সব শিক্ষক নিবন্ধনধারীদের চাকরি হোক
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মুজিববর্ষে কেউ বেকার থাকবে না। প্রধানমন্ত্রীর এ কথায় শিক্ষিত বেকার বিশেষ করে যাদের স্বপ্ন শিক্ষক হবেন- নিবন্ধনধারীদের মনে আশা সৃষ্টি হয়েছে। যারা শিক্ষক নিবন্ধনধারী, প্রধানমন্ত্রীর কথায় ধরেই নিয়েছেন তারা বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পাবেন। ইতিপূর্বে দু’দফায় শিক্ষক নিবন্ধনধারীদের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিয়েছে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ যা এনটিআরসিএ নামে পরিচিত।
সরকার বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের অপেক্ষাকৃত মেধাবীদের অগ্রাধিকার দিয়েছেন সে লক্ষ্যে শিক্ষক নিবন্ধন প্রক্রিয়া চালু করেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। এ পেশায় আসতে হলে ডিগ্রি অথবা অনার্স মাস্টার্স পাশের পর নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেই উত্তীর্ণ হতে হবে। তারপর মেধাক্রম অনুযায়ী নিয়োগ দেবে এনটিআরসিএ। ইতিপূর্বে ২০১৬ ও ২০১৯ সালে দু’ধাপে বেসরকারি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেওয়া হয়। আগে এসবের কোনো বালাই ছিল না। ম্যানেজিং কমিটি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিল। রাজনৈতিক প্রভাব, প্রভাবশালী ব্যক্তির সুপারিশ বা অর্থ বাণিজ্যের দ্বারা নিয়োগ হত। এতে দুর্বল মেধাবীরা সুযোগ পেত বেশি। এমন অভিযোগ রয়েছে। সঙ্গত কারণে সরকার মানেজিং কমিটির সে ক্ষমতা খর্ব করে। এ পেশায় দক্ষ, সৎ, আদর্শবান ও মেধাবীদের সুযোগদানের লক্ষ্যে সরকার চালু করেছেন শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা। সরকারের এ লক্ষ্য, উদ্দেশ্য যে ভালো এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সমস্যা বয়স নিয়ে।
বিগত ২০১৮ সালের সরকারের জনবল কাঠামো অনুসারে সার্টিফিকেটের বয়স ৩৫ বছর হলে তিনি শিক্ষকতা পেশায় অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। যারা ইতোমধ্যে নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন তাদের অনেকের বয়স ৩৫ বছর ছুঁই ছুঁই আবার কারো ৩৫ বছর পার হয়েছে। যাদের বয়স ৩৫ বছর পেরিয়ে গেছে তাদের ভবিষ্যৎ কী? তাদের স্বপ্ন কি বিফলে যাবে? চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো দরকার। বেঁধে দেওয়া বয়সের কারণেই নিবন্ধনধারী অনেকের হয়তো তাদের স্বপ্ন পূরণ হবে না। যাদের স্বপ্ন ছিল শিক্ষকতার মহান পেশায় এসে লাখো শিক্ষার্থীর মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বেঁধে দেওয়া এ বয়স সীমা নিয়ে বিবেচনা করা অত্যন্ত জরুরি।
উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে যুগের চাহিদা অনুযায়ী এক ধরনের পরীক্ষিত শিক্ষা ব্যবস্থা চালু থাকার ফলে বেকারত্ব কম। আমাদের দেশে স্বাধীনতার ৪৮ বছরে শিক্ষা ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। স্কুল, কলেজ মাদ্রাসা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রতি বছর যে হারে শিক্ষার্থীরা বেরিয়ে আসছে সে হারে কর্মসংস্থান হচ্ছে না।
ফলে বেকার সমস্যার কার্যকর কোনো সমাধানও হচ্ছে না। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা পারছে না বেকারত্বের অবসান ঘটাতে। প্রতিবছর হাজার হাজার বেকারের জন্ম দিচ্ছে দুঃখ কষ্ট অনেক অভিভাবকদের অবশ্যই ব্যথিত করে। তৃতীয় বিশে^র দরিদ্র ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে শিক্ষার অর্থ আত্মকর্মসংস্থানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। নীতি নৈতিকতা প্রকৃত শিক্ষার অর্থ এই নয়, বেকারত্ব থাকা। বেকার জীবন মানেই অভিশপ্ত জীবন। অথচ আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে অর্জন একেবারে কম নয় বরং চোখে পড়ার মতো। শিক্ষা ক্ষেত্রে এ অর্জন বলতে বোঝাতে চাচ্ছি পাবলিক পরীক্ষায় পাশের হার। নারী শিক্ষার প্রসার ঘটেছে, নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে, মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, জীবনযাত্রার মানেও উন্নয়ন ঘটেছে। নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের পথে। এককথায় বলা যেতে পারে দেশ ক্রমান্বয়ে উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একটি রাষ্ট্রের মূল কারিগর হচ্ছে দক্ষ মানবসম্পদ। জনসংখ্যা একটি দেশের উন্নয়নের প্রধান প্রতিবন্ধক নয়, যদি বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠিকে মানসম্মত শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করা যায়। কেন না শিক্ষা ছাড়া কোনো দেশ টেকসই উন্নয়নের পথে যেতে পারে না। আর শিক্ষা ছাড়া কখনই দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি হতে পারে না। এ জন্য উন্নত রাষ্ট্রগুলোর শিক্ষাব্যবস্থা, পরীক্ষা পদ্ধতি সে রাষ্ট্রকে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে দিয়ে বেকারত্বের অবসান ঘটিয়ে আত্মকর্মসংস্থান ও আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনে কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে সে ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা ও পরীক্ষা পদ্ধতি চালু রয়েছে।
একটি গণমুখী উন্নত মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা বেকারত্বের অবসান ঘটিয়ে দেশকে দ্রুত টেকসই উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা বেকারত্ব সমাধানের কোনো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই।
দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসে এক গবেষণায় দেখা যায়, মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী তরুণদের এক-তৃতীয়াংশ বেকার। গবেষণায় বলা হয় শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে সম্পূর্ণ বেকার ৩৩ শতাংশের ওপর। শিক্ষিত বেকারের হার পাশর্^বর্তী দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশে অনেক বেশি। অন্য কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থা। পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে কর্মসংস্থান বা চাকরির একটা সমন্বয় রয়েছে। আমাদের দেশে মাত্র একটি শূন্য পদের বিপরীতে শত শত আবেদন। এমন এক ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে যেখানে পাবলিক পরীক্ষায় পাশের হার বেশি। তাই বেকারের সংখ্যাও প্রতি বছর বাড়ছে। বর্তমানে দেশের লাখ লাখ ছেলেমেয়ে উচ্চ শিক্ষিত, তাদের সনদ আছে কিন্তু চাকরি নেই।
এক তথ্যমতে, বর্তমান ২৭ লাখ কর্মক্ষম ছেলেমেয়ে বেকার। এদের মধ্যে অনেকের শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় পাশের সনদ রয়েছে কিন্তু বয়সের বাধ্যবাধকতায় এখন পর্যন্ত তাদের কোনো স্কুল, কলেজ বা মাদ্রাসায় চাকরি না হওয়ায় তারা অনেকেই হতাশ। তাদের প্রাণ গুমরে গুমরে কাঁদছে। শিক্ষকতার মহান পেশায় আসবে বলেই তো বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত তরুণ তরুণী শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হয় তাদের স্বপ্ন পূরণের জন্য। কিন্তু এ স্বপ্ন পূরণ না হলে অনেকের জীবনে নেমে আসবে হতাশা। তবে জীবনধারনের জন্য হয়ত অনিচ্ছাকৃতভাবে অন্য পেশা বেছে নেবে।
বর্তমানে দেশে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৫৮ হাজার শূন্য পদ রয়েছে। পদগুলোতে সরকারিভাবে নিয়োগে হবে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী তাই মুজিববর্ষে ৫৮ হাজার শূন্য পদের বিপরীতে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হোক।
বিগত ২০১৬ ও ২০১৯ সালে নিয়োগ দেওয়া হয় শূন্য পদের বিপরীতে অনেক কম। কিন্তু এখনও যারা নিয়োগপ্রাপ্ত হননি, অথবা মেধাতালিকায় স্থান পেয়েছেন তারা সবাই মুজিববর্ষে নিয়োগ পাবেন এমন প্রত্যাশা তাদের। কেননা শিক্ষক নিবন্ধনধারীরা কেউ আর বেকার থাকতে চায় না। তবে শিক্ষক নিবন্ধনধারীদের অনেকেই হয়ত অন্য কোনো পেশায় যোগদান করেছেন। প্রতি বছর যেমন নিবন্ধনধারীদের সংখ্যা বাড়ছে তেমনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনেক পদ শূন্যও হচ্ছে। দীর্ঘদিন থেকে শূন্য পদগুলো প্রতিষ্ঠানে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক না থাকায় স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা বা পাঠদান কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। তাই অগণিত শিক্ষার্থীর পাঠদানের সমস্যা সমাধানে অতি দ্রুত শূন্য পদের বিপরীতে নিয়োগ দেওয়া হোক। শোনা যাচ্ছে, চলতি মার্চ মাসেই কোনো একদিন এনটিআরসিএ অনলাইনে নিবন্ধনধারীদের আবেদন আহ্বান করবেন। তাই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের মধ্যে দিয়ে শিক্ষিত তরুণ নিবন্ধনধারীদের বেকারত্বের অবসান ঘটুক। নিজের মেধা কাজে লাগিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান রাখুক।
পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে, তরুণরাই রাষ্ট্রকে উন্নত সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত থেকে। আমাদের দেশটাও তারুণ্যনির্ভর। কিন্তু বেকারত্ব দূরীকরণে যুব তরুণ সমাজকে কাজে লাগিয়ে ইতোমধ্যে চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। বাংলাদেশের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ বেকারত্ব। জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ কর্মহীন। শিক্ষিত, অর্ধ-শিক্ষিত বেকার যুবকদের অভিভাবকদের আয়ের ওপর চলতে হয়। প্রতি বছর শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। তা সমাজে নানা অস্থিরতার সৃষ্টি করছে। প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে। উচ্চ শিক্ষা নিতে আসা শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য থাকে জীবন জীবিকা নির্বাহ করার মতো একটি চাকরি। কিন্তু উচ্চ শিক্ষা গ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ প্রতি বছর বেকার থেকে যাচ্ছে। তাদের সরকারি চাকরির বয়সও শেষ হয়। কিন্তু কর্মসংস্থান হয় না। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়া শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বড় স্বপ্ন, প্রধান আকর্ষণ, চাকরি। সরকার বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিযোগের ক্ষেত্রে অধিকতর স্বচ্ছতা ও মেধাবীদের নিয়োগ দেওয়ার লক্ষ্যে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। দেশের হাজার হাজার শিক্ষিত বেকার নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। কোনো শিক্ষিত ব্যক্তি বেকার থাকতে চায় না।
শিক্ষিত তরুণদের চাহিদা একটি ভালো চাকরি। উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা খুব কঠিন কাজ নয়। বর্তমানে দেশে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শূন্য পদ রয়েছে। এ শূন্য পদগুলোতে নিয়োগ দিলে সমান সংখ্যক শিক্ষিত বেকারের কর্মসংস্থান হবে। শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। এ পেশায় অনেক নীতি ও আদর্শের গল্প আমরা ছাত্রজীবনে পড়েছি। সময়ের পরিবর্তনে যুগের পরিবর্তনে দেশ আজ অনেক এগিয়ে। বড় সমস্যা বেকারত্ব। বেকারত্ব মানেই অভিশপ্ত জীবন। পিতা-মাতার বোঝা। শিক্ষা জীবন শেষে স্বপ্ন পূরণে যারা নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কোনো ছোটখাটো কাজ অথবা বেকার হয়ে বসে আছে তাদের বড় স্বপ্ন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরি। তাই নিবন্ধনধারীদের স্বপ্ন পূরণে প্রধানমন্ত্রীর নিকট বিনীত অনুরোধ, মুজিববর্ষে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শূন্য পদের বিপরীতে নিবন্ধনধারীদের দ্রুত নিয়োগ দেওয়া হোক। আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হোক। বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাক দেশ।
রাসেল আহম্মেদ : সহকারী অফিসার, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লি., জয়পুরহাট শাখা