শূন্যতায় ভরপুর ক্যাম্পাস
আল আমিন ইসলাম নাসিম।।
বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের ফলে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা বিরাজ করছে গোটা বিশ্বে। এ থেকে রেহাই মেলেনি প্রিয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসও। এখন যেন শূন্যতায় ভরপুর পুরো ক্যাম্পাস। নিস্তব্ধ অনুষদ ভবনের নিচে চায়ের দোকানগুলোতে নেই শিক্ষার্থীদের আনাগোনা।
প্যারাডাইস রোডে এখন জনমানবশূন্য। মফিজ লেকে এখন পাখিদের কুজন ছাড়া আর কিছুই যেন শোনা যায় না। লেকের ধারে আর কারও জন্মদিন পালন করা হয় না। করোনার পরবর্তী সময়ে ১৭৫ একরের এই ক্যাম্পাসে এখন এসেছে নানা পরিবর্তন। আগে যেখানে শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হতো ক্যাম্পাস এখন সেখানে কিছু শ্রমিক আর নিরাপত্তা কর্মী ছাড়া কারও দেখা মেলে না।
ক্যাম্পাসের লাল বাসগুলো যেন নিথর হয়ে পড়ে আছে। বাসগুলোয় এখন নেই কারও আনাগোনা কিংবা সিট ধরাধরি। হলগুলো এখন পুরো নিস্তেজ। ধুলোমাখা বইগুলো পড়ে আছে এবং সেইসঙ্গে বেডগুলো এখন ছাইপোকা ও ইঁদুরদের দখলে। প্রিয় খেলার মাঠগুলোয় এখন আর কেউ দ্রুত যেয়ে স্ট্যাম্প গেড়ে আসে না। বটতলায় এখন আর কারও আসর জমে না।
শ্রেণীকক্ষের চেয়ার-টেবিলগুলো ধুলোয় মিশে আছে আর বোর্ডগুলো সেই পুরনো আস্তরণে। এখন আর নেই হৈচৈ কিংবা হুল্লোড়। চলতি বছরের মার্চের ১৭ তারিখ থেকে ক্যাম্পাস বন্ধ দেয়ায় প্রায় ৬ মাস অধিক ঘরবন্দী শিক্ষার্থীরা। ক্যাম্পাসে ফেরার আকুলতা ঘিরে ধরেছে সকলকেই।
সেশনজটের আশঙ্কা আর নিজের বয়স বেড়ে যাওয়ায় চিন্তামগ্ন প্রায় সকলেই। নবীনরা বড়জোর দুই মাস ক্লাস করেছে। সুতরাং নতুনত্বের ক্যাম্পাসের স্বাদ আহরণ এখনও বাকি রয়েছে। সবমিলিয়ে ক্যাম্পাসে ফিরে যেতে চাইলেও মহামারীর জন্য তা এখন কারও পক্ষেই সম্ভব হচ্ছে না। ক্যাম্পাসের আমতলায় যেসব দোকানিরা বসত কিংবা জিয়া মোড়ে বসত তাদের প্রায় দোকানি বন্ধ।
কেমনই চলছে বা তাদের সংসার? যে দোকানগুলোতে ভিড় জমিয়ে রাখতো শিক্ষার্থীরা! ক্যাম্পাসের সবচেয়ে ব্যস্ততম জিয়া মোড় এখন নির্জন। এখন কোন হট্টগোল নেই। নেই কোন স্লোগানের আভাস। চারদিকে নেই কোন প্রাণের স্পন্দন।
যে ক্যাম্পাসে বারো মাসে তেরো পার্বণ লেগে থাকত অর্থাৎ সার্বক্ষণিক অনুষ্ঠান এবং উৎসব পালন হতো তা এখন দেখা মেলে না। নেই কোন গানবাজনা, নেই মিছিল, নেই ক্লাস, নেই বিক্রেতাদের মুখে হাসি। পক্ষান্তরে ক্যাম্পাসকে ঘিরে যারা জীবিকা নির্বাহ করত তাদের এখন পন্থা নেই জীবিকার। সবাই যেন নিরুপায়। ক্যাম্পাসের শহীদ মিনার চত্বরে বিভিন্ন সময়ে পর্যটকরা এসে ছবি তুলত ফুলের বাগানে কিংবা কেউ বসে খোশগল্প জমাত। সে সকল দৃশ্য এখন দেখা মেলে না। যে কোন বিক্ষোভ সমাবেশ বা কর্মসূচী দেখা যেত মৃত্যুঞ্জয়ী মুরালের সামনে। কিন্তু সেগুলোর কোন কিছুই এখন পরিলক্ষিত হয় না।
এছাড়া ক্যাম্পাসের চিরচেনা দিনগুলো স্মরণ করতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে প্রিয় বন্ধুদের চেহারা থেকে শুরু করে তাদের সঙ্গে ক্লাস করা, আড্ডা, ঘুরে বেড়ানো। এছাড়া শিক্ষকদের স্নেহ, বড় ভাই আপুদের অবিরাম ভালবাসা, টং এর মামারা আর চায়ের আড্ডা, চিরচেনা মফিস লেকে বন্ধুদের জন্মদিন পালন, প্যারাডাইস রোডে ভাইভা দিনে ফটো শুট কিংবা শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে কাপলদের হেঁটে বেড়ানোর দৃশ্য, জিয়া মোড়ে দাঁড়িয়ে বড় ভাইদের সঙ্গে খোশগল্প , লালনশাহ হলে থাকা, অনুষদ ভবনের নিচে বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করা ও ফটোকপির দোকানে ভিড় জমানো, খেলার মাঠে নিজের বিভাগকে সাপোর্ট করতে যাওয়া, মেইন গেট, ডায়ানা চত্বরে বসে গোল আড্ডা, লাল বাসে সিট না পেয়ে ঝুলে ঝুলে যাওয়া, পশ্চিমপাড়া, বঙ্গবন্ধু হল, খাদেমুল হারামাইন ফাহাদ বিন আব্দুল আজিজ কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, বন্ধুদের সঙ্গে সেমিনারে যাওয়া আরও কত কি? দীর্ঘদিন ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় সবাই নিজ নিজ বাড়িতে অবস্থান করছে এখন।
গুটিকয়েক যাদের বাড়ি ক্যাম্পাসের আশপাশে, তাদের কাছ থেকেই ক্যাম্পাসের খোঁজ-খবর পাওয়া যাচ্ছে । মাঝে মধ্যে তারা ছবি তুলে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে আপলোড করে থাকে। ক্যাম্পাসের ছবিগুলো দেখতেই যেন এক ভাললাগা, ভালবাসা আর প্রিয় ক্যাম্পাসে ফিরে যাওয়ার তৃষ্ণা অনুভূত হয়।
চিরচেনা ক্যাম্পাস এখন প্রাকৃতিক বর্ণিল সাজে সজ্জিত হলেও বিষণœতায় মুখরিত। ক্যাম্পাসের লেকে এখন পাখিদের কুজন, চারদিকে সবুজের বনায়ন আরও বিস্তৃত সবুজরূপ লাভ করেছে, দেয়াল ফেটে গুল্ম উদ্ভিদের জন্ম সব কিছুই ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ধূসর চিত্র পাল্টে রঙিন করে দিয়েছে । ক্যাম্পাসের চারদিকে যেন এখন প্রকৃতি হাসছে, খেলছে দুলছে।
কিন্তু বিষণœতায় প্রহর গুনছে ক্যাম্পাসের লাইব্রেরির ধুলোমাখা বইগুলো থেকে শুরু করে শ্রেণীকক্ষের চেয়ার-বেঞ্চ, বাসগুলোর ছিট, হোটেলগুলোর টেবিল ও হলগুলোর ডাইনিং, বেড। ক্যাম্পাসের সব কিছুই অপেক্ষায় চিরচেনা শিক্ষার্থীদের সেই স্পর্শগুলোর ছোঁয়া পেতে, যেখানে প্রকৃতির সঙ্গে তারা হাসবে, খেলবে ও দুলবে। ক্যাম্পাসকে সবসময় আলোকিত বা উজ্জ্বল, আনন্দ উল্লাসে মুখরিত করবে, রঙিন ক্যাম্পাসকে প্রাণবন্ত করবে, জরাজীর্ণতা দূর করে ক্যাম্পাসকে প্রাণাচ্ছল করবে।
একই সঙ্গে মুখরিত করবে ক্যাম্পাসের প্রতিটি শ্রেণীকক্ষ । প্রকৌশলী ভবনের চত্বর থেকে শুরু করে বটতলা, আমতলা চত্বরগুলো আজ প্রহর গুনছে শিক্ষার্থীদের চরণের সংস্পর্শ পেতে। কেননা শিক্ষার্থীদের পদচারণায় শহীদ মিনার চত্বর, প্রকৌশলী ভবন চত্বর, বটতলা, আমতলা চত্বরগুলো এক নতুন প্রাণ যেন ফিরে পাই। ক্যাম্পাসে পড়াশোনার পাশাপাশি বন্ধুদের মাঝে আনন্দ উল্লাস সর্বদা লেগে থাকত, পাশাপাশি যে কোন দিবসেই অনুষ্ঠান কিংবা আলোচনা সভা চলত।
কোন না কোন বিভাগ বা যে কোন শিক্ষা বর্ষের শিক্ষার্থীরা নানা আয়োজন করতো ক্যাম্পাসে। হাসি, ঠাট্টা বা ট্রিট নামক বড় ভাই আপুদের নিকট আবদার কত কি না হতো? কিন্তু বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সব কিছুই এখন নিস্তব্ধ। প্রিয় ক্যাম্পাসে আজ নেই কোন বর্ণিল রূপসজ্জা কিংবা আয়োজন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে এখন যেন একাকিত্বের বসবাস। প্রিয় ক্যাম্পাসে এখন নেই কোন বিখ্যাত শিল্পীদের আনাগোনা, মঞ্চ কাঁপানো বা জমকালো অনুষ্ঠান কিংবা কোন শীর্ষক সেমিনার।
চৌষট্টি জেলার শিক্ষার্থীদের এখানে মিলন মেলা ঘটে থাকে। মোহনার ন্যায় এখানে সকলেই এক হয়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। কিন্তু বিশ্বের এই প্রতিকূল পরিস্থিতির জন্য কারও সঙ্গেই দেখা সাক্ষাৎ করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া ক্যাম্পাসের চারদিকে এত উৎসবমুখর পরিবেশ থাকে শিক্ষার্থীদের ঘিরে যেন মনে হয় ১৭৫ একর এর এই অঙ্গনে প্রতিটি দিনই ইদ, প্রতিটি দিনই পূজা। সেই উৎসবমুখর পরিবেশে আবারও ফিরে যেতে চির উদগ্রীব সকলেই।