স্কুলশিক্ষার্থী তারিফের তৈরি অক্সিজেন জেনারেটর
নিউজ ডেস্ক।।
করোনা মহামারীতে অক্সিজেন সরবরাহে দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী তাহের মাহমুদ তারিফের আবিস্কৃত অক্সিজেন জেনারেটর প্লান্ট আশা জাগালেও এই মুহূর্ত তা কোনো কাজে আসছে না। অক্সিজেনের বিশুদ্ধতার ল্যাব টেস্টের দ্রুত উদ্যোগের অভাবে তা থমকে গেছে। পাবনা জেনারেল হাসপাতালে নিজের প্লান্ট থেকে অক্সিজেন তৈরি করে ইতোমধ্যেই দেখিয়েছে তারিফ। তার এ প্লান্টে প্রতি মিনিটে ২৫ লিটার অক্সিজেন উৎপাদন করা যায় বলে তারিফ দাবি করেছেন। ল্যাব টেস্টে উত্তীর্ণ হলে কোভিড আক্রান্ত রোগীর অক্সিজেন সরবরাহের সঙ্কট অনেকাংশেই পূরণ করা সম্ভব বলে চিকিৎসকরা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
ঈশ্বরদী সরকারি সাঁড়া মাড়োয়ারী মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী তাহের মাহমুদ তারিফ। তার উদ্ভাবিত প্লান্টে প্রথমে বাতাসকে একটি সিলিন্ডারে প্রবেশ করানো হয়। পরে বাতাস থেকে অন্যান্য উপাদান পৃথক করে বেছে নেয়া হয় শুধু অক্সিজেনকে। মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ৬৫ হাজার টাকা ব্যয়ে এই প্লান্ট তৈরি করা হয়। কিশোর উদ্ভাবক তারিফ জানায় শ্বাসকষ্ট নিয়ে তার বাবা আব্দুস সালাম গত বছরের ২ আগস্ট হাসপাতালে চোখের সামনে মারা যায়। অক্সিজেনের অভাবে মানুষের শ^াস নেয়ার চেষ্টার যে যন্ত্রণা তা দেখেই তার অক্সিজেন জেনারেটর ও কনসেন্ট্রেটর উদ্ভাবন। ঈশ্বরদী শহরের কলেজ রোডে বকুলের মোড় এলাকার বাসিন্দা সে।
গত ৯ জুন বিকেলে পাবনার জেলা প্রশাসক বিশ্বাস রাসেল হোসেন কিশোর তারিফের উদ্ভাবিত অক্সিজেন জেনারেটর পর্যবেক্ষণ করেন। ঈশ্বরদী উপজেলা পরিষদে উপজেলা নির্বাহী কার্যালয়ে আসেন জেলা প্রশাসক। এ সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পিএম ইমরুল কায়েস, কলেজের অধ্যক্ষ আয়নুল ইসলাম, মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার সেলিম আকতার উপস্থিত ছিলেন। জেলা প্রশাসক বিশ্বাস রাসেল হোসেন তারিফের এই আবিষ্কারে সন্তোষ প্রকাশ করেন। এ সময় তিনি তাকে উৎসাহিত করতে জেলা প্রশাসনের পক্ষে সার্বিক সহযোগিতার ঘোষণা দেন।
তারিফের এ উদ্ভাবন নিয়ে গত ৮ জুন সরকারি সাঁড়া মাড়োয়ারী মডেল সরকারি স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও উপজেলা প্রশাসন ঈশ্বরদী উপজেলা পরিষদে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে। এ সময় তারিফ তার এ উদ্ভাবন নিয়ে জানান, সাধারণত প্রতি মিনিটে ১০-১৫ লিটার অক্সিজেন সরবরাহ করে এমন অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটরের দাম ১ লাখ ২০ হাজার থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। তার উদ্ভাবিত যন্ত্রটি প্রতি মিনিটে ২৫ লিটার অক্সিজেন সরবরাহ করতে সক্ষম। এটি স্থানীয় উপকরণে তৈরি খরচ পড়েছে ৬৫ হাজার টাকার মতো।
সম্পূর্ণ স্থানীয় প্রযুক্তিতে এটি তৈরি করতে সময় লেগেছে তিন সপ্তাহ। তবে পরবর্তী সময়ে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকায় এটি তৈরি সম্ভব। তারিফ আরো জানান, তার উদ্ভাবিত অক্সিজেন জেনারেটর ও কনসেন্ট্রেটর বাতাসের ২১ শতাংশ অক্সিজেনকে প্রক্রিয়াজাত করে ৯৮ শতাংশে রূপান্তর করে। এ যন্ত্র একটানা ৭ ঘণ্টা অক্সিজেন সরবরাহে সক্ষম। এরপর মাত্র ১০ মিনিট বিরতি দিলে আবার টানা ৭ ঘণ্টা চলে।
তারিফ তার নিজের নামের আদ্যাক্ষর দিয়ে এর নামকরণ করেছেন ‘টি.এল.আর-সিভি. ১৯’। তারিফ আরো জানান যন্ত্রটি উদ্ভাবনের প্রাথমিক পর্যায়ে অধ্যক্ষ আয়নুল ইসলাম তাকে স্কুল থেকে আর্থিক সহযোগিতা ও উৎসাহ দেন। পরে ইউএনও পিএম ইমরুল কায়েসকে জানানো হলে তিনিও উপজেলা প্রশাসন থেকে পৃষ্ঠপোষকতা করেন।
এ ছাড়া শিক্ষক ফারজানা ইয়াসমিন দীনা, গোলাম মওলা, রঞ্জন কুমার কুণ্ডু, মতিয়ার রহমান ও মখলেছুর রহমান সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। এস এম মডেল সরকারি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আয়নুল ইসলাম বলেন মেধাবী শিক্ষার্থী তারিফের সাফল্যে শুধু স্কুল বা উপজেলা প্রশাসনই নয় গোটা ঈশ্বরদীবাসী গর্বিত। তারিফের মা তছলিমা খাতুন প্রতিক্রিয়ায় জানান তারিফের সাফল্যে আমার বুকটা ভরে গেছে।
ঈশ্বরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পিএম ইমরুল কায়েস জানিয়েছেন অক্সিজেনের জরুরি প্রয়োজনীয়তা মাথায় নিয়ে অল্প খরচে বাতাস থেকে অক্সিজেন তৈরি করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে তারিফ। কম খরচে এ প্লান্ট তৈরিতে তাকে আর্থিক সহযোগিতা করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, তারিফের তৈরি অক্সিজেন ল্যাব পরীক্ষার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন বিভাগে যোগাযোগ করা হচ্ছে। ল্যাব টেস্টে সাফল্য প্রমাণিত হলে বৃহত্তর পরিসরে এই মেশিনের উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়ার মাধ্যমে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সম্ভব বলেও তিনি জানান।
পাবনা জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ সালেহ মুহাম্মদ আলী জানান, যেহেতু একজন শিক্ষার্থী এটা তৈরি করেছেন এর কিছু টেকনিক্যাল ত্রুটি থাকতে পারে। তবে এটা পরিচর্যা করলে এই উদ্যোগ চমকপ্রদ হতে পারে। বিএমএ পাবনার সাধারণ সম্পাদক ডা: আকসাদ আল মাসুর আনন জানান একজন সুস্থ মানুষের শরীরে অক্সিজেন স্বাভাবিক মাত্রা হচ্ছে ৯৫-১০০ শতাংশ। এইমাত্রা ৯৩ শতাংশের কম হলে সতর্ক হতে হয় এবং ৯২-এর কম হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অক্সিজেন দেয়া হয়। কিশোর উদ্ভাবক তারিফ জানিয়েছেন অক্সিজেন লেবেল ৯০-৯১ এ নেমে আসা কয়েকজনকে তার প্লান্টের অক্সিজেন দিয়ে লেবেল ৯৮-৯৯-এ উঠানো সম্ভব হয়েছে বলে জানায়।
তার এ আবিষ্কার ল্যাব টেস্টেও সফলতা আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তারিফের স্কুলশিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ গোটা ঈশ^রদীবাসী আশায় বুক বেঁধেছে তারিফের এ আবিষ্কার ল্যাব টেস্টে উত্তীর্ণ হয়ে করোনা রোগীদের প্রাণ বাঁচাতে বড় ভূমিকা রাখবে। আর এ জন্য সরকারি হস্তক্ষেপ জরুরি বলে তারা মনে করছেন