায় পড়েন বাবা-মা।
চিকিৎসকরা জানান, কখনো হাঁটতে পারবে না তপু। তখন সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েন পরিবারের সদস্যরা। প্রবাসের চাকরি ছেড়ে তখন ছেলের জন্য দেশে এসে পড়েন বাবুল হোসেন। ছেলেকে নিয়ে শুরু হয় জীবন সংগ্রামের নতুন এক অধ্যায়।
তপুর বাবা বাবুল হোসেন বলেন, ছোটবেলা থেকেই পড়াশুনার প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহী ছিল আমার ছেলের। আমি ওর কারণে বাহারাইনের ভালো চাকরি ছেড়ে দেশে চলে আসি। আমার ও ওর মায়ের কোলে চড়ে স্কুলে যাতায়াত শুরু হয় তপুর। রোদ, বৃষ্টি, ঝড় কোনো কিছুই তাকে স্কুল থেকে দূরে রাখতে পারেনি। পিঠে বইখাতার ব্যাগ আর দুহাতে ছেলেকে তুলে এভাবেই ২৩ বছর ধরে ছুটে চলছি স্কুল-কলেজে।
তিনি আরও বলেন, বাড়ি থেকে স্কুল বা কলেজ যেখানেই গিয়েছি পুরোটা রাস্তা কোলে রাখতে হয় ওকে। ক্লাসরুম চারতলা-পাঁচতলা হওয়ায় সেখানেও সিঁড়ি বেয়ে উঠেছি ওকে দুহাতে তুলে। অনেক সময় তপু বলতো, বাবা আমাকে নামিয়ে একটু রেষ্ট নাও, কখনো ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে আবার ছুটে চলি ক্লাসের দিকে। আবার ক্লাস বা পরীক্ষা শেষ হলে কোলে নিয়ে ছুটে চলি বাড়ির দিকে।
বাবুল হোসেন জানান, ২০১২ সালে তপু নবাবগঞ্জ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ২০১৪ সালে সরকারি দোহার-নবাবগঞ্জ কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন এবং একই কলেজ থেকে ২০২০ সালে অনার্স শেষ করে বর্তমানে মানিকগঞ্জের সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ থেকে মাস্টার্সে পরীক্ষা দিয়েছেন। অংশগ্রহণ করেছেন এবারের বিএসএস পরীক্ষায়ও।
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রতিবন্ধীদের জন্য রাষ্ট্র নাকি অনেক সুবিধা দেন, আমার ছেলে আজ পর্যন্ত কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন বা ভর্তি ফিসহ কোনো কিছুতে সুবিধা পায়নি। আমরা ছেলে ফ্রিল্যান্সার হতে চায়। এজন্য অনেকদিন ধরে একটি ল্যাপটপের কথা বলছে, সেটিও কিনে দিতে পারি না। অথচ সরকার বিনামূল্যে কত প্রতিষ্ঠানে বা ব্যক্তিদের অসংখ্য ল্যাপটপ দিচ্ছেন, আমার ছেলে কি একটি ল্যাপটপ পাওয়ারও যোগ্য নন?
তপুর মা ইয়াসমিন বাবুল বলেন, আমার তিনটা ছেলে-মেয়েই মেধাবী। বড় ছেলে গণিতে অনার্স-মাস্টার্স করে চাকরির জন্য ঘুরেছে দীর্ঘদিন! পায়নি। এখন বাবার দোকানে বসে। ছোট মেয়েটা এইচএসসিতে ভালো রেজাল্ট করেছে। আর মেঝো ছেলে তপু। ও সবকটি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করেছে। ও এখন মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজে পড়ে। বাড়ি থেকে যেতে প্রতিদিন সিএনজিতে দুঘণ্টা করে সময় লাগে। ছেলের আগ্রহের কারণে ধার-দেনা করে হলেও আমরা ওর পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছি।
কথা হয় তপুর সঙ্গেও। মুখে অনেকটা জড়তা আছে। সবকথা স্পষ্ট বুঝাও যায় না। দুপা একেবারেই অকেজো, শক্তি পান না দুহাতেও। হাতের আঙুলগুলোও চিকন হয়ে যাচ্ছে ক্রমেই। কিন্তু এখনো জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে লেখাপড়ার গুরুত্ব অনুধাবন করেন। স্বপ্ন দেখেন ফ্রিল্যান্সার হয়ে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার।
কলাকোপা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইব্রাহিম খলিল বলেন, আমি তপুর অবস্থা জানার পর আমার পরিষদের পক্ষ থেকে একটি হুইলচেয়ার উপহার দিয়েছি। বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা যেখানে লেখাপড়ার প্রতি অনাগ্রহ সেখানে তপু আমাদের সমাজে দৃষ্টান্ত। তপুর পাশে সকলের দাঁড়ানো উচিত।
নবাবগঞ্জ উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, ইতিমধ্যে আমরা একটি প্রতিবন্ধী ভাতা কার্ডের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। আরও কোনো ধরনের সহযোগিতা করা যায় কি না আমরা বিষয়টি ভেবে দেখব। প্রতিবন্ধীতাকে জয় করে অদম্য তপুর এমন এগিয়ে চলা বর্তমান শিক্ষার্থীদের জন্য অনুকরনীয় ও অনুস্বরনীয় দৃষ্টান্ত বলে মনে করি।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০২/০৪/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়