শিক্ষা-স্বাস্থ্যে বরাদ্দ কমিয়ে কি মানবসম্পদের উন্নতি করা যাবে?
ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা: অর্থমন্ত্রী ১ জুন সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেছেন। ঈদের ছুটির কারণে এবার ৩০ জুনের আগেই এ বাজেট সংসদে পাশ হয়ে গেছে। কিছু জরুরি খাতে অযৌক্তিকভাবে অত্যন্ত কম বরাদ্দ রেখে বাজেট পাশ করা ঠিক হলো কি? বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ঘনবসতির স্বল্প আয়তনের, সংকীর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদের দেশে প্রধান সম্পদ মানুষ। মানবসম্পদ উন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রাখে যে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা, সে দুটো খাতের একটিও বাজেটে যথাযথ গুরুত্ব পায়নি। অত্যন্ত দুঃখজনক, জিডিপির হিসাবে এবার উভয় খাতে বরাদ্দ আরেক দফা কমানো হয়েছে!
উৎপাদনশীল ও অনুৎপাদনশীল খাত
সরকারি অর্থের বরাদ্দ ও খরচ উৎপাদনশীল ও অনুৎপাদনশীল উভয় খাতেই হতে পারে। উৎপাদনশীল খাত বলতে যেসব আর্থিক খাত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অর্থ ও সম্পদ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে, সেগুলোকে বোঝায়। এসব খাতের মধ্যে রয়েছে কৃষি, শিল্প, যোগাযোগ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা হত্যাদি। অনুৎপাদনশীল খাতের মধ্যে পড়ে জনপ্রশাসন (কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদান), প্রতিরক্ষা, বিনোদন, ক্রীড়া ইত্যাদি।
কিছু উৎপাদনশীল খাত এমনও আছে অর্থনৈতিক উন্নয়নে যেগুলোর অবদান সরাসরি চোখে পড়ে না; কারণ সেসব খাতের বেশ দীর্ঘ সুপ্তিকাল (Gestation Period) থাকে। শিশু-কিশোরদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ১৬-২০ বছর ধরে চলে, এ সময়ে শিক্ষার্থীরা তেমন কিছু উৎপাদন করে না। কর্মে নিযুক্ত ব্যক্তিদের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা (প্রশিক্ষণ) মানবসম্পদের উন্নয়ন করে প্রায় সরাসরি; এর সুপ্তিকাল একেবারে ছোট হওয়ায় উন্নয়ন সহজে চোখে পড়ে। প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ খুব তাড়াতাড়ি অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। স্বাস্থ্যবান মানুষ কর্মী হিসাবে স্বাস্থ্যহীন বা রোগা কর্মীদের চেয়ে বেশি উৎপাদনশীল বলে স্বাস্থ্য খাতে খরচকে শিক্ষা খাতের চেয়ে প্রত্যক্ষ অবদানকারী হিসাবে দেখা যায়।
আনুষ্ঠানিক শিক্ষা খাতের সুপ্তিকাল দীর্ঘ হলেও দেশের উন্নয়নে এর সুদূরপ্রসারী ভূমিকা থাকে। এসব শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর ব্যক্তিগত বর্ধিত আয়ের যোগ্যতা অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাড়তি প্রভাব (Spillover Effect) ফেলে (Mincer 1974)।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে খরচ দীর্ঘস্থায়ী বিনিয়োগ
প্রায় ৬০ বছর আগে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান ক্যাপিটাল স্কুল শিক্ষা খাতের খরচকে বিনিয়োগ বলে প্রমাণ করে রেখেছে (Schultz, 1961)। আর অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্তঃসত্ত্বা প্রবৃদ্ধি তত্ত্ব (Endogenous Growth Theory, Romer 1990) অনুসারে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য উভয় খাত অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখে ভেতর থেকে; এর অবদান বাহ্যিক মডেলের বিশ্লেষণেও সরাসরি ধরা পড়ে না। ভেতর থেকে গড়ে ওঠা এ উন্নয়ন হয় দীর্ঘস্থায়ী প্রকৃত উন্নয়ন।
বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ইউনেস্কো) দীর্ঘদিন শিক্ষা খাতে জিডিপির সাত শতাংশ বরাদ্দের দাবি করে আসছিল। তবে সংস্থাটি ২০১৫ সালের ইঞ্চিয়ন ঘোষণায় (Incheon Declaration 2015) এ খাতে জিডিপির ৪-৬ শতাংশ বরাদ্দের পরামর্শ দিয়েছে। এর কম বরাদ্দে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)-৪ (শিক্ষার জন্য নির্দিষ্ট লক্ষ্য) অর্জন করা যাবে না।
শিক্ষা খাতে উন্নত বিশ্বের আর্থিক বিনিয়োগের দিকে না তাকিয়ে আমরা এশিয়ার কিছু নিকট প্রতিবেশীর দিকে তাকাই। ভুটান এ খাতে জিডিপির ৭.২ শতাংশ বিনিয়োগ করে। ভারত ও পাকিস্তানের এ খাতে বরাদ্দ যথাক্রমে জিডিপির ৩.৮ ও ২.৯ শতাংশ।
অনেক বছর বাংলাদেশ শিক্ষা খাতে জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ বরাদ্দ করা হচ্ছিল। করোনার আঘাতে দুবছরের বেশি সময় বিদ্যালয় প্রায় বন্ধ থাকার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীদের শিখন-ঘাটতি পূরণ করার জন্য এবং ‘নতুন’ নামে খ্যাত পরিমার্জনাধীন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য গতবার ও এবার অন্য বছরের তুলনায় বেশি বরাদ্দ দরকার ছিল। গত বছর শিক্ষা খাতে বরাদ্দের ভাগ ছিল জিডিপির ১.৮৩ শতাংশ; এবার আরেক ধাপ কমিয়ে করা হয়েছে ১.৭৬ শতাংশ!
স্বাস্থ্য খাত সবচেয়ে অবহেলিত স্বাধীন বাংলাদেশে
মানবসম্পদ উন্নয়নের বিচারে স্বাস্থ্য শিক্ষার চেয়েও বেশি গুরুত্ব পাওয়ার কথা। কারণ, স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে শিক্ষাগ্রহণও বাধাপ্রাপ্ত হয়। আমার স্কুল-জীবনের কথা মনে পড়ে। আমি গাজীপুর জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার নাগরী ইউনিয়নে অবস্থিত সেন্ট নিকোলাস হাইস্কুলের ছাত্র ছিলাম। ১৯৭৪ সালে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। ইংরেজির শিক্ষক রঞ্জিত কুমার দাস একটু পেট খারাপ হলেই স্কুলে আসতেন না। আমাদেরও অসুস্থ অবস্থায় স্কুলে আসতে বারণ করতেন। তার যুক্তি ছিল: শরীর সুস্থ না থাকলে শিক্ষার মতো উন্নত মানসিক কাজ ভালো হতে পারে না। শিক্ষাগ্রহণের মতো কাজ দায়সারা গোছের করে তো করা যায় না!
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবমতে, বাংলাদেশে ১০ হাজার মানুষের জন্য ৫.২৬ জন চিকিৎসক রয়েছেন। এ হিসাব দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন দেশটির পরে, অল্পের জন্য নিচের দিক থেকে প্রথম হওয়ার ‘গৌরব’ থেকে বঞ্চিত হয়েছি! স্বাস্থ্যসেবার জন্য চিকিৎসকের সংখ্যার চেয়ে সেবিকার সংখ্যা বেশি হতে হয়। অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার (ওইসিডি) অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোতে একজন চিকিৎসকের জন্য তিনজন সেবিকা থাকেন। বাংলাদেশে এ হার উলটো; ২.৫ জন চিকিৎসকের জন্য আছেন মাত্র একজন সেবিকা। এর কারণ কি এই যে, আমাদের দেশে প্রশিক্ষণ দিয়ে সেবিকা তৈরির জন্য যথেষ্টসংখ্যক মহিলা নেই? না থাকলে কোত্থেকে আমরা মেয়েদের মধ্যপ্রাচ্যে পাঠাই ঘরকন্নার কাজ করার নামে নানাভাবে নিগৃহীত হতে?
আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ভারত গত বছর স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ খরচ করেছে; ২০২৫ সালের মধ্যে দেশটি এ খাতে ২.৫ শতাংশ বরাদ্দ করার পরিকল্পনা করছে। এ করোনাপীড়িত দেশে কী করে গতবার জিডিপির মাত্র ০.৮২ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল? এবার কোন যুক্তিতে বরাদ্দ আরও কমিয়ে মাত্র ০.৭৬ শতাংশ করা হলো?
মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে বাজেট বরাদ্দ
বাংলাদেশে মন্ত্রণালয় ৪০টির মতো। প্রতি মন্ত্রণালয় ভাগে পাওয়ার কথা জিডিপির ২.৫ শতাংশ। সে হিসাবে দুটো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভাগ দাঁড়ায় জিডিপির ৫ শতাংশ, যা জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেস্কো নির্ধারিত ৪-৬ শতাংশের মাঝখানে পড়ে। আমাদের একক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তো হিসাবে জিডিপির ২.৫ শতাংশ ভাগে পায়। সেখানে কোন যুক্তিতে গত বছর বরাদ্দ হয়েছিল ০.৮২ শতাংশ; এবার আরও কমিয়ে ০.৭৬ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হলো? শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত যৌক্তিক ভাগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কেন? বঞ্চনা বছর বছর বাড়ানো কীসের লক্ষণ?
অমর্ত্য সেনের আবিষ্কার এবং আমাদের মন্ত্রিপরিষদ
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন দুই দশক আগে আবিষ্কার করলেন : ‘গণতান্ত্রিক দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে না’। আমরা যা-ই ভাবি না কেন, আমাদের নেতারা দিবানিশি দেশে ‘উন্নয়নের গণতন্ত্রের’ ঢোলক বাজিয়েই চলেছেন। তাহলে দুর্ভিক্ষ কেন? না, আমাদের এ স্বাধীন দেশে খাদ্য নিয়ে দুর্ভিক্ষ একবারই হয়েছিল ১৯৭৪-৭৫ সালে। তবে মানবসম্পদ উন্নয়ন না বোঝা এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে প্রাপ্য আর্থিক বরাদ্দের অর্ধেকও না দেওয়া থেকে মনে হয় আমাদের মন্ত্রিপরিষদে চলছে ‘চিন্তার দুর্ভিক্ষ’।
মনে রাখতে হবে-বড় সেতু, ওভারহেড মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার দূর থেকে দেখা যায়, ‘দেখানো’ও যায় বেশ গর্বের, দর্পের, এমনকি দম্ভের সঙ্গে। দেখিয়ে বহু মানুষের মনও জয় করা যেতে পারে। কিন্তু গণমানুষের ভেতর থেকে উন্নয়ন না ঘটলে, মানবসম্পদ উন্নয়ন করতে না পারলে, ইট-পাথর-লোহায় গড়া বাহ্যিক উন্নয়ন সবই বৃথা হয়ে যাবে।
জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ার প্রত্যয় আছে বলে প্রায়ই শোনা যায়। আর দেশের বেশিরভাগ সংসদ-সদস্য ও মন্ত্রী এখন ব্যবসায়ী; আগের দিনের মতো আইনজ্ঞ, শিক্ষাবিদ, সমাজসেবী, বিজ্ঞানীরা এখন কার্যকর (ক্ষমতাসীন) রাজনীতিতে নেই। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক তো অল্পদিন আগে বলেই ফেলেছেন : এখন ভালো মানুষ রাজনীতিতে আসতে চায় না! রাজনীতি কি খারাপ কাজ? প্রতিষ্ঠিত ভালো মানুষ রাজনীতিতে আসতে না চাইলে কী করা? বিকল্প হিসাবে যারা আছেন, তারাই ভালো হয়ে যান; কথায় আছে-‘ভালো হতে পয়সা লাগে না’!
আশা করি, আমাদের ব্যবসায়ী, মন্ত্রী ও সংসদ-সদস্যরা আগামীতে নিজেদের দায়িত্ব/ব্যবসা ভালোমতো বুঝে মানবসম্পদ উন্নয়নের ধারণা কাজে লাগিয়ে মানবসম্পদ উন্নয়নের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে সংসদে পাশ করবেন। শিক্ষা খাতে অন্তত ৩ শতাংশ এবং স্বাস্থ্য খাতে অন্তত ১.৫ শতাংশ বরাদ্দ নিশ্চিত করবেন। আর আগামী বছর থেকে প্রাপ্য হারে (শিক্ষায় ৫ শতাংশ, স্বাস্থ্যে ২.৫ শতাংশ) বাজেটে বরাদ্দের চিন্তা মাথায় রাখবেন।
লেখক: শিক্ষা-গবেষক, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক (বিসিএস সাধারণ শিক্ষা)
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৪/০৭/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়