শিক্ষা সংস্করণ প্রাসঙ্গিক ভাবনা
মোহাম্মদ আলী শেখ।।
সম্প্রতি সরকার শিক্ষা সংস্কারের ঘোষণা দিয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি ভালো উদ্যোগ। শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষা কোন গোত্র বা দলীয় সম্পদ না জাতির সম্পদ ।এর সংস্করণে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন থাকতে হবে। এজন্য একটি নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করতে হবে। তাহলে সবার কাছে সংস্করণ গ্রহণযোগ্যতা পাবে।
জেএসসি ও পিএসসি পরীক্ষা:
জেএসসি ও পিএসসি এর মত অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষার কারণে আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। শ্রেণিকক্ষ পরীক্ষার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। প্রাথমিক সমাপনী ও জেএসসি পরীক্ষার কারণে অক্টোবর-নভেম্বর দুই মাস কোন ক্লাস হয়না। অক্টোবরে জেএসসি-পিএসসির টেস্ট পরীক্ষা হয় নভেম্বরে হয় ফাইনাল পরীক্ষা। এ সময় সব শ্রেণীর ক্লাস বন্ধ থাকে। শিক্ষকরা প্রশ্ন করা ,পরীক্ষার ডিউটি করা ,খাতা দেখার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। যাকে বলে ইজি কাজে বিজি। প্রাইভেট ও কোচিং সেন্টার বন্ধ করে দেয় যাতে প্রশ্নপত্র ফাঁস না হয়। পৃথিবীর কোন দেশে এ সকল পরীক্ষা শিশুদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় না। দ্বিতীয়তঃ এ সকল সনদ তাদের জীবনে কোন কাজেও লাগে না। অভিভাবকদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা কাজ করে। তারা সন্তানের পড়াশোনার জন্য চাপাচাপি করেন। ফলে অভিভাবকদের সাথে সন্তানের একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়। শিক্ষাবিদরা বহু আগেই এ সকল পরীক্ষা বাদ দিতে বলেছিলেন ।অনেক দেরিতে হলেও সরকার তো এখন উপলব্ধি করতে পেরেছে এজন্য সরকারকে ধন্যবাদ।
মাধ্যমিকে বিভাগ থাকছে না:
মাধ্যমিক পর্যায়ের বিভাগ উঠে যাচ্ছে। চলমান শিক্ষা সংস্করণ এর অংশ হিসেবে মাধ্যমিকে কোনো বিভাগ বা গ্রুপ থাকবে না ।ফলে বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও মানবিক বিভাগ বলতে কিছুই থাকবেনা ।মাধ্যমিকে বিজ্ঞানের সিলেবাস টা বেশ কঠিন এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর দেশগুলোর সাথে সামঞ্জস্যশীল। আমাদের দেশে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে এ সিলেবাস সম্পন্ন করতে পারে না ফলে প্রাইভেট পড়তে হয় কিংবা কোচিং করতে হয় । শহরের সচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীরা যা করে থাকে। গ্রামের অস্বচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট কোচিং কিংবা ভালই স্কুল পায় না । ফলে তারা মানবিক শাখার সহজ বিষয়গলো নিয়ে পড়াশোনা করে। সরকার যদি শহরের সচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে ,আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে সিলেবাস প্রণয়ন করে তাহলে গ্রামের অস্বচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করতে পারবেনা। আর সরকার যদি গ্রামের সাধারণ পরিবারের শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে কারিকুলাম সহজ করে তাহলে আমাদের কারিকুলাম আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন হবে না।
এমনিতেই আমাদের শিক্ষার মান আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অনেক পিছনে। উচ্চ শিক্ষার মানের উপর ভিত্তি করে পৃথিবীর ১৩৮টি দেশের মধ্যে রেংকিং এ আমরা ১২৯ তম ।পৃথিবীর সেরা ১০০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় খুঁজে পাওয়া যায় না । (অনেক বছর পর এবছর পাওয়া গেছে)। তাই মাধ্যমিকে গ্রুপ তুলে দেওয়ার আগে আরেকবার ভাবতে হবে।
সৃজনশীল নিয়ে কথা:
সৃজনশীলপরীক্ষা পদ্ধতি বাতিল করতে হবে। হঠাৎ করে সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।এতে পাসের হার বাড়লেও শিক্ষার মান কমেছে । বেশিরভাগ অভিজ্ঞ শিক্ষক এ পদ্ধতি পছন্দ করেন না । এর ফলে শিক্ষার্থীদের বাক জড়তা সৃষ্টি হচ্ছে, মুখেস্ত করার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, লেখার মান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে । তাই এ পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। প্রশ্ন কাঠামো পরিবর্তন আনতে হবে। এমসিকিউ এর পরিবর্তে দশটি শূন্যস্থান পূরণ দিতে হবে। ১০ টি অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন যা হবে একটু ক্রিটিক্যাল। চারটি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন রাখতে হবে যার মান হবে ২০ । বাকি ৬০ নম্বর থাকবে রচনামূলক। এর মধ্যে ব্যবহারিক পরীক্ষার নম্বর হবে ১০।
সাবজেক্ট কমানো:
বর্তমান কারিকুলামে মাধ্যমিকে একজন শিক্ষার্থীকে ১১ খানা বিষয় পড়তে হয় এবং পরীক্ষা দিতে হয়। এসকল বিষয়গুলোকে সংযোজন , বিয়োজন ও পরিমার্জন করে আট খানা পেপারের রূপান্তর করতে হবে। সাবজেক্ট ওয়ারি আলাদা আলাদা জিপিএ না করে টুটাল প্রাপ্ত নম্বরের গড় করে জিপিএ নির্ধারণ করতে
হবে। এতে শিক্ষাথী তার পছন্দের সাবজেক্ট কে বেশি গুরুত্ব দিতে পারবে।
ইংরেজি নিয়ে কথা:
চলমান কারিকুলামে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি গ্রস্থ হয়েছে ইঃরেজি সাবজেক্ট। শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করে পাশ করলেও ইংরেজিতে দক্ষ হচ্ছে না। একই প্রশ্ন প্রথম ও দ্বিতীয় পত্রে রিপিট হয়েছে যেমন প্যারাগ্রাফ। দ্বিতীয় পত্রে clue এবং with out clue দিয়ে শূন্যস্থান পূরণ করার কোনও অর্থ নেই। টেক্সটবুক এবং সিন প্যাসেজ এর বাইরে কোন প্রশ্ন করা যাবে না।
লিখিত পরীক্ষা নিয়ে কথা:
' দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোন লিখিত প্রশ্ন থাকবে না' নতুন সংস্করণ এর সাথে আমি একমত নই ।প্রথম শ্রেণীর একজন ছাত্রের বয়স হয় ৬ বছরের বেশি। এ সময় ৫০ নম্বরের লিখিত ও ৫০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করলে ভাল হয়। লিখিত বিষয় যেমন ১ থেকে ৫০ পর্যন্ত লেখা ,স্বরবর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ লেখা ও ইংরেজি বর্ণমালা লেখা শেখানো যায়। দ্বিতীয় শ্রেণীতে ও ৫০ নম্বরের মৌখিক এবং ৫০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষার ব্যবস্থা করলে ভাল হয় । তৃতীয় শ্রেণি থেকে ১০০ ভাগ লিখিত পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। তবে সর্বোপরি কথা হলো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০ বছরের বেশি সময় পাঠ দান করেছেন এমন অভিজ্ঞ শিক্ষকদের মতামত সাপেক্ষে সংস্করণ করতে হবে, চাপিয়ে দেওয়া যাবে না।
নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত একজন শিক্ষার্থীর বয়স থাকে সাধারণত ১৪ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে । এ সময় চাপ নেওয়ার সময়। লেখা পড়ার চাপ না থাকলে দুষ্টুমি করে বেড়াবে। এজন্য উচ্চমাধ্যমিকে যেমন সেমিস্টার সিস্টেম করা হয়েছে নবম ও দশম শ্রেণীতেও সেমিস্টার সিস্টেম করা যেতে পারে।
সব শেষ কথা হল শ্রেণিকক্ষ গুলোকে পরীক্ষার কেন্দ্র থেকে বের করে পাঠদান কক্ষে পরিণত করতে হবে। অর্ধ বার্ষিক পরীক্ষার আগে নব্বই দিন এবং বার্ষিক পরীক্ষার আগে ৯০ দিন ক্লাস নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের চাহিদা যদি শ্রেণিকক্ষে ১০০ ভাগ পূরণ হয় তাহলে প্রাইভেট কিংবা কোচিং সেন্টারে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না। শিক্ষকদের পাঠদান সংশ্লিষ্ট কাজ ছাড়া অন্য কোন কাজে ব্যস্ত করা যাবে না ।