চার বছরেও নীতিমালা চূড়ান্ত করতে পারেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়
শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ হাইকোর্টের নির্দেশ পাওয়ার চার বছর পরও বুলিং প্রতিরোধে সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনো কোনো নীতিমালা চূড়ান্ত হয়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, করোনার কারণে দীর্ঘ সময় এই নীতিমালাসংক্রান্ত কাজ বন্ধ ছিল। এরপর থেকে ধাপে ধাপে চলছে কাজ। চলতি বছরের জানুয়ারিতে বুলিং প্রতিরোধে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। তবে এখনো মাউশির কাছে এ ধরনের কোনো কমিটি গঠনের তথ্য নেই।
আদালত সূত্রে জানা যায়, বুলিংয়ের (শারীরিক, মানসিক বা অন্য কোনোভাবে হেনস্তা) শিকার এক স্কুলছাত্রীর আত্মহত্যার ঘটনায় ২০১৮ সালে হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য বুলিং প্রতিরোধে নীতিমালা তৈরির নির্দেশ দেন। ২০১৯ সালে এবিষয়ক একটি খসড়া নীতিমালা হাইকোর্টে দাখিল করা হয়। আদালত এটি সংশোধন করে আবার জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন। এভাবে কয়েকবার এই নীতিমালা সংশোধন করে আদালতে জমা দেওয়া হয়। প্রতিবারই হাইকোর্ট এটি সংশোধনের মাধ্যমে চূড়ান্ত করার নির্দেশ দেন।
সেই নির্দেশনা অনুযায়ী গত ১৫ ফেব্রুয়ারি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের ওয়েবসাইটে ‘বুলিং প্রতিরোধ নীতিমালা-২০২৩’ খসড়া প্রকাশ করা হয়। খসড়াটি সর্বশেষ চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি শিক্ষাসচিবের নেতৃত্বে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের একটি সভা হয়। তারপর পঞ্চমবারের মতো সংশোধিত নীতিমালা গত ১৯ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে জমা দেওয়া হয়। একই দিন হাইকোর্ট আবার এটি সংশোধন করে চূড়ান্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন।
নীতিমালার খসড়া প্রকাশে দীর্ঘসূত্রতার বিষয়ে নাম না প্রকাশ করার শর্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের একজন উপসচিব বলেন, করোনার কারণে দীর্ঘ আড়াই বছর নীতিমালাসংক্রান্ত কাজ বন্ধ ছিল। এরপর ধাপে ধাপে কাজ এগিয়েছে।
এ বিষয়ে শিক্ষাসচিব সোলেমান খান বলেন, নীতিমালাটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এটি চূড়ান্ত করতে অংশীজনদের নিয়ে আরো কয়েকটি সভার আয়োজন করা হবে। বুলিংয়ের বিষয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের দায়িত্বে কারা থাকবেন, এ ব্যাপারে সচিব বলেন, নীতিমালা চূড়ান্ত হওয়ার পর এসব বিষয়ে জানানো হবে।
অন্যদিকে বুলিং প্রতিরোধে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছে মাউশি। গত জানুয়ারিতে এমন নির্দেশ দেওয়া হলেও এখনো মাউশির কাছে সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কমিটি গঠনের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, তিন কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বুলিংয়ের প্রবণতা বাড়ছে। এগুলো হলো বুলিংয়ের শাস্তি নিয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের এ বিষয়ে সঠিক ধারণা না থাকা এবং বুলিং প্রতিরোধে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাব।
এ বিষয়ে মাউশির তথ্য কর্মকর্তা কামরুন নাহার বলেন, সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কমিটি গঠনের তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। তবে বেশির ভাগ স্কুলেই কমিটি গঠন করা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এসব তথ্য আঞ্চলিক অফিস হয়ে মাউশিতে পাঠাবে। শিগগিরই এসব তথ্য পাওয়া যাবে বলে জানান তিনি।
ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলার ৬২ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনো বুলিং প্রতিরোধে কমিটি গঠন করা হয়নি। ৩৮ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমিটি গঠন করা হলেও শিক্ষকদের বুলিং বিষয়ে কোনো প্রশিক্ষণ নেই। মাউশির আওতাভুক্ত ঢাকা জেলায় সরকারি, এমপিওভুক্ত ও নন-এমপিওভুক্ত প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, অনার্স ও মাস্টার্স স্তরের কলেজের সংখ্যা মোট এক হাজার ১০৭। এর মধ্যে মাত্র ৪২১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বুলিং প্রতিরোধে কমিটি গঠন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য মতে, সারা দেশে মাউশির অধীনে স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা নিয়ে ৩৩ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। কিন্ডারগার্টেন মালিকপক্ষের হিসাবে, এর বাইরে দেশে আরো ৬০ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে।
ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিসার আবদুল মজিদ বলেন, শিক্ষকদের বুলিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ না থাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমিটি গঠন করা হলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। যৌন হয়রানি বা র্যাগিংয়ের পাশাপাশি মৌখিক, শারীরিক, সামাজিক, সাইবার, সেক্সুয়াল ও জাতিগতভাবে বিভিন্ন হেনস্তার ঘটনা ঘটে। বুলিংয়ের এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক বা অভিভাবকদেরও ধারণা নেই। শুধু সহপাঠী নয়, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আশপাশের প্রভাবশালীদের দ্বারাও শিক্ষার্থীরা বুলিংয়ের শিকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তুলনায় প্রাইভেট ও কোচিং সেন্টাগুলোতে শিক্ষার্থীরা বেশি হেনস্তার শিকার হয়।
সম্প্রতি ঢাকা সেন্ট্রাল গার্লস হাই স্কুলে এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রীদের যৌন হয়রানির অভিযোগ পাওয়া গেছে। পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে অবস্থিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির অষ্টম শ্রেণির ‘ক’ শাখার একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা হয়। অভিযোগে বলা হয়, ছাত্রীদের ফেল করানোর ভয় দেখিয়ে প্রথমে তাদের নিজ বাসায় কোচিং করতে বাধ্য করেন তিনি। সেখানে নানাভাবে তিনি যৌন হয়রানি করেন। অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের পক্ষ থেকে ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিসে অভিযোগটি দেওয়া হয়েছে।
বুলিং নিয়ে এক তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে অভিযুক্ত শিক্ষক, শিক্ষার্থী, সংশ্লিষ্ট অভিভাবক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ। তবে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অভিযোগের তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেওয়া পর্যন্ত তদন্ত কমিটির কাজ। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডি বা ম্যানেজিং কমিটির। সম্প্রতি একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বুলিংয়ের ঘটনা তদন্তে গিয়ে দেখা যায়, প্রশিক্ষণের অভাবে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের এ বিষয়ে ধারণা নেই। এমন পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কেও জানেন না তাঁরা। নীতিমালা না থাকার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বুলিংয়ের প্রবণতা বেড়েছে।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অরিত্রি অধিকারীর আত্মহত্যার পর (২০১৮ সালের ৩ ডিসেম্বর আত্মহত্যা করে) ২০১৮ সালের ৪ ডিসেম্বর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য ‘বুলিং’ প্রতিরোধে নীতিমালা তৈরির আদেশ দেন উচ্চ আদালত। নকলের দায়ে ওই শিক্ষার্থীকে অপমানের মাধ্যমে আত্মহত্যায় প্ররোচনার দায়ে চাকরিচ্যুত হন তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস। তখন নীতিমালা তৈরিতে অতিরিক্ত শিক্ষাসচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেন আদালত।
২০২৩ সালের ১১ ও ১২ ফেব্রুয়ারি মানসিক, শারীরিক ও যৌন হয়রানির শিকার হন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। সে সময় হাইকোর্ট জানান, এই নীতিমালা থাকলে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা না-ও ঘটতে পারত।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/৩১/০৩/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়