সরকারি প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা কিন্ডারগার্টেন থেকে পিছিয়ে এই দায় কার?
নিজস্ব প্রতিবেদক।।
পঠন ও গাণিতিক দক্ষতায় কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার্থীদের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা। জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমির (নেপ) সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে এমন তথ্য। এতে কিন্ডারগার্টেন ও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের বাংলা ও গণিতে দক্ষতা এবং শিক্ষার্থীদের শিখন দক্ষতার পেছনে যে বিষয়গুলো ভূমিকা পালন করে সেগুলো তুলে ধরা হয়েছে। দক্ষতার যে মান বিবেচনা করে গবেষণাটি করা হয়েছে সে তুলনায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কিন্ডারগার্টেন উভয় প্রতিষ্ঠানেরই অধিকাংশ শিক্ষার্থীর বাংলায় দক্ষতা ৬০ শতাংশের কম এবং গণিতে দক্ষতা ৫০ শতাংশেরও কম। তবে এক্ষেত্রে তুলনামূলক অধিক খারাপ অবস্থায় রয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
২৫ স্কোর বিবেচনায় বাংলা পঠনের ক্ষেত্রে কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার্থীদের গড় দক্ষতা ১৬ এবং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গড় দক্ষতা ১৪ দশমিক ৩। অন্যদিকে গণিতে ২০ স্কোর বিবেচনায় কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার্থীদের গড় দক্ষতা ৯ দশমিক ৫ এবং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গড় দক্ষতা ৮ দশমিক ২।
বিভাগভিত্তিক তুলনায় দেখা গেছে, ঢাকা, ময়মনসিংহ, রংপুর ও সিলেটে বাংলা ও গণিত উভয় বিষয়েই কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার্থীরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে। তবে খুলনা ও রাজশাহীতে সরকারি প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা কিন্ডারগার্টেনের তুলনায় অধিক এগিয়ে। বরিশালে পঠন দক্ষতায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে থাকলেও গাণিতিক দক্ষতায় প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা এগিয়ে রয়েছে। ময়মনসিংহে পঠন দক্ষতায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এগিয়ে রয়েছে। বিভাগগুলোর মধ্যে কিন্ডারগার্টেনের তুলনায় সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে ময়মনসিংহ, রংপুর ও সিলেটের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
২৫ স্কোর বিবেচনায় বাংলা পঠনের ক্ষেত্রে ময়মনসিংহে কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার্থীদের গড় দক্ষতা ১৯ দশমিক ৯ এবং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গড় দক্ষতা ১২ দশমিক ৫। রংপুরে এ হার যথাক্রমে ১৭ দশমিক ৮ ও ১০ দশমিক ৮। সিলেটে এ হার ১৩ দশমিক ১ ও ১০।
২০ স্কোর বিবেচনায় গণিতের ক্ষেত্রে ময়মনসিংহে কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার্থীদের গড় দক্ষতা ১২ দশমিক ৭ এবং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গড় দক্ষতা ৬ দশমিক ৯। রংপুরে এ হার যথাক্রমে ৮ দশমিক ৮ ও ৫ দশমিক ৫। সিলেটে ৮ দশমিক ৭ ও ৪ দশমিক ৬।
গবেষণা প্রতিবেদনে শিক্ষার্থীদের পারফরম্যান্সের ক্ষেত্রে প্রভাবক হিসেবে যেসব বিষয় উঠে এসেছে সেগুলো হলো প্রধান শিক্ষকের নেতৃত্ব দক্ষতা, শিক্ষার্থীর উপস্থিতি, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শেখানোর পদ্ধতি, শিক্ষা উপকরণ, বাড়ির কাজ, মূল্যায়ন, পিতা-মাতার সহযোগিতা, পিতা-মাতার শিক্ষাগত যোগ্যতা, আর্থিক অবস্থা, কোচিং, গৃহশিক্ষক ইত্যাদি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিন্ডারগার্টেনে সাধারণত অপেক্ষাকৃত বিত্তশালীদের সন্তানরা পড়ালেখা করে। এসব ক্ষেত্রে দেখা যায় মা-বাবা সন্তানদের বাড়িতে বাড়তি সহযোগিতা করেন। গৃহশিক্ষক ও কোচিংয়ের ব্যবস্থা করেন। এছাড়া তারা প্রতিষ্ঠানকেও জবাবদিহির মধ্যে রাখেন। ফলে কিন্ডারগার্টেনগুলোর ব্যবস্থাপনা অপেক্ষাকৃত ভালো হয়, শিক্ষার্থীরাও এগিয়ে থাকে। অন্যদিকে প্রাথমিকে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে এবং বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের স্বল্পতা থাকে। এছাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেসব শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে তাদের বড় একটি অংশ নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। বিদ্যালয়ের বাইরে বাড়িতে তারা শিক্ষাসংক্রান্ত নির্দেশনা ও সহযোগিতা অপেক্ষাকৃত কম পায়। যদিও শিক্ষাবিদরা মনে করছেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মানসম্মত প্রশিক্ষণ ও মনিটরিং নিশ্চিত করা গেলে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও দক্ষতায় এগিয়ে যাবে।
এডুকেশন ওয়াচের চেয়ারপারসন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ইকোনমিকসের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, ‘আমাদের দেশে কিন্ডারগার্টেনগুলো তাদের শিক্ষার্থীদের তুলনামূলক বেশি পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখে। এছাড়া যেসব শিক্ষার্থী কিন্ডারগার্টেনে পড়ে তাদের অভিভাবকদের প্রায় সবাই আর্থিকভাবে সচ্ছল হওয়ায় বাড়িতেও শিক্ষকের ব্যবস্থা করেন। এসব কারণে কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার্থীরা দেখা যায় এগিয়ে থাকে। তবে দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে যদি প্রশিক্ষিত ভালো মানের শিক্ষক ও মনিটরিং নিশ্চিত করা যায় তাহলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এগিয়ে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের সবার আগে শিক্ষকদের ভালো মানের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া অনেক সময় দেখা যায় অনেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংশ্লিষ্টদের ওপর অর্পিত দায়িত্বগুলো সঠিকভাবে পালিত হয় না। ফলে শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি থেকে যায়। এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সরকারি নজরদারি ও জন-নজরদারি উভয়ই প্রয়োজন। জন-নজরদারি বলতে যারা স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি রয়েছেন তাদেরও উচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে খোঁজখবর রাখা, প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা এবং কোথাও অসামঞ্জস্য দেখা গেলে দায়িত্বশীল প্রশাসনিক ব্যক্তিকে জানানো।’
এ গবেষণার উপদেষ্টা ও জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমির ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ রঙ্গলাল রায় বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমার মতে কিন্ডারগার্টেনগুলো তুলনামূলক কিছুটা এগিয়ে রয়েছে তাদের ব্যবস্থাপনার কারণে। তবে আমরা যেহেতু অল্পসংখ্যক প্রতিষ্ঠান থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে গবেষণাটি করেছি তাই এটির আলোকে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া কঠিন। এ বিষয়ে আরো বড় পরিসরে গবেষণা প্রয়োজন। বড় পরিসরে গবেষণা হলে প্রকৃত চিত্র উঠে আসবে এবং সে অনুযায়ী আরো ভালোভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে।’