সন্তানকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের আবেগঘন স্টাটাস
নিউজ ডেস্ক।।
সন্তানকে নিয়ে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়ার সাবেক উপাচার্যের আবেগঘন স্টাটাস:
স্টাটাসটি হুবুহু দেওয়া হলো---
ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে
সেদিনের সেই ছোট্ট ছেলেটা দেখতে দেখতে অনেক বড় হয়ে গেলো। এইতো সেদিনের ঘটনা। রংপুরের আর জি হাসপাতালে ওর জন্ম হলো। এমারজেন্সি সিজারিয়ান। ডাক্তার প্রখ্যাত গাইনোকলজিস্ট আজিজুল ইসলাম। দাঁড়িপাল্লা ধরার ভঙ্গিতে শিশুর দুই পা উল্টো করে শূন্যে তুলে অর্থনীতি মাস্টার্সের ছাত্রী মায়ের সামনে ধরে বলেন: “এই নেন, একটা অমর্ত্য সেন দিলাম।“ বলা বাহুল্য, আগের বছর অমর্ত্য সেন অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছেন। শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে মা মুখে সলাজ হাসি টেনে বলে: দোয়া করবেন।
কিন্তু শিশুর মুখে হাসি নাই। কুঁচকানো কপাল। মনে হয় টেনে হেঁচড়ে ঘুম ভাঙ্গানো হয়েছে। অসময়ে ঘুম থেকে উঠে মহা বিরক্তি নিয়ে ডাক্তার-নার্সসহ বাপ-মা সবার দিকে পিট পিট করে তাকাচ্ছে।
দাদু জোড়া খাসী কোরবানি করে নাম রাখলেন হুমায়ুন রাশিদ আসকারী। হুমায়ুন নামের মানুষেরা নাকি বিখ্যাত হয়। হুমায়ূন আহমেদ, হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ুন কবির, হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী...। আমি দুষ্টুমি করে বলি: মোগল সম্রাট হুমায়ূন কিন্তু সাম্রাজ্য খুইয়েছে। তিনি তো ব্যর্থ হয়েছেন। বাবাও কমে যাবার নন। বলেন: তবুও সে তো সফলতম মোগল সম্রাটের বাবা।
হুমায়ুন দাদুর দেয়া নাম নিয়ে বড়ো হচ্ছে। তবে সমরেশ মজুমদারের ভক্ত ওর মা তার প্রিয় উপন্যাস কালপুরুষ-এর নায়কের নাম ধার করে ওর ডাকনাম রাখেন “অর্ক” ।
আমার পঠন-পাঠন কলা বিভাগে। অর্কর মার ধারণা আর্টস-পড়ুয়া মানুষেরা খুব একটা মেধাবী হয়না। তাঁর সন্তানকে তিনি বরাবরই বিজ্ঞান বিভাগে পড়াতে চেয়েছেন। অর্ককেও চাইতেন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানাতে। আমিও অনেকটা বাঙ্গালি সমাজের দীর্ঘবাহিত প্রথাকাতরতা থেকে তাতেই সায় দিতাম। তবে মনে ভয় থাকতো, জেনেটিক ম্যাথ ফোবিয়া আবার তীরে নিয়ে তরী ডুবিয়ে দেয় কি না। তবে অর্কই আমাদের এই টানাপড়েন থেকে রক্ষা করে। ও স্বেচ্ছায়, সানন্দে বেছে নিয়েছে বিজনেস বিশ্ব অধ্যয়নের বিষয়টি । আগ্রহ-উদ্দীপনা- লক্ষ্য ও পরিশ্রম থাকলে যে ভালো ফল অর্জন করা যায়, তা সে প্রমান করেছে।
আজকে ওর বি বি এ অনার্সের রেজাল্ট বেরিয়েছে। আজ থেকে ও গ্র্যাজুয়েট। পোর্ট ম্যানেজমেন্ট এন্ড লজিস্টিকস বিষয়ে। বঙ্গবন্ধু মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বিভাগে ও ফ্যাকাল্টিতে প্রথম হয়েছে। ওর আনন্দ দেখে আমার আরো বেশি আনন্দ হচ্ছে। ওর মায়ের আরো আরো বেশি বেশি আনন্দ হচ্ছে। মানুষ নাকি দুজনের কাছে পরাজিত হয়ে আনন্দ পায়—সন্তান আর ছাত্র। আমরা চাই আমাদের সন্তানেরা আমাদের ছাড়িয়ে যাক অনেক অনেক গুনে। সন্তানের প্রশ্নে আমরা বাঙ্গালীরা ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের সেই ঈশ্বরী পাটুনীর মতো যে অন্নপুর্ণা দেবীর কাছে বর চেয়েছিলো এই বলে যে “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।“
আমার শুনে ভালো লাগে আমার ছেলে শিক্ষক হতে চায়। আমি তিন দশকের বেশি সময় ধরে শিক্ষকতা করছি। আমার পিতা ছিলেন শিক্ষক, এমনকি আমার পিতামহ অর্থাৎ অর্কর প্রপিতামহও ছিলেন শিক্ষক। কিন্তু আমরা কেউ উল্লেখযোগ্য গবেষক নই। অর্ক উল্লেখযোগ্য গবেষক হতে চায়। ছাত্রাবস্থায় তার দুটো গবেষণাপত্র আন্তর্জাতিক ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। আরো কয়েকটি প্রকাশের অপেক্ষায় আছে।
আমার শিক্ষক প্রফেসর সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, “ [দেশে] কোনো বিজ্ঞানী নেই। গবেষক নেই, দার্শনিক নেই। যেদিকে তাকাবেন, শুধুই প্রশাসক।“ এই অবস্থায় গবেষণাকে যারা পেশা এবং নেশা হিসেবে আলিঙ্গন করতে চায়, তাদের উৎসাহিত করা দরকার প্রবলভাবে।
তবে সবচেয়ে বড়ো কথা হলো সবার আগে ভালো মানুষ হতে হবে। আমার বাবা ছেলেবেলায় আমাকে ডাঃ লুৎফর রহমানের বই—উন্নত জীবন, মহৎ জীবন উপহার দিতেন। তাৎপর্যপূর্ণ বাক্যগুলি আন্ডারলাইন করে দিতেন। সেরকম একটা বাক্য: “দুর্জন বিদ্বান হইলেও পরিত্যাজ্য। সর্পের মস্তকে মণি থাকিলেও সে কি ভয়ঙ্কর নহে?” মণিযুক্ত বিষধর সাপের চাইতে মনিহীন নির্বিষ সাপের কাছেই মানব সমাজ বেশি নিরাপদ।
ভালো মানুষ হও। দেশকে ভালোবাসো। দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কে গবেষণার দুর্গ হিসেবে গড়ে তোলো--এই প্রত্যাশা বাবাদের প্রজন্মের পক্ষ থেকে হুমায়ুনদের প্রজন্মের প্রতি রইলো।