শেকৃবির সাবেক ভিসিদের নানা কুকীর্তি, শাস্তি হয়নি কারো
২০০১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব উপাচার্য নিয়োগ পেয়েছেন, তারা সবাই কমবেশি নানা অনিয়মে জড়িয়েছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসির) নির্দেশনা-সুপারিশ অমান্য ও নানা অনিয়ম করেই তারা মেয়াদ পার করেছেন। অথচ সাবেক উপাচার্যদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ প্রমাণিত হলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সরকার।
বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্যদের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এক উপাচার্য অবসরে যাওয়ার পরপর নিয়োগ পাওয়া উপাচার্যও একই অনিয়ম করেছেন। যারা একসময় উপাচার্যের অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন, তারা উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর একই অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন। তারা নিজেদের আত্মীয়স্বজন ও দলীয় কর্মী পুনর্বাসন কেন্দ্রে পরিণত করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টি।
উপাচার্যদের সন্তান, ভাই, ভাতিজা, ভাতিজি, শ্যালক, শ্যালকের স্ত্রী, দূর সম্পর্কের চাচাতো-মামাতো ভাইও রয়েছেন নিয়োগ পাওয়াদের তালিকায়। ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ দেখিয়ে, অভিজ্ঞতা ছাড়াই, এমনকি নির্ধারিত বয়সসীমা পার হলেও নিয়োগ প্রদানসহ এমন কোনো অনিয়ম নেই, যা উপাচার্যরা করেননি। কোনো কোনো উপাচার্যের বিরুদ্ধে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে টাকার বিনিময়ে নিয়োগের অভিযোগও ছিল।
২০০১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর উপাচার্য হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক অধ্যাপক শাদাত উল্লাহকে নিয়োগ দেয়। কিন্তু তার নিয়োগ বৈধ হয়নি এমন প্রেক্ষাপট তুলে তিন মাসের মধ্যেই বিএনপি সরকার এসে তার নিয়োগ বাতিল করে দেয়। নিয়োগ দেওয়া হয় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক ড. এ এম ফারুককে। টানা দুই মেয়াদে আট বছর উপাচার্য ছিলেন তিনি।
তার সময়ে ভুয়া ও অসত্য তথ্য দিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয় একাধিক শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিককে। নিজের আত্মীয়স্বজনকেও নিয়োগ দিয়েছেন। টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে দলীয় কর্মীদেরও। প্রাপ্যতার চেয়ে বেশিসংখ্যক নিয়োগ দেওয়া হয়। ইউজিসির কোনো সুপারিশ আমলে নেননি তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তার বিরুদ্ধে শ্বেতপত্রও প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু টানা আট বছর দায়িত্ব পালন করে নানা অনিয়মে জড়ালেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি তার বিরুদ্ধে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নিয়োগ পান অধ্যাপক ড. শাহ ই আলম। তিনি আগের উপাচার্যের সময় নানা অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া চার জনকে চাকরিচ্যুত এবং এক জনের পদাবনতি করেন। তার বিরুদ্ধেও ছিল অনিয়মের অভিযোগ। বিভাগীয় চেয়ারম্যানের আপত্তি উপেক্ষা করেই তিনি শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টনের ক্ষেত্রেও তিনি অনিয়ম করেছেন।
পরে ২০১২ সালে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রাক্তন উপাচার্য ড. এ এম ফারুকের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকা শিক্ষক নেতা অধ্যাপক শাদাত উল্লা। তিনি যে অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন, সেই অনিয়মে তিনিই জড়িয়ে পড়েন। নিয়োগ বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়ে নিজের ভাতিজিসহ একাধিক আত্মীয়স্বজনকে শেকৃবিতে বিভিন্ন পদে চাকরি দিয়েছেন। উপাচার্যের ভাতিজি, ভাতিজা, শ্যালক ও শ্যালকের স্ত্রীকেও নিয়োগ দিয়েছেন। অথচ এদের অনেকেরই বিধি অনুযায়ী যোগ্যতা ছিল না। নানা আর্থিক অনিয়মও করেছেন।
ঈদুল ফিতর, পয়লা বৈশাখ ও ঈদুল আজহার সময় আপ্যায়ন ব্যয় বাবদ ২ লাখ টাকা করে মোট ৯ বার বিশ্ববিদ্যালয় তহবিল থেকে টাকা তুলেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় কিনেছিলেন নিজের বাসার ক্রোকারিজ। নতুন বাসভবনও সংস্কারের নামে বিপুল অর্থ ব্যয় করেছেন। একাডেমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগেই আবেদন নিয়ে ইন্টারভিউ কার্ড দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন তিনি। তিনটি সেকশন অফিসার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে ২৪ জনকে নিয়োগ দেন। পাঁচ জন শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তিনি নিয়োগ দিয়েছেন ২৯ জনকে। তার এসব অনিয়মের বিষয়ে দুই দফা তদন্ত করে ইউজিসি। প্রমাণও মেলে। সেই আলোকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঐ উপাচার্যকে অপসারণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সুপারিশও পাঠায়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে শেষ পর্যন্ত সেই সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি।
পরের মেয়াদে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি প্রাক্তন উপাচার্য শাদাত উল্লাহর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন। উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর তিনি একইভাবে নানা অনিয়মে জড়ান। ২০১৭ সালে ৭৫ জন শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলেও ১০১ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়, যা বিজ্ঞাপিত চাহিদার চেয়ে ২৬ জন বেশি। এর মধ্যে ২১ জনকে ইউজিসির অনুমোদনের অপেক্ষায় রাখা হয়, যা ইউজিসি আইনেরও পরিপন্থি। ইউজিসি থেকে একাধিকবার এ বিষয়ে সতর্ক করা হলেও তা তিনি আমলে নেননি। এত অনিয়মের পরও তিনি স্বাভাবিকভাবে উপাচার্যের পদ থেকে অবসরে যান।
ইউজিসির প্রাক্তন চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান এ প্রসঙ্গে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় চলে জনগণের টাকায়। তার জবাবদিহি থাকবে। উপাচার্যের পাণ্ডিত্য থাকতে হবে, নীতি-নৈতিকতা থাকতে হবে। যোগ্যদের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। বাংলাদেশে এখনো অনেক যোগ্য শিক্ষক আছেন। কেন অযোগ্যদের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে—প্রশ্ন রাখেন তিনি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন এই উপাচার্য আরো বলেন, বাংলাদেশের উপাচার্যরা অনিয়ম করে পার পেয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু অনিয়ম করে ভারতে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক উপাচার্য জেল খেটেছেন এমন অনেক উদাহরণ আছে। ইউজিসির তেমন কোনো ক্ষমতা নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, যেসব উপাচার্য অনিয়ম করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আগ্রহের অভাব রয়েছে।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক ড. শহীদুর রশীদ ভুঁইয়া। তিনি গত বছর নভেম্বরে এ পদে নিয়োগ পান।সূত্র:ইত্তেফাক