সিলেট-সুনামগঞ্জে ৭ শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্লাবিত
নিজস্ব প্রতিবেদক।।
বন্যার কারণে সিলেটের অন্তত সাড়ে ৫০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া ১৯৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খোলা হয়েছে আশ্রয় কেন্দ্র। ফলে জেলার অন্তত সাড়ে ৭০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদানকার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। অন্যদিকে সুনামগঞ্জের দুই শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও বন্ধ রয়েছে পাঠদানকার্যক্রম। ছাতকে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে বন্যা পরিস্থিতি। বিশুদ্ধ পানি ও শুকনো খাবারের সঙ্কট দেখা দিয়েছে সিলেট বিভাগের বন্যাকবলিত সবগুলো উপজেলায়।
সিলেট ব্যুরো জানায়, পাহাড়ি ঢল আর টানা বৃষ্টিতে সিলেটের ছয় উপজেলার পাশাপাশি নগরের বন্যা পরিস্থিতিরও অবনতি হয়েছে। আরো নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়েছে। তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট। সরকারি-বেসরকারি অফিসের পাশাপাশি অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানিতে ডুবে গেছে। পানিবন্দী মানুষ শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সঙ্কটে পড়েছেন। এতে চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন মানুষ। দিন দিন ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে বন্যা পরিস্থিতি।
এ অবস্থায় আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, ২৩ জুন পর্যন্ত সিলেটে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে। তবে বৃষ্টির পরিমাণ কিছুটা কমতে পারে। জেলা প্রশাসন কার্যলয় সূত্রে জানা গেছে, বন্যাকবলিতদের জন্য দ্বিতীয় দফায় ১০০ মেট্রিক টন চাল এবং তিন হাজার প্যাকেট শুকানো খাবার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর আগে ১২৯ মেট্রিকটন চাল ও এক হাজার প্যাকেট শুকানো খাবার বরাদ্দ দেয়া হয়। সিলেটের জেলা প্রশাসক মজিবর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, কিছু সরকারি স্থাপনায় পানি উঠলেও সেবা ব্যাহত হচ্ছে না।
সব প্রতিষ্ঠানেরই স্বাভাবিক কার্যক্রম অব্যাহত আছে। বন্যায় জেলাজুড়ে ১৯৯টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে জানিয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, এসব আশ্রয়কেন্দ্রে খাবারের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। এছাড়া ইউএনওদের সার্বক্ষণিক নজরদারি করার নির্দেশনা দেয়া আছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় সিলেটের প্রধান নদী সুরমা কানাইঘাট (সিলেট) পয়েন্টে ১৬ সেন্টিমিটার হ্রাস পেয়েছে, তবে এখনও তা বিপদসীমার ১২৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুরমা নদীর সিলেট পয়েন্টে ১৩ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৪২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপর দিকে সুনমাগঞ্জ পয়েন্টে ১৭ সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার ১৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এ ছাড়া কুশিয়ারা নদীর পানি অমলসিদ (সিলেট) পয়েন্টে ২০ সেন্টিমিটার বেড়ে এখন বিপদসীমার ১৫৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শেওলা (সিলেট) পয়েন্টে নদীটির পানি বেড়েছে ৮ সেন্টিমিটার, এখন তা বিপদসীমার ৫৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট ও সুনামগঞ্জের নি¤œাঞ্চলের কতিপয় স্থানে বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হতে পারে। বুধবার নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সুরমার তীরঘেঁষা নগরের শাহজালাল উপশহর, সোবহানীঘাট, ছড়ারপাড়, কালিঘাট, তালতলা, কাজিরবাজার, শেখঘাট, ঘাসিটুলা, লালাদীঘির পার এলাকাসহ মহানগরীর অন্তত ১৫টি ওয়ার্ডে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। বন্যার পানিতে শত শত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়ির জিনিসপত্র ভিজে নষ্ট হয়েছে।
পানিতে তলিয়ে গেছে সিলেট ফায়ার সার্ভিস অফিস, সিলেট বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, উপমহাপুলিশ পরিদর্শকের কার্যালয়, কোতোয়ালি থানা, বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কার্যালয়, তোপখানা সড়ক ও জনপথের কার্যালয়, সোবহানীঘাট পুলিশ ফাঁড়ি, বিদ্যুতের আঞ্চলিক কার্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এছাড়া নগর ও উপজেলাগুলোর বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও এখন পানিতে ঢুবে গেছে। জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে সবখানে। এ দিকে, বন্যা পরিস্থিতির অবনতিতে সিলেট নগরীর সাতটি ওয়ার্ডে ১৭টি আশ্রয়কেন্দ্র চালু করেছে সিটি করপোরেশন।
সেগুলো হচ্ছে, ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে কিশোরী মোহন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মিরাবাজার, ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে চালিবন্দর রামকৃষ্ণ উচ্চবিদ্যালয়, চালিবন্দর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২৩ নম্বর ওয়ার্ডে আব্দুল হামিদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাছিমপুর, ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে বোরহান উদ্দিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও উমরশাহ তেরোরতন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে মির্জাজাঙ্গাল স্কুল, মনিপুরী রাজবাড়ি আশ্রয়কেন্দ্র ও মাছুদীঘির পাড়, ১০ নম্বর ওয়ার্ডে ঘাসিটুলা স্কুল, ইউসেফ স্কুল, কানিশাইল স্কুল, জালালাবাদ স্কুল, বেতের বাজার কাউন্সিলর কার্যালয়ের পাশের ৪তলা ভবন, ২৬ নং ওয়ার্ডে রেলওয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে হবিনন্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সিলেট।
সিলেট আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ চৌধুরী নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, আগামী কয়েক দিন এই বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে। এছাড়াও ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বৃষ্টিও কমছে না। তাই পাহাড়ি ঢল নামছে এবং আমাদের দেশেও পানি বাড়ছে।
গত ১০ মে থেকে সিলেটে ভারী বর্ষণ শুরু হয়, যা এখনো চলমান। একই সাথে উজান থেকে নামছে ঢল। এতে গত ১১ মে থেকেই সিলেটের নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যেতে শুরু করে। আর গত সোমবার থেকে পানিতে তলিয়ে যেতে শুরু করে সিলেট নগর। জেলার শিক্ষা কর্মকর্তারা বলছেন, পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে আরো বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ছাড়া পানি নামার সময় আরো দু-একটি উপজেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একই দশা হতে পারে।
সিলেট জেলায় এক হাজার ৪৭৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। এর মধ্যে বুধবার দুপুর পর্যন্ত ৪০০টি পানিতে প্লাবিত হয়েছে। ফলে এসব বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর, জকিগঞ্জ ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় সবচেয়ে বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্লাবিত হয়েছে।
এ ছাড়া প্রায় দেড় শ’ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদরাসায় পানি উঠেছে। এগুলোতেও পাঠদান বন্ধ রয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছাড়াও জেলার বিভিন্ন উপজেলার অন্তত ২০টি কলেজ প্লাবিত হয়ে পড়ায় পাঠদান বন্ধ রয়েছে। সুনামগঞ্জের ২ শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্লাবিত ইউএনবি জানায়, সুনামগঞ্জের ছাতকে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।
বুধবার পর্যন্ত ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় ইতোমধ্যে উপজেলার ১৩ ইউপি ও একটি পৌরসভাসহ নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বন্যায় তলিয়ে গেছে এ অঞ্চলের বহু রাস্তাঘাট, প্লাবিত হয়েছে কয়েক হাজার ঘরবাড়ি, দুই শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শতাধিক মৎস্য খামার। ছাতক-সিলেট সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে।
গোবিন্দগঞ্জ-ছাতক সড়কপথে ঝুঁকি নিয়ে কিছু কিছু যান চলাচল করলেও গত বুধবার সকাল থেকে ছাতকের সাথে জেলা সদরসহ দেশের সব অঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের কারণে সুরমা, চেলা ও পিয়াইন নদীতে পানিবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ফলে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ।
গত ২৪ ঘণ্টায় এখানে ১৮০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, গত বুধবার দুপুর পর্যন্ত সুরমা চৈলা নদী, পিয়াইন নদী ও সুরমা নদীর পানি ছাতক পয়েন্টে বিপদসীমার ১৫৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ভারী বর্ষণ ও সীমান্ত এলাকা মেঘালয় থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে পানি বৃদ্ধির ফলে পৌরসভাসহ উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ও হাটবাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্যা প্লাবিত হয়ে পড়েছে।
গ্রামীণ সড়ক বন্যা প্লাবিত হওয়ায় ১৮টি সড়ক ও উপজেলা সদরের যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। দুর্ভোগে শাবিপ্রবি শিক্ষার্থীরা : সিলেট নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডের মানুষের পাশাপাশি ভোগান্তি থেকে বাদ যায়নি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, হঠাৎ এই বন্যায় রাস্তায় পানি ওঠায় বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত করতে অসুবিধা হচ্ছে। তা ছাড়া বেশির ভাগ বাসায় বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট, বাজার ও রান্নার সমস্যা তৈরি হয়েছে। অনেক মেস নিচতলায় যেখানে পানি প্রবেশ করেছে।