সুখের মাপকাঠি টাকা পরিবার সৎকর্ম ?
।। এ এইচ এম সায়েদুজ্জামান।।
সুখী হওয়ার মাপকাঠিগুলো সুস্বাস্থ্য, খাবার কিংবা সম্পদ- তার সবই বস্তুগত। এদিক দিয়ে দেখলে যে যত ধনী আর স্বাস্থ্যবান, সে তত সুখী। কিন্তু আসলেই কি হিসাবটা এত সহজ? হাজার হাজার বছর ধরে দার্শনিক, ধর্মগুরু আর কবিরা সুখ কী তা জানার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের অনেকেই সুখের জন্য সামাজিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিষয়গুলোকে বস্তুগত বিষয়গুলোর মতোই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। আজকের সমাজে একজন সচ্ছল মানুষও এত উন্নত জীবনের মধ্যেও একাকিত্বে ভোগে, জীবনের অর্থ খুঁজে পায় না। অথচ সম্ভবত আমাদের পূর্বপুরুষেরা এতটা সম্পদশালী না হয়েও সামাজিক বন্ধন, ধর্ম ও প্রকৃতির মাঝে আরও বেশি সুখ খুঁজে পেত।
গত কয়েক দশক ধরে এই সুখের সন্ধানের কাজটা করছেন মনোবিজ্ঞানী ও জীববিজ্ঞানীরা। মানুষ কিসে সুখী হয়? টাকা? পরিবার? সৎকর্ম? নাকি জিনের কোনো ভূমিকা আছে এতে? প্রথমে আমাদের জানতে হবে আমরা কী পরিমাপ করতে চাই। সুখের সর্বজনগ্রাহ্য একটা সংজ্ঞা হল ‘ব্যক্তিগতভাবে ভালো থাকা’। এভাবে চিন্তা করলে সুখ হল মানুষের মনের ভিতরের একটা অনুভূতি। সেটা তাৎক্ষণিক আনন্দও হতে পারে, আবার দীর্ঘমেয়াদী সন্তুষ্টির অনুভূতিও হতে পারে। যদি এটা মনের ভিতরেরই ব্যাপার হয়, তাহলে বাইরে থেকে সেটা মাপার উপায় কী? একটা উপায় হল মানুষের কাছে তার অনুভূতি জানতে চাওয়া। এইজন্যই জীববিজ্ঞানী আর মনোবিজ্ঞানীরা মাঝেমধ্যেই সুখী মানুষদের হাতে তথ্য সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন রকম জরিপের প্রশ্ন ধরিয়ে দেন।
এসব প্রশ্নে সাধারণত বিভিন্ন ধরনের বক্তব্যে শূন্য থেকে দশের মধ্যে নম্বর দিতে বলা হয়। বক্তব্যগুলো হয় অনেকটা এরকম: ‘যেভাবে চলছে সেটাই ভালো’, ‘জীবন থেকে পাওয়ার অনেক কিছু আছে’, ‘ভবিষ্যতের ব্যাপারে আমি আশাবাদী’ কিংবা ‘জীবন আসলেই সুন্দর’। নানাজন নানাভাবে এসব বক্তব্যের সাথে একমত বা দ্বিমত পোষণ করে। তাদের দেওয়া নম্বরগুলো থেকে নানারকম হিসাব করে বিজ্ঞানীরা তাদের ‘ভালো থাকার’ পরিমাণটা নির্ণয় করেন।
এসব প্রশ্নোত্তর থেকে বিভিন্ন ব্যক্তি-নিরপেক্ষ বিষয়ের সাথে সুখের সম্পর্ক নির্ণয়ের চেষ্টা করা হয়। যেমন, ধরা যাক কোনো জরিপে বছরে এক লক্ষ ডলার আয় করে এমন এক হাজার জন মানুষের মতামত নেওয়া হল। অন্য কোনো জরিপে এমন এক হাজার লোকের মতামত নেওয়া হল যাদের বার্ষিক আয় ৫০ হাজার ডলার। এখন এই দুটো জরিপে যদি দেখা যায় প্রথম দলের ‘ভালো থাকার’ গড় মান ৮.৭ আর দ্বিতীয় দলের ৭.৩, তাহলে বলা যায় ব্যক্তিগত ভালো থাকার সাথে টাকার একটা সম্পর্ক আছে। সোজা কথায়, যার টাকা বেশি, তার সুখও বেশি। একই পদ্ধতিতে জানার চেষ্টা করা যায় মানুষ গণতান্ত্রিক দেশে বেশি সুখে থাকে না একনায়কের শাসনে, অথবা বিবাহিত মানুষেরা অবিবাহিত, বিধবা ও বিপত্নীক মানুষের চেয়ে বেশি সুখী হয় কি না।
এই তথ্যগুলো ইতিহাসবিদদেরও কাজে লাগে। এখান থেকে তারা অতীতের মানুষের টাকা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা বা বিবাহ-বিচ্ছেদের হার কেমন ছিল তা জানতে পারেন। ফলে, যদি দেখা যায়, আগে মানুষ গণতান্ত্রিক শাসনে বেশি ভালো ছিল, তাহলে তারা যুক্তি দেখাতে পারেন, গত কয়েক দশকে গণতন্ত্রের প্রসার মানুষের সুখ বাড়িয়েছে। আবার যদি দেখা যায় বিবাহিত মানুষেরা বেশি সুখী ছিল, তাহলে বলা যায় এখনকার বিবাহ-বিচ্ছেদের হার বেড়ে যাওয়াটা আসলে মানুষের আরও অসুখী হওয়ার একটা লক্ষ্মণ।
এটা অবশ্য কোনো নির্ভুল পদ্ধতি নয়, তবে এই পদ্ধতির সমস্যাগুলো দেখার আগে এর কিছু ফলাফল দেখা যাক।
একটা মজার পর্যবেক্ষণ হল, টাকা আসলেই সুখ আনে। তবে সেটা একটা পর্যায় পর্যন্ত, সেটা পার হয়ে গেলে টাকার গুরুত্ব তেমন থাকে না। অর্থনীতির একেবারে নিচের তলায় যাদের বাস, তাদের কাছে বেশি টাকা মানেই বেশি সুখ। ধরুন, আমেরিকার একজন একা মা মানুষের ঘর পরিষ্কার করে বছরে ১২ হাজার ডলার আয় করছে। এখন সে যদি হঠাৎ একদিন লটারিতে ৫ লাখ ডলার পেয়ে যায়, তাহলে তার ‘ভালো থাকার’ পরিমাণটা এক লাফে অনেকখানি বেড়ে যাবে, আর সেটা বেশ অনেকদিন থাকবেও। তখন সে দেনায় ডুবে না গিয়েও তার সন্তানদের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করতে পারবে। অথচ যে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এমনিতেই বছরে আড়াই লাখ ডলার আয় করছে, সে যদি লটারিতে ১০ লাখ ডলারও পেয়ে যায়, বা কোম্পানি যদি তার বেতন দ্বিগুণ করে দেয়, তার বাড়তি সুখটুকু কিন্তু সপ্তাহখানেকের বেশি থাকবে না। বিভিন্ন জরিপে এমনটাই দেখা যায়। এই বাড়তি টাকা দিয়ে লোকটা হয়তো আরও দামী গাড়ি চালাবে, আরও বড় আর বিলাসবহুল বাড়িতে গিয়ে উঠবে, আরও ভালো খাবার আর পানীয় উপভোগ করবে, কিন্তু কিছুদিন পরেই সেটা তার কাছে একটা সাদামাটা ব্যাপারে পরিণত হবে।
শারীরিক সুস্থতার সাথে সুখের সম্পর্কটাও লক্ষণীয়। জরিপে দেখা যায়, অসুখবিসুখ সাধারণত মানুষকে সাময়িকভাবে অসুখী করে। তবে রোগটা যদি যন্ত্রণাদায়ক হয়, অথবা যারা অনেকদিন ধরে কোনো রোগে ভুগছে, তাদের জন্য সেটা বিরাট অশান্তির কারণ। যারা ডায়াবেটিসের মতো দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়, তারা প্রথমে কিছুদিন প্রচুর অশান্তিতে ভোগে। কিন্তু তাদের শারীরিক অবস্থার যদি অবনতি না হয়, তাহলে তারা সেই অশান্তির সাথে ধীরে ধীরে নিজেদের মানিয়ে নেয়, ফলে একসময় তারা সুস্থ মানুষদের মতোই সুখী জীবনে ফিরে আসে। ধরুন লুসি আর লুক কোনো মধ্যবিত্ত পরিবারের দুই যমজ ভাই-বোন। একটা তথ্য সংগ্রহের জরিপে অংশগ্রহণ করে ফেরার পথে দুটো ঘটনা ঘটল। রাস্তায় একটা বাস লুসির গাড়িটাকে ধাক্কা দিল, ফলে গাড়ি তো গুঁড়িয়ে গেলই, লুসির শরীরের অনেকগুলো হাড় ভাঙল, আর একটা পা অকেজো হয়ে গেল সারা জীবনের জন্য। ওদিকে লুকের কাছে একটা ফোন এল। লুক জানতে পারল, সে এক কোটি ডলারের লটারি জিতে গেছে! দুবছর পর দেখা যাবে লুসি খুঁড়িয়ে হাঁটছে আর লুক অনেক দামী গাড়িতে চড়ছে। তখন যদি দুবছর আগের সেই জরিপে আবার তাদের অংশগ্রহণ করতে বলা হয়, সম্ভবত দুজনেরই বেশিরভাগ উত্তর আগের সেই দিনটার মতোই হবে।
সুখের উপর টাকা আর স্বাস্থ্যের চেয়ে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনের প্রভাব আরও বেশি বলেই দেখা যায়। যেসব মানুষের পারিবারিক বন্ধন দুর্বল অথবা যারা অন্যান্য মানুষের কাছ থেকে খুব বেশি সহযোগিতা পায়নি (অথবা নেয়নি), তাদের চেয়ে দৃঢ় পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনে থাকা মানুষেরা বেশি সুখী হয়। বিয়ে জিনিসটা এখানে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন সময়ে নানা সমীক্ষায় দেখা গেছে, সুন্দর বৈবাহিক জীবনের সাথে ভালো থাকা সরাসরি সম্পর্কিত। এই সম্পর্কটা আর্থিক অবস্থা, এমনকি শারীরিক সুস্থতার হেরফের হলেও খাটে। আন্তরিক জীবনসঙ্গী, পরিবার ও উষ্ণ সামাজিক পরিবেশ পেলে একজন হতদরিদ্র অসুস্থ মানুষও একজন একাকী কোটিপতি মানুষের চেয়ে অনেক বেশি সুখী জীবন কাটাতে পারে। তবে দারিদ্র্য খুব বেশি হলে বা কোনো যন্ত্রণাদায়ক রোগে আক্রান্ত হলে ফলাফল কিছুটা ভিন্ন হতেও পারে।
এসব থেকে আরেকটা সম্ভাবনা দেখা যায়। গত দুইশ বছরে মানুষের বস্তুগত দিক থেকে প্রাচুর্য এসেছে। তাই এমনও হতে পারে যে এই প্রাচুর্যই পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন দুর্বল হওয়ার ক্ষতি খানিকটা পূরণ করে দিচ্ছে। যদি তাই হয়, তাহলে ১৮০০ সালের একজন মানুষের চেয়ে এখনকার গড়পড়তা একজন মানুষের বেশি সুখী হওয়ার কথা নয়। এমনকি আমরা যে স্বাধীনতাকে এত গুরুত্ব দিই, সেটাই হয়তো আমাদের জন্য খারাপ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আমাদের এখন জীবনসঙ্গী, বন্ধুবান্ধব বা প্রতিবেশী বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা আছে। আবার তাদেরও তো স্বাধীনতা আছে আমাদের ছেড়ে যাওয়ার! আমাদের নিজের জীবনকে নিজের ইচ্ছামতো সাজানোর স্বাধীনতা যত বাড়ছে, যেকোনো ধরনের বন্ধনে জড়িয়ে পড়াটাও ততই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তাই এসব বন্ধন আলগা হতে হতে আমরা ক্রমেই একাকী জীবনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
চলবে---