সন্ধ্যা নামলেই অপরাধের স্বর্গরাজ্য
নিজস্ব প্রতিবেদক।।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঢাকার অন্যতম একটি বিনোদন কেন্দ্র। সকালে এখানে নগরীর নানা পেশার মানুষ আসেন শরীরচর্চা করতে। দিনের আলো বাড়লে নানান বয়সের মানুষ আসেন ঘুরতে। উদ্যানের ভেতরে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, শিখা চিরন্তন, মুক্তমঞ্চ, রমনা কালী মন্দিরসহ কয়েকটি দর্শনীয় স্থান থাকায় এখানে ঢাকা ও আশপাশের অনেক মানুষই আসেন। ছুটির দিন ছাড়াও সন্ধ্যা পর্যন্ত উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করে। দিনের আলোয় স্রেফ একটি বিনোদন কেন্দ্র হলেও রাত নামার সাথে সাথেই বদলাতে থাকে প্রকৃত চিত্র। সন্ধ্যা নামলেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পরিণত হয় অপরাধের স্বর্গরাজ্যে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, সন্ধ্যা নামলেই মুক্তমঞ্চে (শিল্পকলা একাডেমির নির্মিত উন্মুক্ত নাট্যমঞ্চ) বসে গাঁজার আসর। এখানে যারা গাঁজা সেবন করতে আসে তাদের অধিকাংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থী। এ ছাড়া শাহবাগ ও আশপাশের এলাকার কিছু বিপদগামী তরুণ, যুবক ও রিকশাওয়ালা এখানকার নিয়মিত গাঁজা সেবক। এ ছাড়াও শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা মাদকসেবীরাও মুক্তমঞ্চে গাঁজার আড্ডা বসান। তবে শুধু মুক্তমঞ্চই না, সারা উদ্যান ঘুরেফিরে দেখা যায় একই দৃশ্য। কিছু শিক্ষার্থীর গাঁজা সেবনের বিষয়টি এখন একপ্রকার ওপেন সিক্রেট, সবাই জানে কিন্তু যেন কেউই জানে না।
উদ্যানে সাধারণত যারা গাঁজা বিক্রি করে তাদের বেশির ভাগই নারী। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচিত একজনের নাম পারুল। কখনো বোরকা, কখনো শাড়ির আঁচলের নিচে পোঁটলায় করে এ দিকে সে দিক ঘুরে লোকভেদে ২০ থেকে ৬০ টাকায় গাঁজা বিক্রি করে থাকে তারা। এই পারুল সমন্ধে উদ্যানে লোকজন বলে থাকে, পারুল মাসে অন্তত ১০ দিন পুলিশের কাছে গ্রেফতার হয়ে থানায় থাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে গ্রেফতার করে ঠিকই কিন্তু এক দুই দিনের বেশি সে থানায় থাকে না। কোন এক অদ্ভুত ক্ষমতাবলে আবার বের হয়। তার অনুপস্থিতিতে গাঁজা বিক্রির ভার পড়ে অন্যদের ওপর।
জানা যায়, ঢাবির যেসব শিক্ষার্থী এখানে গাঁজা সেবন করতে আসে তাদের অধিকাংশই কেন না। বেশির ভাগই বাইর থেকে আসা লোকজন কিনলে তাদের থেকে জোর-জবরদস্তি করে ছিনিয়ে নেয়। গাঁজার পাশাপাশি অন্য মাদক সেবনকারী শিক্ষার্থীরা স্থানীয় মাদকসেবী ও ছিনতাইকারী চক্রের সাথে যোগসাজশে জড়িয়ে পড়েন নানান অপকর্মে।
অনুসন্ধানের তথ্যানুযায়ী, গাঁজা সেবনকারী শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সন্ধ্যায় আসে এবং সেবন করেই চলে যায়। তবে শিক্ষার্থীদের একটি ছোট অংশ (যারা গাঁজা ছাড়াও অন্য মাদক সেবন করে) স্থানীয় মাদকসেবীদের সাথে মিলে উদ্যান, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও আশপাশের এলাকায় করে ছিনতাই ও চাঁদাবাজি। মাদকের অর্থ সংগ্রহই মূলত এসব ছিনতাইয়ের কারণ।
বিভিন্ন পত্রপত্রিকা থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও শাহবাগ থানা সূত্র জানায়, গত ১০ মাসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও এর আশপাশের এলাকার অর্ধশতাধিক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্টতা থাকায় সঠিক তদন্ত ও বিচার হয় না এবং ছিনতাইকারীদের নাম প্রকাশ করতেও অনাগ্রহ দেখান থানা সংশ্লিষ্ট সূত্র। এগুলো ছাড়াও সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশ না হওয়া ও থানায় অভিযোগ না পৌঁছানো ছিনতাইয়ের সংখ্যা আরো বেশি।
মাদক ও ছিনতাইয়ের পাশাপাশি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আরেক আতঙ্কের নাম ভাসমান যৌনকর্মী। সাধারণত সন্ধ্যার পরপরই ঘুরতে আসা লোকজনকে বের করে দেন আনসার সদস্যরা। তবে কালিমন্দির গেট দিয়ে পার্কে ঢুকে পড়ে যৌনকর্মীরা। তা ছাড়া টিএসসি মোড় সংলগ্ন গেট অন্ধকার থাকায় সেখান দিয়েও ঢোকে তারা। পাশাপাশি আশ্রয়হীন যারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রাতে ঘুমান তাদেরও অধিকাংশই এই পেশায় জড়িত।
অভিযোগ আছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা রক্ষীরা সামান্য টাকার বিনিময়ে ভাসমান যৌনকর্মীদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেন। এ ক্ষেত্রেও তাদের কাস্টমার পূর্বের চরিত্রের লোকজনই। তবে যৌনকর্মীর একটা বড় অংশ উদ্যানে বসবাসকারী ভাসমান লোকজন হওয়ায় এ বিষয়ে চাইলেও কড়াকড়ি করতে অপারগতার কথা শিকার করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নিরাপত্তা কর্মী। তিনি নয়া দিগন্তকে জানান, আমরা চেষ্টা করি লোকজন যাতে না ঢুকতে পারে। তবে সবসময় সেটা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয় না।
সার্বিক বিষয়ে অবগত করে শাহবাগ থানা পুলিশের অবস্থান জানতে চাইলে ওসি নুর মোহাম্মদ বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান একটা বিশি জায়গা, এর যে সাত থেকে আটটা গেট আছে এগুলো দিয়ে মাঝে মধ্যে ঢুকা যায়। অনেকে রাতের অন্ধকারে, চিপায়, জঙ্গলে বসে এসব সেবন করে। আমরা প্রতিদিন ও রাতে যারা এই ধরনের কাজ করে তাদের ধরে নিয়ে আসি এবং চালান করার ব্যবস্থা করি। অনেকে বিভিন্ন জায়গা থেকে আসে আমরা তাদের ধরে মামলা দিই।