সবারই প্রিয় আয়া সোফিয়া মসজিদ
নিউজ ডেস্ক।।
‘হেই লম্বা পোশাক পরতে হবে। ওই দিকে যাও, লম্বা পোশাক সংগ্রহ করো।’ ইস্তাম্বুলের বিখ্যাত আয়া সোফিয়া মসজিদে প্রবেশের সময় এই নির্দেশনা প্রবেশ পথে দাঁড়ানো নিরাপত্তা কর্মীদের। মসজিদে শালীন পোশাক পরেই মানুষ আসবেন এটাই স্বাভাবিক। সাধারণত মুসল্লিরাই যান মসজিদে। কিন্তু আয়া সোফিয়াসহ তুরস্কের বিভিন্ন ঐতিহাসিক মসজিদে মুসলমানদের পাশাপাশি অন্য ধর্মের মানুষও নিত্য দেখতে যান।
ভিন্নধর্মী এই মানুষগুলোর মধ্যে শালীন পোশাকের কোনো বালাই নেই। তারা তাদের মতো করে স্বল্প পোশাকে চলে আসে মসজিদে। তাই আয়া সোফিয়া মসজিদে প্রবেশের সময় তাদের লম্বা পোশাকে শরীর ঢাকার নির্দেশনা। অবশ্য এতে কোনো আপত্তি করতে দেখা গেল না খোলামেলা পোশাক পরা মানুষগুলোকে। নির্দিষ্ট কাউন্টারে গিয়ে তারা লম্বা পোশাক এবং স্কার্ফ সংগ্রহ করে। এরপর প্রবেশ করে আয়া সোফিয়া মসজিদে। কেউ স্কার্ফ পরতে না পারলে মুসলিম মহিলারা তা পরিয়ে দেন।
তুরস্কের ইস্তাম্বুলের বসফরাস প্রণালীর পাশেই অবস্থিত আয়া সোফিয়া মসজিদ।
এর পাশেই ব্লু মসজিদ বা সুলতান আহমেদ মসজিদ এবং মহানবীর সা: ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জামসহ আরো চার নবীর ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসের সংগ্রহস্থল তোপকাপি প্যালেসের অবস্থান। মেট্রোতে সুলতান আহমদ স্টেশনে নামলেই হাতের ডান পাশে ব্লু মসজিদ। এই মসজিদের সামনে থাকা পার্কের অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে আয়া সোফিয়া মসজিদ। এই আয়া সোফিয়া মসজিদটি বিখ্যাত হওয়ার কারণ, এটি এক সময় ছিল খ্রিষ্টানদের গির্জা। পরে মুসলমানরা এটাকে মসজিদে রূপান্তরিত করে। ওসমানীয় (অটোমান) শাসনের অবসানের পর ধর্মনিরপেক্ষ তুর্কি সরকার এই আয়া সোফিয়ায় নামাজ বন্ধ করে এটিকে জাদুঘর বানায়। ২০২০ সালে তুরস্কের বর্তমান রজব তাইয়েব এরদোগান সরকার ফের আয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরিত করে। এখন এতে নিয়মিত নামাজ হচ্ছে। ২০১৫ ও ২০১৯ সালে এটি ছিল তুরস্কের সবচেয়ে বেশি পর্যটক আকর্ষণের স্থান।
রোমান শাসক প্রথম জাস্টিনিয়ান এই গির্জা নির্মাণ করেন ৫৩২ থেকে ৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দে। ওসমানীয় শাসকের হাতে কন্সটান্টিনোপল পতনের পর ১৪৫২ সালে আয়া সোফিয়া মসজিদে রূপান্তরিত হয়। তখন এটিই ছিল প্রধান মসজিদ। পরে ১৬১৬ সালে পাশে সুলতান আহমদ মসজিদ নির্মিত হলে সেটিই হয়ে যায় প্রধান মসজিদ।
পোশাকে অবশ্য তুরস্কে মুসলমান এবং অন্য ধর্মের মানুষ পার্থক্য করা কঠিন। মুসলমান মহিলারা দিব্যি পাশ্চাত্য ফ্যাশনের খোলামেলা পোশাক পরে রাস্তায় চলাচল করেন।
পুরুষদের মধ্যে হাফ প্যান্ট পরে রাস্তায় বের হওয়ার সংস্কৃতি এখনো আছে। পাশাপাশি হিজাব বা বোরকা পরা মহিলাও পাওয়া যাবে। দাড়িওয়ালা এবং টুপি পরা মুসলমান পুরুষের সংখ্যাও কম নয়। তাই যারা আয়া সোফিয়া মসজিদ দেখতে আসছেন পশ্চিমা ফ্যাশনের পোশাক পরে, তারা সবাই যে অন্য ধর্মের তা বলা কঠিন।
লম্বা লাইন পেরিয়ে নিরাপত্তা তল্লাশি শেষেই আয়া সোফিয়া মসজিদে প্রবেশ করতে হয়। এরপরই লম্বা বা শালীন পোশাক পরার নির্দেশনা নিরাপত্তা কর্মীদের। পুরুষদের সাথে মহিলা নিরাপত্তা কর্মীও আছেন। এই মহিলা নিরাপত্তা কর্মীরা হিজাব পরান। নিরাপত্তা তল্লাশি শেষে সামনে ডান পাশে থাকা গেট দিয়ে প্রবেশ করতে হয় মসজিদ চত্বরে। এই গেট দিয়ে প্রবেশ করতেই অজুখানা। চারপাশ খোলা গোলাকৃতির এই অজুখানার ছাদটা ছোট একটা গম্বুজ। আসলে তুরস্কের সব মসজিদের অজুখানার ছাদ মসজিদের গম্বুজের সাথে মিল রেখে করা হয়।
মসজিদে ঢুকতেই বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শনের দেখা মেলে। এরপর নামাজের মূল স্থান। এই স্থানটি কয়েক ভাগে বিভক্ত। বিভিন্ন ওয়াক্তের নামাজের জন্য সামনের দুই অংশ ব্যবহৃত হয়। একেবারে সামনের অংশে নামাজি ছাড়া কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। ব্যারিকেড দিয়ে তাতে লেখা আছে এই অংশ মুসল্লিদের জন্য। মাঝের অংশে পর্যটকরা হাঁটাচলা করতে পারেন। তবে নামাজ শুরু হলে এখানে কোনো মহিলাকে আর থাকতে দেয়া হয় না। তাদের তখন সরিয়ে দেয়া হয় পেছনের অংশে। তবে মহিলাদের নামাজের জন্য বাম পাশে আলাদা জায়গা আছে। মসজিদের মাঝখানের ডান দিকে ইমামের জায়গা। কাঠের তৈরি ছাদ আছে।
সেখানে বসে একজন দোয়া দরূদ পড়েন। ঠিক নামাজের সময় ইমাম মিম্বারের কাছে যান। নামাজ শেষেই কাঠের ছাদে থাকা লোকটি দোয়া দরূদ পড়া শুরু করেন। এই মসজিদে জামায়াতে আসরের নামাজ পড়ার সুযোগ হয়েছিল। ৫৫ মিটার (১৮০ ফুট) উচ্চতাসম্পন্ন এই মসজিদ ৭৩ মিটার প্রশস্ত। এটি বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছে।
বিশাল গম্বুজের দেয়ালে সামনের অংশে লাগানো আছে আল্লাহু ও মুহাম্মদ লেখা বিশাল দু’টি বোর্ড। বেশ কয়েকটি গম্বুজের সমন্বয়ে এই মসজিদ। বিভিন্ন নকশা করা। রয়েছে কুরআনের আয়াতও।
তবে এখানে আগে থাকা খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় বিশ্বাসের বিভিন্ন ছবি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এই নিয়ে একটু মনোকষ্ট পেতে দেখা গেল গ্রিস থেকে আসা এক দম্পতির। বসনিয়া থেকে আনিস তার স্ত্রীকে নিয়ে দেখতে এসেছেন এই মসজিদ। তারা দারুণ খুশি এই ঐতিহাসিক স্থাপনা দেখতে পেরে। মসজিদের ডান পাশে নিচের একটি রুমে সংরক্ষিত বিভিন্ন সাইজের কুরআন মাজিদ। রেহেলের ওপর খোলা অবস্থায় রাখা হয়েছে সেগুলো। তবে সেই রুমে প্রবেশের অনুমতি নেই। বেশ কয়েকটি পথেই বের হওয়া যায় মূল মসজিদের অংশ থেকে।
১৯৩১ সাল পর্যন্ত এই আয়া সোফিয়া মসজিদে নিয়মিত নামাজ হতো। এরপর চার বছর বন্ধ রাখা হয় এটি। ১৯৩৫ সালে ফের এটি জনগণের জন্য উন্মুক্ত করা হলেও তা জাদুঘর পরিচয়ে। আর এখন এই মসজিদের মাইকে দিনে পাঁচবার আজান হচ্ছে।