শ্রদ্ধার প্রকাশ না প্রদর্শন?
কাকন রেজা ।।
শ্রদ্ধা আর আনুষ্ঠানিকতা দুটোর মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। বছর তিন বা দুয়েক আগে সম্ভবত এক সুশীল অভিনেত্রীকে আমরা দেখেছি শহিদ মিনারে জুতা পায়ে ওঠা নিয়ে ছবক দিতে। আবার সেই ছবককে তবক মুড়িয়ে তিনি নিজেই জুতা পায়ে শহিদ মিনারে উঠেছেন। শ্রদ্ধা আর আনুষ্ঠানিকতার ফারাকটা এখানেই।
ওই অভিনেত্রী জুতা পায়ে শহিদ মিনারে যারা ওঠেন তাদের পারিবারিক শিক্ষা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করছিলেন। অথচ নিজে যখন ধরা খেয়েছেন তখন মুহূর্তে পল্টি মেরেছেন। পাল্টে ফেলেছেন আগের জবান। যারা শ্রদ্ধা করেন তাদের জন্য প্রকাশটা কোনো বিষয় নয়। বিপরীতে যারা প্রকাশ করেন তাদের কাছে শ্রদ্ধাটা কোনো বিষয় নয়। যেহেতু তারা পল্টিতে অভ্যস্ত।
এই ভূমিকা কেন, প্রশ্ন করতে পারেন। প্রশ্নের অন্তত দুটি কারণ রয়েছে। প্রথম কারণটা হলো, একটা কুতর্ক সৃষ্টির প্রয়াসকে কেন্দ্র করে। কুতর্কটি কেমন, ইসলামে মিনারে ফুল দেয়া নিষেধ এবং অন্তত একজন ইমামকে নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়েছে, তিনি নামাজের খুতবায় এমনটা বলেছেন। তাকে দায়ি করা হয়েছে ফতোয়াবাজির কোটায়। এটা স্রেফ একটা কুতর্ক। বাংলাদেশে অনেক ইসলামী দল রয়েছে, যারা শহিদ মিনারে ফুল দিতে যায় না। তারা মাহফিল করে শহিদদের জন্য দোয়া চায়। এক্ষেত্রে শ্রদ্ধাটা যদি মন থেকে হয়। যে কারণে শহিদগণ জীবন দান করেছেন, সেই কারণটাকে যদি শ্রদ্ধা করে দোয়া করা হয়, তাহলে আপত্তিটা কোথায়। ফুল দিতেই হবে এমনটা বাধ্য করা হয়নি। জোর জবরদস্তি নেই।
আমি নিজে ফুল দিতে যাই। দিই। আমার এই যাওয়াটাকে আমি যেমন শ্রদ্ধার চোখে দেখি, তেমনি অন্যের যাওয়ার বদলে দোয়াটাকেও শ্রদ্ধার চোখে দেখি। কারণ, দোয়ার মাধ্যমে শহিদদের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাই প্রকাশিত হয়। আমার প্রকাশটা ফুল দেয়ার মাধ্যমে। খেয়াল করবেন, আমি ব্যবহার করেছি ‘প্রকাশ’ শব্দটি, ‘প্রদর্শন’ নয়। প্রকাশ আর প্রদর্শনের মধ্যে পার্থক্য হলো প্রকাশে আত্মা থাকে, প্রদর্শনে আনুষ্ঠানিকতা। আচরণ বলতে পারেন। শ্রদ্ধা হলো মূল সংস্কৃতি। আর ফুল, দোয়া, প্রার্থনা বা অন্য কিছু হলো তার আচরণ। অর্থাৎ সাংস্কৃতিক আচরণ। আচরণের সাথে সরল চোখে শ্রদ্ধার কোনো সাংঘর্ষিক অবস্থান নেই।কিন্তু ওই যে অভিনেত্রীর কথা বললাম শুরুতে, তার কথার মধ্যে যে বৈপরিত্য সেটাই হলো আচরণ আর শ্রদ্ধার মধ্যে সুক্ষ্ন দাগের পার্থক্য।
আরেকটু সোজা করে বলি। কোন কিছু যখন শুধু আচরণ সর্বস্ব মানে প্রদর্শনবাদ হয়ে ওঠে, তখন শ্রদ্ধা বিষয়টি গুরুত্ব হারায়। আর কুতর্কের সৃষ্টি হয়। প্রদর্শনবাদীতাকে ঘিরে শুরু হয় বিবাদ-বিসংবাদ। আর এই বিবাদ সৃষ্টির মূলে থাকে উদ্দেশ্য, শ্রদ্ধা নয়। মানুষকে বিভক্ত করার উদ্দেশ্য। কুতর্ক হলো সেই উদ্দেশ্যের বাহ্যিক রূপ।
এটাকে অবশ্য ‘পাগলাকে নাও ডোবানোর কথা মনে করিয়ে দেয়া’ এই সূত্রেও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। পৃথিবীতে অনেক বিরোধই সৃষ্টি হয়েছে বিরোধ মেটানোর কথা বলে। একজন মুসলিমকে প্রগতিশীল হতে হলে পূজায় অংশগ্রহণ করতে হবে, মিলে যেতে হবে উৎসবের সাথে এমনটা যারা বলেন, তাদের মধ্যে সেই উদ্দেশ্যটা কাজ করে। পূজাকেই অনেকে প্রগতির অন্তরায় মনে করেন। সে অর্থে ধর্মকেই। সুতরাং প্রগতিশীল কথাটার ব্যবহার এখানে চালাকির। আর এই চালাকির মূলে হলো কুতর্ক তুলে দেয়া। যেমন, কোনো কোনো মুসলিম হয়তো যাবেন নিজেদের প্রগতিশীল প্রমান করার জন্য। বিপরীতে বিশাল একটা অংশ এর বিরোধীতা করবেন। সেই বিরোধীতা পৌঁছাবে এক সময় পূজার বিরোধীতায়। অভিযোগ উঠবে মুসলমানদের বিশ্বাস নষ্ট করার। ফলশ্রুতিতে ধর্মীয় সংঘাত।
দেখুন, কথিত প্রগতিশীলতার নামে উৎসবে সামিলের যে কৌশল, তা কিন্তু বুমেরাং হচ্ছে। এক করার বদলে বিভেদ বাড়াচ্ছে। ঐক্যর বদলে সংঘাতের সৃষ্টি করছে। সুতরাং এমন চালাকির চিন্তা আপাত ভালো, আখেরে খারাপ। তার থেকে যদি বলা হতো তোমাদের বিশ্বাস তোমাদের কাছে থাক, কিন্তু বিপদে-আপদে থাকো পরস্পরের পাশাপাশি। তুমি আমার জন্য প্রার্থনা করো, আমি তোমার জন্য দোয়া। যেভাবেই করি, আমরা যেনো পরস্পরের জন্য করি। অথচ হচ্ছে উল্টোটা, মেলানোর নামে লড়ানোর কাজ!
একজন রাজাকার, যে ভেতরে মুক্তিযুদ্ধকেই স্বীকার করে না। সে যদি স্বার্থ হাসিলের জন্য স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিতে যায়, তাতেই কি তার দেশপ্রেম জায়েজ হয়ে গেলো? আর একজন, মুক্তিযুদ্ধকে একটি রাষ্ট্রের জন্ম হিসেবে মানে, বিশ্বাস করে। সে যদি ধর্মীয় কারণে ফুল না দিয়ে নামাজে দোয়া করে তবে কি তার দেশপ্রেম নাজায়েজ হয়ে গেলো? প্রশ্নের উত্তরটা খুব জটিল নয়। কিন্তু কুতর্ক সেই উত্তরকে জটিল করে তোলে। কুতর্কের কাজই হলো সোজা বিষয়কে জটিল করে ঝামেলা বাঁধানো।
কেউ যদি বলেন, মিনার শব্দটা ইসলামিক। মসজিদের মিনার থেকে এর উৎপত্তি। সুতরাং মিনার না দিয়ে অন্যকিছু কথিত ‘নিরপেক্ষ’ শব্দ বের করতে হবে। তাহলে তো শহিদ নিয়েও টান পড়ে যাবে। শহিদ শব্দটাও ইসলাম থেকে আসা। এই যে এমন কথা তোলা, এটাই হলো কুতর্ক। আর আমাদের কুতর্কের দোকান ক্রমেই বাড়ছে। বাড়ছে প্রদর্শনবাদীতা। শ্রদ্ধার প্রকাশ নয়, প্রদর্শনটাই মূখ্য হয়ে উঠছে। এ অবস্থা থেকে বের না হতে পারলে বিভেদ আর বিবাদের ভয়াবহ নৈরাজ্য অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
পুনশ্চ : দুটো কারণে এই লিখা বলেছিলাম শুরুতে। দ্বিতীয় কারণের প্রসঙ্গে আসি। আমাদের ভাষা আন্দোলনের দিনটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। দিনটি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আমাদের দেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষাগুলো ক্রমেই বিলুপ্তির দিকে যাচ্ছে। বাংলার সাথে এই ভাষাগুলোর যত্নও আমাদের নিতে হবে। এদের নজর-আন্দাজ করলে, আমাদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি তার মর্যাদা হারাবে। আমরা ভাষার জন্য লড়েছি এবং সে লড়াই মাতৃভাষার জন্য- খেয়াল করবেন ‘মাতৃভাষার জন্য’। সুতরাং সবার মাতৃভাষাই আমাদের কাছে সমান মূল্যবান হওয়া উচিত।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।