সমাজে দুধরনের শিক্ষক ও শিক্ষক সমাজে বিভাজন
নিউজ ডেস্ক।।
বোধবুদ্ধির বয়স থেকে সবাই শুনে এসেছি শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর মুখবন্ধে শিক্ষা জাতির মেরুদ- বিষয়ে সংক্ষেপে নিখুঁত বর্ণনা আছে কয়েকটি বাক্যে। আমাদের দেশে ব্রিটিশ শাসনের সময় ১৮৫৪ সালে উড্স এডুকেশনাল ডেসপাচ-এর মাধ্যমে শিক্ষানীতি বা শিক্ষা কমিশনের যাত্রা শুরু। ১৮৮২, ১৯০১, ১৯২৭-এ আরো তিনটি শিক্ষা কমিশন হয়েছিল।
পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর মওলানা আকরম খাঁ শিক্ষা কমিশন ১৯৪৯ দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠনের চেষ্টা হয়। তারপর ১৯৫৭, ১৯৫৮, ১৯৬৪, ১৯৬৯ সালে পরপর আরো চারটি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ড. কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭২ সালে একটি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। এ যাবৎ কুদরত-ই-খুদা কমিশন রিপোর্টের ভিত্তির ওপর সমসাময়িক বাস্তবতা ধারণের চেষ্টা করা হয়েছে সকল শিক্ষা কমিশনের নতুন রিপোর্টগুলোয়।
পরবর্তীকালে আমরা পাই অধ্যাপক শামসুল হক ১৯৭৬, মজিদ খান ১৯৮৩, মফিজ উদ্দিন ১৯৮৭, শামসুল হক ১৯৯৭, এম এ বারী ২০০১, মনিরুজ্জামান মিঞা ২০০৩ এবং সর্বশেষ কবির চৌধুরীর নেতৃত্বে ২০০৯ সালের রিপোর্ট বর্তমানে যা কার্যকর রয়েছে। এত এত রিপোর্টের পরও কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় মূল নীতি পাশ কাটানো চলছেই। অবিশেষজ্ঞের আরোপিত উপাদানের কারণে শিক্ষানীতির শতভাগ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন কখনোই সম্ভব হয়নি।
নতুন বাজেট প্রস্তাবে গত অর্থবছরের তুলনায় শিক্ষা ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন দেখা যায় না। বাজেটে শিক্ষক নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, শিক্ষা পরিবেশের নানান রকম উন্নয়ন, ছাত্র-ছাত্রীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির তুলনায় অবকাঠামো নির্মাণের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বেশি। অবকাঠামোর প্রয়োজনীয়তা মুখ্য হলে শিক্ষা উন্নয়নে প্রত্যাশিত অর্জন ব্যাহত হবে, সুফল হবে সুদূরপরাহত। বাজেটে এমপিওভুক্তি স¤পর্কে সু¯পষ্ট ধারণা না থাকায় নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের আবারো রাস্তায় অনশনে দেখা গেল।
যেখানে গুণের কদর যথাযথ নেই সেখানে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে। প্রচলিত গল্পে গুরু এবং শিষ্য দেশ ভ্রমণকালে এমন রাজ্যে হাজির হলেন, যেখানে তেল ঘি দুটোর মূল্যে পার্থক্য নেই। একই দামে বিক্রি হয় লবণ ও চিনি। গুরু সমূহ বিপদের আশঙ্কায় রাজ্য ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলেও সহজলভ্য ও সস্তা খাবারের লোভে শিষ্য সেখানে রয়ে যায়। অনেক দিন পর কাকতালীয়ভাবে গুরু সংকটাপন্ন শিষ্যের প্রাণ রক্ষা করেন। জাতি-দেশ-সমাজ সঠিক দিকনির্দেশনা পেতে পারে শিক্ষকের দ্বারা। শিক্ষা নামের অদৃশ্য মেরুদ- শক্তপোক্তভাবে নির্মাণ করতে পারেন একমাত্র শিক্ষক। যতই সুদৃশ্য ভবন কিংবা ছাত্রছাত্রীদের বিশেষ প্রণোদনা দেওয়া হোক তা সর্বাংশে সার্থক হবে না শ্রেণীকক্ষে একজন সুশিক্ষক না দেওয়া পর্যন্ত।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা বর্তমানে পরীক্ষানির্ভর। ১২ বছরে শিক্ষার্থীকে চারটি পরীক্ষা-সেরাত পার হতে হয়। বর্তমান পদ্ধতির সুবাদে পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া গেলেও জ্ঞানের সীমা থাকে প্রান্তিকতম পর্যায়ে। মধ্যপ্রাচ্যের একটি ইংরেজি-মাধ্যম বিদ্যালয়ে ‘ও এবং এ লেভেল’ শিক্ষার্থী স¤পর্কে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায়ও এই কথারই প্রতিচিত্র পাওয়া গিয়েছে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের পরীক্ষায় অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীই সর্বাধিক নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। কিন্তু পঠিত বিষয়ে সামান্য ঘুরিয়ে প্রশ্ন করা হলে বিষয়টি ভালোভাবে জানা থাকার পরও ছাত্রছাত্রী উত্তর দিতে ব্যর্থ হতো। কারণ পরীক্ষা পদ্ধতি সর্বোচ্চ নম্বর প্রাপ্তি নিশ্চিত করলেও জ্ঞানের গভীরতা তৈরিতে অসমর্থ।
ফলস্বরূপ ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করলেও পাঠ্য বিষয়ে জ্ঞান থাকে সীমিত। তাদের পড়াশোনা, চর্চা, অনুশীলন মার্ক স্কিম নির্ভর যাতে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ থাকে প্রশ্নের কোন অংশের উত্তর কেমন হলে কত নম্বর একজন পরীক্ষার্থী পাবে। মার্ক স্কিম চর্চা করে আশানুরূপ ফল পাওয়া সহজ। বিদ্যালয়ের বাইরে বাকি সময়টুকু মার্ক স্কিম চর্চা করতেই ব্যয় হয়। পাঠ্যবইয়ের বা সিলেবাসের বাইরে তাদের ইচ্ছে থাকলেও অন্য কিছু পড়ার সুযোগ একেবারেই নেই বলা চলে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ গত বছর বেতন বৈষম্য নিরসনের জন্য আন্দোলনে নেমেছিলেন।
বেতন বৃদ্ধির দাবি নিয়ে শিক্ষকরা কখনো আন্দোলন করেছেন সমসাময়িক ইতিহাস তেমন সাক্ষ্য দেয় না। শিক্ষাব্যবস্থা তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলেছে। কিছু ব্যতিক্রম ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়েই। সর্বস্তরের শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধি সরকার তার নিজস্ব সুযোগমতো বিবেচনা করে। তাই নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে কোনোরূপ অসন্তোষ থাকলেও আন্দোলনের হুমকি নেই, ছিল না।
সামাজিক মর্যাদা, কাজের গুরুত্ব বিবেচনায় যাদের আমরা জাতি গঠনের কারিগর বলে প্রশংসা করি, তাদের আর্থিক প্রণোদনা, পেশাগত উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ, পেশাভিত্তিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি নিশ্চিত করা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রয়োজন মাফিক নয়। শিক্ষকসমাজ অন্যান্য পেশাজীবীর মতো ইচ্ছে করলেই দাবিদাওয়া নিয়ে রাস্তায় নামতে পারেন না। যখন-তখন আন্দোলনের মাধ্যমে দেশে অচলাবস্থা সৃষ্টি করেন না।
শিক্ষক সমাজে রয়েছে বিভাজন, যেমন সরকারি শিক্ষক, বেসরকারি শিক্ষক, এমপিওভুক্ত শিক্ষক, নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষক প্রভৃতি। এই বিভাজনের কারণে রয়েছে বেতনের বৈষম্য। প্রাসঙ্গিক সুযোগ-সুবিধার অভাব। বিভিন্ন সরকারি বিভাগের সঙ্গেও শিক্ষকদের সাধারণ বৈষম্য বিদ্যমান। বেতনের বাইরে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা যেমন পরিবহন, আবাসন ইত্যাদি ক্ষেত্রেও শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা সংকুচিত। এরপরও তারা শিক্ষাব্যবস্থা চলমান রাখেন। ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা নির্বিঘœ ও নিয়মিত রাখেন।
জাতীয় ও সামাজিক দায়িত্ব ছাড়াও শিক্ষা বিষয়ক পরিকল্পনার সঙ্গে শিক্ষকদের জড়িত রাখা হয়। বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে তারা সর্বোত্তম পাঠক্রম ও পাঠ্যসূচি কিংবা পুস্তক রচনা করেন। কিন্তু প্রায়ই তাদের পরিশ্রম শতভাগ কাজে লাগে না। বিশেষ করে পাঠ্যসূচি এবং পুস্তকের ক্ষেত্রে দেখা যায় মুদ্রিত হওয়ার পরে কোন অদৃশ্য উপায়ে, সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের অজ্ঞাতে, সবকিছুর খোলনলচে বদলে দেওয়া হয়েছে। এমন তুঘলকি ঘটনা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এনেছে অস্থিরতা।
অপরিকল্পিতভাবে স্কুলভবন বিন্যস্ত করা হয়। নতুন ভবন নির্মাণের সময় ছাত্রছাত্রীদের খেলাধুলার জন্য খোলা জায়গার ব্যবস্থা সংকুচিত হয়। পুরাতন ভবন এইসব ক্ষেত্রে ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণ করলে জায়গার সংকট অনেকাংশেই কম হতে পারে। তাছাড়া সুদূরপ্রসারী চিন্তা-ভাবনা থেকে যদি বহুতল ভবনের পরিকল্পনা নেওয়া হয় তাহলেও স্থান সংকট কম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, তদারক এবং মনিটরিং নিয়মিত করা গেলে শিক্ষার মান আরো উন্নত হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার ক্ষেত্রে বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কলেজ পর্যায়ে মনিটরিং সম্প্রসারণের সম্ভাব্যতা বিবেচনা করা যায়।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিক্ষকদের মর্যাদা এবং আর্থিক প্রণোদনার বিষয়টি বিবেচনা করলে বাংলাদেশের শিক্ষকদের অবস্থান উল্লেখযোগ্য রকমে পিছিয়ে আছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা একজন মানুষের আজীবনের ভিত্তি তৈরির কেন্দ্র। সেখানকার শিক্ষকদের যোগ্যতা মানসম্মত হলে প্রমিত শিক্ষা নিশ্চিত হবে। অন্যান্য সরকারি চাকরির তুলনায় বেতনের বৈষম্য থাকায় মেধাবীদের এ ক্ষেত্রে আগ্রহ কম। যোগ্য ও মেধাবী শিক্ষকের অভাবে ভবিষ্যৎ নাগরিকের সুশিক্ষায় ত্রুটি থেকেই যাবে। শিক্ষার এই ত্রুটি আমৃত্যু জাতি, সমাজ ও ব্যক্তিকে পীড়িত করবে।
সমাজে দুধরনের শিক্ষক দেখা যায়। ১. স্বেচ্ছায় শিক্ষক- যিনি নিজের বিবেচনায়, ইচ্ছায় শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হয়েছেন। ২. অনিচ্ছায় শিক্ষক- অন্য কোনো পেশায় যুক্ত হতে না পেরে তিনি শিক্ষকতা শুরু করেছেন। অনিচ্ছাকৃত শিক্ষকরাও এক সময় পেশার প্রতি নিবেদিত হয়ে ওঠেন, কিছু ব্যতিক্রম থাকতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকগণ প্রকৃতি এবং আইনগতভাবে আপাদমস্তক একজন সরকারি কর্মকর্তা। পরিবেশগত কারণে ভার্সিটি শিক্ষক এবং মাঠপর্যায়ে কর্মরত একজন সরকারি কর্মকর্তার মধ্যে সৃষ্টি হয় সুযোগ-সুবিধা, বেতন, ভাতা, পরিবহন, আবাসন প্রভৃতি ক্ষেত্রে দুস্তর ব্যবধান। তারপরও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ নিবেদিতভাবেই শিক্ষা দিয়ে আসছেন। বৈষম্য নিয়ে কখনোই উচ্চকিত নন। পড়াশুনা শেষ করে ছাত্রছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের গ-ি পার হয়ে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেন।
শিক্ষাক্ষেত্রের সার্বিক উন্নয়নের সূচনা করতে পারেন সেই সব ছাত্রছাত্রী। বাস্তবে তারা সবাই জানেন কারা তাদের শিক্ষক কী অবস্থায়, কেমন পরিবেশে, কীভাবে তাদের শিক্ষা দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে গিয়ে তারা ওই পরিবেশের কথা সম্ভবত কাজের চাপে মনে রাখতে পারেন না। নানান রকম কারণে ইচ্ছে থাকলেও হয়তো অবস্থা পরিবর্তনের উদ্যোগ নিতে পারেন না, শত সহানুভূতি থাকলেও।
বাংলাদেশ অত্যন্ত ছোট একটি দেশ। জনসংখ্যা বেশি হলেও ভৌগোলিক কারণে পরস্পরের হদিস ভালোভাবেই রাখা যায়। কে কোথায়, কীভাবে, কোন অবস্থায়, কেমন আছে তার খোঁজ রাখা কঠিন কিছু নয়। পরিকল্পনার মাধ্যমে সীমিত স¤পদের সুষ্ঠু ব্যবহার উন্নয়ন বহুলাংশে ত্বরান্বিত করে।
দরকার সমানুভূতি এবং আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করার মানসিকতা। সবরকম বৈষম্য, বিভেদ, সংকট অতিক্রম করা তখন আর দুঃসাধ্য থাকে না। শিক্ষকদের পরিচালনা, পরামর্শ, তদারকির ভার সঠিকভাবে শিক্ষকদের ওপর দিলে যাবতীয় বিষয়টি সহজেই এবং সুন্দরভাবে পরিচালিত হতে পারে। মাঠপর্যায়ে বাস্তব জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা নিয়ে এক শ্রেণীর দায়িত্ববান মানুষ সর্ববিষয়ে পারদর্শী সেজে শিক্ষাক্ষেত্রে অনর্থক জটিলতা পাকাচ্ছেন।
তাদের পক্ষে সাময়িকভাবে পুচ্ছধারী কাক সেজে, প-িতম্মন্য ভেবে নিজের আত্মতুষ্টি পাওয়া সম্ভব। সম্ভব আরেক শ্রেণীর মানুষের হাততালি ও বাহবা পাওয়া। কিন্তু তাতে জাতির লোকসানের শংকা বাড়ে।