হাফিজুরের মৃত্যু ঘিরে রহস্য
নিউজ ডেস্ক।।
নিখোঁজের ৯ দিন পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে শনাক্ত হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমানের মৃত্যু নিয়ে নানা প্রশ্ন সামনে আসছে। পুলিশ প্রাথমিকভাবে হাফিজুরের মৃত্যুকে আত্মহত্যা বললেও পরিবার ও সহপাঠীরা তা মানতে নারাজ।
তাদের দাবি হাফিজুরকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় তারা সুষ্ঠু তদন্তের দাবি করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও একই দাবি জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। যদিও শিক্ষার্থী হত্যার দায় ভিসি-প্রক্টর এড়াতে পারেন না মন্তব্য করে তাদের পদত্যাগ দাবি করেছেন হাফিজুরের সহপাঠী ও বন্ধুরা। হাফিজুরের মৃত্যু পরবর্তী পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে ছাত্রলীগসহ ছাত্র সংগঠনগুলো। তারাও ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেছে।
এদিকে হাফিজুরের মৃত্যু বিষয়ে শাহবাগ খানার ওসি মামুন অর রশিদ বলেন, কয়েকদিন আগে আমরা তাকে বহির্বিভাগের গেইটের সামনে গলাকাটা অবস্থায় উদ্ধার করি। রক্তাক্ত অবস্থায় দৌড়াদৌড়ি করছিল। খবর পেয়ে পুলিশ লোকজনের সহায়তায় রিকশায় করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় রিকশা থেকে লাফ দেয়। এরপর তাকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়।
কিন্তু সে চিকিৎসা নিতে অস্বীকৃতি জানায়। তার জন্য আমরা রক্তও ম্যানেজ করেছিলাম। অবস্থা খারাপ দেখে তাকে ওটিতেও নেয়া হয়। কিন্তু রাত সোয়া ১০টার দিকে সে মারা যায়। এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় আমাদের একজন এসআই একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করেছিলেন। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা জানতে পেরেছি সে আত্মহত্যা করেছে। তবুও তার পরিবার দাবি করলে বিষয়টি আমরা গভীর তদন্ত করবো। অন্যদিকে ঢাবি প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী বলেন, আমরা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করছি। এ ঘটনায় আমরা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সবাই মর্মাহত।
‘ঘটনাটি ক্যাম্পাসে হওয়ায় অনেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দায় দিচ্ছে’- এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রক্টর বলেন, ক্যাম্পাস থেকে একজন শিক্ষার্থীর এমন ঘটনা সবার জন্য কষ্টকর। তাদের কষ্টের অনুভূতি তারা বলছে। বিশ্ববিদ্যালয় তো এখন বন্ধ, আর পরিবারের পক্ষ থেকে আমাদের জানানো হয়নি। জানার পরেই আমরা খোঁজখবর নিয়েছি। পুলিশ কেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানায়নি? এমন প্রশ্নের জবাবে প্রক্টর বলেন, আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংক্রান্ত কিছু জানতে পারলে পুলিশ সহজে জানায়। তাদের ভাষ্যমতে, তারা চিহ্নিত করতে পারেনি। তবে এখন এটির সুষ্ঠু তদন্ত প্রয়োজন।
প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য: এদিকে প্রত্যক্ষদর্শী ডাব বিক্রেতা আনোয়ার হোসেন বলেন, হঠাৎ একজন লোক আমার দা টেনে নিয়ে নিজের গলায় ধরে। আমি ভাবছি সে ভয় দেখায়, পরে দেখি রক্ত বের হচ্ছে। আর বলতে থাকে ‘আমাকে মাফ করে দাও’, ‘আমাকে মাফ করে দাও’। তারপর সে শহীদ মিনারের দিকে দৌড় দেয়। ঘটনাটি গত ১৫ই মে রাত ৮টার দিকে ঘটে। তার পরনে ছিল একটা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট আর খালি গা।
হাফিজুর আত্মহত্যা করতে পারে না-বড় ভাই: এদিকে পুলিশ প্রাথমিকভাবে এটি আত্মহত্যা ধারণা করলেও হাফিজুরের বড় ভাই মাসুম তা মানতে নারাজ। তিনি বলেন, এটি আত্মহত্যা হতে পারে না। ও যেকোনো মানসিক সমস্যা কিংবা মদ্যপ অবস্থায় ছিল এটা আমরা বিশ্বাস করতে পারছি না। পরিবারের সঙ্গে সুন্দরভাবে ঈদ উদ্যাপন করে ক্যাম্পাসে গিয়েছে। এটা আত্মহত্যা হতে পারে না। সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করে মাসুম বলেন, যে আমার ভাইকে হত্যা করুক না কেন, সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচার চাই।
ভিসির শোক প্রকাশ, সুষ্ঠু তদন্তের দাবি: এদিকে হাফিজুর রহমানের অস্বাভাবিক মৃত্যুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তর থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়, ভিসি মরহুমের রুহের মাগফেরাত কামনা এবং তার পরিবারের শোকসন্তপ্ত সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।
তিনি হাফিজুর রহমানের এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর বিষয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তদন্ত করে একটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট প্রদানের জন্য সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন। এতদবিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তিনি ডিএমপি কমিশনারকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেছেন। এ ছাড়া, উপাচার্য বিষয়টি সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেয়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরকেও নির্দেশ দিয়েছেন বলেও বিবৃতিতে জানানো হয়।
বিচারের দাবিতে মানববন্ধন: এদিকে হাফিজুরের মৃত্যুর ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করে মানববন্ধন হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের আয়োজনে এ মানববন্ধন হয়। এতে বক্তরা বলেন, আমাদের ভাইয়ের মৃত্যু আমাদের ভীষণভাবে আহত করেছে। কয়েকটি ভিডিওচিত্র দেখেছি, সেখানেও যথেষ্ট প্রশ্ন থেকে যায়।
যারা নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্ব পালন করেনি, যাদের কারণে আমাদের ভাই-বন্ধু হাফিজের প্রাণ চলে গেছে তাদের সবাইকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। যদি আত্মহত্যাও হয়, তারও সন্তোষজনক একটি তথ্য আমরা চাই। সর্বোপরি এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং জড়িতদের বিচার দাবি করছি। প্রশাসনকে অভিভাবকসুলভ আচরণ করার আহ্বান জানিয়ে শিক্ষার্থীরা বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্বটা কী? আপনাদের দায়িত্ব আমাদের নিরাপত্তা দেয়া।
কিন্তু সেটাতে আপনারা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ। আপনাদের বলবো, প্লিজ আপনারা আরেকটু অভিভাবকসুলভ আচরণ করুন, আমাদের নিরাপত্তা দিন। যাতে আমরা স্বাধীনভাবে ক্যাম্পাসে চলাফেরা করতে পারি। মানববন্ধনে উপস্থিত হয়ে ডাকসুর সাবেক এজিএস ও ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, হাফিজুর রহমানের কীভাবে মৃত্যু, তা চূড়ান্ত ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত ছাত্রলীগ রাজপথে থাকবে।
এসময় তিনি এ ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। সাদ্দাম হোসেন অভিযোগ করেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে সাত-আট দিন ধরে হাফিজুর রহমানের লাশটি অজ্ঞাতনামা হিসেবে রাখা ছিল। এই সাত-আট দিনের ঘটনাক্রম আমাদের কয়েকটি প্রশ্নের সামনে নিয়ে আসে। হাফিজুরের গায়ে ডাকসুর লোগো লাগানো টি-শার্ট ছিল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা থানায় তার নিখোঁজের জিডি করা হয়েছে, শাহবাগ থানাকে অবহিত করা হয়েছে, অথচ ঘটনার কোনো ফয়সালা করা যায়নি।
শাহবাগ থানায় এ বিষয়ে জিডি করতে গেলে পুলিশ এটি মিলিয়ে দেখার মতো পেশাদারিত্ব দেখাতে পারেনি যে কয়েক দিন আগে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পাওয়া লাশটি নিখোঁজ হাফিজুর রহমানের হতে পারে। একটি পেশাদার ও দায়িত্বশীল বাহিনী হিসেবে তাদের সামনে আসা উচিত ছিল। আমরা দুঃখের সঙ্গে বলতে চাই, এই ঘটনায় দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ পেশাদারিত্বের পরিচয় দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।
একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আমাদের প্রশ্ন, যখন বিষয়গুলো ধারাবাহিকভাবে তাদের অবহিত করা হয়, ক্যাম্পাসের শহীদ মিনার এলাকায় একজন যুবকের গলায় ছুরিকাঘাত হয়েছে, তারা কেন ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে খোঁজ নেয়ার প্রয়োজন অনুভব করেনি যে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হতে পারে? যখন আপনারা এ ধরনের দায়িত্বশীলতা অনুভব করবেন না, তখন দায়িত্বশীল জায়গায় থাকার নৈতিকতাও আপনাদের থাকে না।
তিনি বলেন, আমরা এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করছি। যাদের সঙ্গে সেদিন হাফিজুর আড্ডা দিয়েছিল, অবিলম্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় নিয়ে আসবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি। ঠিক কী ঘটেছে, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সামনে পরিষ্কার করতে হবে। এই ঘটনায় যদি কারও গাফিলতি থেকে থাকে, সেটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হোক বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হোক, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
এসময় মাইম অ্যাকশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সানোয়ারুল হক বলেন, হাফিজুর রহমানের চলে যাওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক, মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক ঘটনা। আমরা যখন তাকে বিভিন্ন মাধ্যমে খুঁজছিলাম, প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম, তখন তারা এর কোনো সুরাহা করতে পারেনি। হাফিজের সঙ্গে যারা কার্জন হলের আড্ডায় ছিল, তাদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
ওই ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা হোক। তাদের গ্রেপ্তার করা হোক, গ্রেপ্তার করতে না পারলে দুর্বার আন্দোলন হবে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়সারা ভূমিকা দেখতে চাই না। ঘটনার ভিডিও ফুটেজ চেক করে ঠিক কী ঘটেছিল, তার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করছি। এ ঘটনায় শিক্ষার্থীরা দায়িত্ব অবহেলার জন্য ভিসি-প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি করেছেন।
প্রসঙ্গত, ঈদুল ফিতরের পরের দিন হাফিজুর ক্যাম্পাসে আসে বলে জানা গেছে। ওইদিন বিকালে কার্জন হল এলাকায় তিনি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেন। রাত ৮-৯টার দিকে গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাবেন বলে বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নেন। এরপর হাফিজের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তার মুঠোফোনটি তখন থেকে বন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। এ ঘটনায় থানায় ডায়েরিও করা হয়েছিল। হাফিজুর ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাইম অ্যাকশনের সাধারণ সম্পাদক।