সরকারের সক্ষমতা বাড়লে শিক্ষকরা শতভাগ উৎসব-ভাতা পাবেন
শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ ফরিদপুর সদর উপজেলার একটি এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বাংলা বিষয়ের একজন সহকারী শিক্ষকের মূল বেতন প্রায় ১৮ হাজার টাকা। নিয়মানুযায়ী তিনি তার মূল বেতনের ২৫ শতাংশ ঈদ বোনাস পাবেন। সে হিসেবে তিনি আসন্ন ঈদুল ফিতরের বোনাস পাবেন সাড়ে চার হাজার টাকা। এ দিয়ে কী কেনাকাটা করবেন তা নিয়ে খুবই চিন্তিত তিনি।
নাম প্রকাশ না করে ওই শিক্ষক বলেন, ‘আমি বাংলা বিষয়ের শিক্ষক বিধায় প্রাইভেট পড়ানোর তেমন সুযোগ নেই। এমপিওভুক্ত শিক্ষক হিসেবে সরকার থেকে মূল বেতনের সঙ্গে বাড়িভাড়া ও চিকিৎসা-ভাতা মিলিয়ে ১৯ হাজার ৫০০ টাকা বেতন পাই। যদিও স্কুলের অংশ থেকে মাসে অতিরিক্ত চার হাজার টাকা বেতন পাই। নিজ বাড়িতে থেকে এই বেতন দিয়ে মোটামুটিভাবে চলে যায়। কিন্তু এই ঈদে দুই সন্তান, মা-বাবা ও আত্মীয়স্বজন নিয়ে মাত্র সাড়ে চার হাজার টাকা বোনাসে কীভাবে ঈদ করব?’ তিনি বলছিলেন, ‘জামা-কাপড়ের যে দাম, ছেলেমেয়ের পোশাক কিনতেই সাত-আট হাজার টাকার দরকার। আর পরিবারের অন্যদের জন্য কী কিনব? এ ছাড়া অন্যান্য বাজার করব কীভাবে?’
প্রায় ৩২ হাজার এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চার লাখ শিক্ষকের প্রশ্ন একই। বিশেষ করে ইংরেজি ও গণিতের যেসব শিক্ষক রয়েছেন তারা প্রাইভেট পড়িয়ে মোটামুটিভাবে চললেও অন্যসব শিক্ষকের সে সুযোগ নেই। সরকারের দেওয়া বেতনই তাদের মূল ভরসা। এ ছাড়া এসব প্রতিষ্ঠানের এক লাখ কর্মচারীও মাত্র ৫০ শতাংশ উৎসব-ভাতা পান। ফলে ৫ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর মনেই উৎসব নিয়ে বিশেষ কোনো আগ্রহ নেই।
সূত্র জানায়, বর্তমানে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন-ভাতার পেছনে সরকারের বছরে ব্যয় হয় ১২-১৩ হাজার কোটি টাকা। এখন যদি সব শিক্ষক-কর্মচারীকে শতভাগ উৎসব দিতে হয় তাহলে বছরে আরও ৭০০ থেকে ৭৫০ কোটি টাকা অতিরিক্ত প্রয়োজন হবে।
জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, ‘সরকার শিক্ষকদের প্রতি সব সময়ের জন্যই আন্তরিক। কিন্তু সরকারের সক্ষমতার ব্যাপারটিও বুঝতে হবে। করোনা এবং ইউক্রেন যুদ্ধে সব জায়গাতেই অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। তবে এ অবস্থা না থাকলে এত দিন এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের উৎসব-ভাতায় পরিবর্তন আসত। হয়তো সামনে সরকারের সক্ষমতা বাড়লে শিক্ষকরা শতভাগ উৎসব-ভাতা পাবেন। এ জন্য কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হবে না। সব বিষয়ই প্রধানমন্ত্রীর নজরে আছে।’
২০০৪ সাল থেকে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা বেতনের ২৫ শতাংশ ও কর্মচারীরা ৫০ শতাংশ উৎসব-ভাতা পেয়ে থাকেন। এরপর থেকেই শিক্ষকরা মূল বেতনের সঙ্গে শতভাগ উৎসব-ভাতা, সরকারি শিক্ষকদের মতো চিকিৎসা-ভাতা ও বাড়িভাড়া দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু ১৮ বছর পার হলেও সরকার উৎসব-ভাতায় কোনো পরিবর্তন আনেনি। আর ২০১৯ সাল থেকে মূল বেতনের ২০ শতাংশ বৈশাখী ভাতা পেয়ে আসছেন এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা।
শিক্ষকরা জানান, দেশের ৯৭ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বেসরকারি। যাদের বেশির ভাগ আবার এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা একই নিয়মনীতি অনুসরণ করেন। একই পাঠ্যক্রমে পাঠদান করান। একই প্রশিক্ষণ নেন। অনেক সময়ই দেখা যায়, সরকারির চেয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ফল ভালো হয়। এর পরও তারা বৈষম্যের শিকার। সরকারি শিক্ষকরা মূল বেতনের সঙ্গে প্রয়োজনীয় বাড়িভাড়া, চিকিৎসা-ভাতাসহ অন্যান্য ভাতা পান। চাকরি শেষে প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, পেনশনসহ নানা সুবিধা পান। কিন্তু একই কাজ করে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা বঞ্চিত হচ্ছেন। এমনকি নিজের টাকা কল্যাণ ফান্ড ও অবসর বোর্ডে জমিয়ে চাকরি শেষের পাঁচ-সাত বছরেও সে টাকা পান না।
এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের একাধিক সংগঠন থাকলেও তারা সবাই মূলত একই দাবিতে আন্দোলন করছেন। তাদের অন্যতম দাবি, শতভাগ উৎসব-ভাতা, সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের মতো বাড়িভাড়া, চিকিৎসা-ভাতা ও অন্যান্য ভাতা প্রদান। তবে এখন শিক্ষকদের সব সংগঠনই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের আন্দোলনেই বেশি জোর দিয়েছেন।
জানতে চাইলে স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ মো. শাহজাহান আলম সাজু বলেন, ‘শিক্ষকরা কষ্টে আছেন। তাদের শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রীর উপস্থিতিতে আমাদের একাধিক কর্মসূচিতে আমরা শতভাগ উৎসব-ভাতার দাবি জানিয়েছি। আমরা জানি, সরকারও আর্থিক সমস্যায় আছেন। কিন্তু বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী, ২৫ শতাংশ উৎসব-ভাতা কোনোভাবেই কাম্য নয়।’
বাংলাদেশ শিক্ষক ইউনিয়নের সভাপতি মো. আবুল বাশার হাওলাদার বলেন, ‘সরকারি শিক্ষকদের সবাই শতভাগ উৎসব-ভাতা পান আর আমরা পাই ২৫ শতাংশ, এটা অমানবিক। আমরা ১৭ বছর ধরে শতভাগ উৎসব-ভাতার দাবিতে আন্দোলন করছি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, অর্থ মন্ত্রণালয় দেয় না। আর অর্থ মন্ত্রণালয় বলে শিক্ষা থেকে প্রস্তাব আসে না। সরকার হাজার হাজার কোটি টাকার বড় প্রকল্প করছে। অথচ শিক্ষার উন্নয়নে কেন যে ৭০০ থেকে ৭৫০ কোটি টাকা বেশি ব্যয় করতে পারছে না, এটা আমাদের বোধগম্য নয়। আমি বলব, শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা শিক্ষামন্ত্রী যদি আন্তরিক হন, তাহলে শতভাগ উৎসব-ভাতা পাওয়া কঠিন কোনো ব্যাপার না।’
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলন করছেন এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী জাতীয়করণ প্রত্যাশী মহাজোট। বর্তমানে তারা প্রতীকী অনশন পালন করছেন। মহাজোটের আহ্বায়ক অধ্যক্ষ মো. মাঈন উদ্দিন বলেন, ‘বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে এই টাকায় কী হয়? আমরা মূল বেতনের বাইরে মাত্র এক হাজার টাকা বাড়িভাড়া ও ৫০০ টাকা চিকিৎসা-ভাতা পাই। বিশ্বের কোনো দেশে এমন বৈষম্য নেই। এই বৈষম্য দূরীকরণেই জাতীয়করণ জরুরি।’
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৭/০৪/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়