শিক্ষা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাঁক পরিবর্তন দরকার
।। অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী।।
গোটা সমাজ যখন ক্ষমতাকেন্দ্রিক চিন্তার অসুখে আক্রান্ত, তখন এর প্রভাব বিশ্ববিদ্যালয়েও দেখা যাচ্ছে। অসুখ শরীরে হলে তা সারানো যায়, অসুখ মনে হলে তার কোনো চিকিত্সা থাকে না। এই ক্ষমতার দাবা খেলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ও বঞ্চিত হয় শিক্ষার্থীরা, কখনো কখনো শিক্ষকদের দ্বারা ব্যবহূতও হয়
হঠাত্ করেই যেন দৃশ্যপট পালটে যাচ্ছে। যদিও পচনটা ধরেছে অনেক আগেই। শিক্ষা ও গবেষণার মানসিকতা নিয়ে শিক্ষকদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করার কথা থাকলেও, এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের প্রথম দিন থেকেই শিক্ষকরা ভাবতে থাকেন, কীভাবে ক্ষমতাকে ধীরে ধীরে কুক্ষিগত করে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছানো যাবে। শিক্ষার জায়গায় ক্ষমতার লোভ এখন শিক্ষকদের মধ্যে কাজ করছে। এখন প্রকৃত জ্ঞানতাপস হওয়া শিক্ষকদের মূল উদ্দেশ্য নয়, বরং বিশ্ববিদালয়ের সর্বোচ্চ পদটিতে আসীন হওয়াই যেন শিক্ষকদের মূল উদ্দেশ্য।
গোটা সমাজ যখন ক্ষমতাকেন্দ্রিক চিন্তার অসুখে আক্রান্ত, তখন এর প্রভাব বিশ্ববিদ্যালয়েও দেখা যাচ্ছে। অসুখ শরীরে হলে তা সারানো যায়, অসুখ মনে হলে তার কোনো চিকিত্সা থাকে না। এই ক্ষমতার দাবা খেলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ও বঞ্চিত হয় শিক্ষার্থীরা, কখনো কখনো শিক্ষকদের দ্বারা ব্যবহূতও হয়। শিক্ষার্থী ব্যবহার করে নিজের স্বার্থ উদ্ধারের বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট। যেসব শিক্ষার্থী নিজেদের ব্যক্তিত্ব ধরে রাখতে টিস্যু পেপারের মতো ব্যবহূত হতে চায় না, তারা জানে কতটা প্রতিকূলতা তাদের অতিক্রম করতে হয়। যারা ব্যবহূত হয়, তাদের ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠবার আগেই ভেঙে পড়ে। ক্ষমতার অসুখ শিক্ষক থেকে শিক্ষার্থীদের ভেতর সংক্রমিত হচ্ছে, যেটা আগামী প্রজন্মের ধ্বংসের কারণ হয়ে উঠতে পারে।
শিক্ষকদের নিজেদের ব্যক্তিত্ব বলে কিছু থাকে না, ক্ষমতার সিঁড়ি পেতে তোষণনীতি থেকে শুরু করে নিজের মাথাটা হেট্ হয়ে যায় এমন কোনো কর্ম নেই, যার সঙ্গে শিক্ষকরা নিজেদের সম্পৃক্ত না করছে। আগে শিক্ষকদের কাছে ক্ষমতাবানরা শিখতে আসতেন, এখন শিক্ষকরা ক্ষমতাবানদের অনুগ্রহ পেতে দ্বারে দ্বারে ঘোরেন। এসব এখন শিক্ষার্থীরাও জানে, যেটা তাদের কাছে ভালো মেসেজ পৌঁছে দিচ্ছে না।
সব শিক্ষক যে গড্ডলিকায় গা ভাসিয়েছেন তা বলাটা ঠিক নয়; কিন্তু ঝুড়িভর্তি আমের ভেতরে একটা আমের পচন ধরলে সব আমগুলোতেও একসময় পচন ধরে। পৃথিবীর বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়, যেমন—এমআইটি, অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, স্ট্যাম্পফোর্ডসহ অন্যানো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যখন শিক্ষা ও গবেষণায় ডুবে আছেন। শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ও গবেষণায় ডুবিয়ে রেখেছেন, তখন আমাদের শিক্ষকরা ক্ষমতায় আরোহণ করে উত্সবে মেতে ওঠার স্বপ্ন দেখছেন।
যেখানে শিক্ষার্থীদের বড় মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখানোর কথা, সেখানে নিজেদের স্বপ্ন সফল করতে নিজেদের মধ্যে পা টানাটানি, কাদা ছোড়াছুড়িসহ এমন সব কাজ করছেন, যা শিক্ষকতার এথিকথের মধ্যে পড়ে না। অথচ আগে এথিকস বিষয়টি শিক্ষার্থীদের পাঠ্যসূচিতে না থাকলেও এথিকসের এই মহাসংকটের সময়ে এথিকস বিষয়টি পাঠ্যসূচিতে যুক্ত হয়েছে। সেটার ওজন ধারণ করার ক্ষমতা কতটা থাকছে বা থাকছে না, সেটি হয়তো গবেষণার বিষয়। সবচেয়ে বড় কথা, সবখানেই আমরা ক্ষমতাকে টেনে এনেছি। ক্ষমতা রাজনীতিতে থাকতে পারে, ক্ষমতা যখন শিক্ষায় ঢুকে যায়, তখন সেটা মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের সামনে অতীতের বহু মনীষীর বহু উদাহরণ আছে, যা বর্তমানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।
দুই.
মানুষটা খুব অদ্ভুত। স্কুলে পড়া হয়ে ওঠেনি রবার্ট ব্রাউনিংয়ের। একটার পর একটা স্কুল বদলানোর পর তার মনে হয়েছিল জীবনের জন্য যা দরকার, স্কুল তা দিতে পারে না। শেষে বাবার লাইব্রেরিই হয়ে উঠেছিল ছিল তার স্কুল। যে স্কুলের শিক্ষক তিনি নিজেই, ছাত্রও তিনি নিজেই। মানুষ নিজেই যখন স্কুল হয়ে যায়, তখন চার দেওয়ালে বন্দি স্কুলগুলো ঘুমিয়ে পড়ে। প্রথাগত শিক্ষা তো এমনই, যেখানে জোর করে মানুষের মাথার ওপর এমন সব বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেয়, সেখানে হয়তো যন্ত্রের মানুষ তৈরি হয়, জীবনমুখী মানুষ কি তৈরি হয়? হয়তো হয় না। আর হয় না বলেই মানুষ যত শিক্ষিত হয়, মানুষ তত স্বার্থপর হয়, মানুষ ততই লোভী হয়। সবার বেলায় হয়তো কথাটা সত্য নয়, আবার মিথ্যে বলে ফেলে দেওয়ারও নয়। সক্রেটিস বলতেন, জ্ঞানের চেয়ে চিন্তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। চিন্তা করতে শিখলে জ্ঞান নিজেই এসে ধরা দেয়।
স্কুলের শিক্ষায় এই জায়গাটাতেই যত গলদ, যেখানে জ্ঞানের পর জ্ঞান দেওয়া হয়, অথচ সেই জ্ঞান চিন্তাশক্তি তৈরি করতে পারল কি না তার বিচার করার মতো কেউ থাকে না। জ্ঞানদানের মাধ্যমে হয়তো মানুষকে জানানো যায়, জানার থেকে বড় হচ্ছে বিশ্বাস, সেই বিশ্বাস কখনো জন্মানো যায় না। প্লেটোর সঙ্গে অ্যারিস্টটলের সম্পর্ক খুব ভালো থাকলেও অ্যারিস্টটল তার গুরুর সব মতবাদের সঙ্গে একমত পোষণ করতেন না। বিশ্বাসের জায়গাটা এমনই, শিক্ষক বিশ্বাস গড়ে দেন, ছাত্র সেই বিশ্বাস ভেঙে নতুন বিশ্বাস গড়ে তোলেন। এই বিশ্বাস ভাঙা মানে বিশ্বাসঘাতকতা নয়, বরং চিন্তা থেকে উত্সারিত জ্ঞান থেকে নতুন জ্ঞান সৃষ্টির আনন্দে মেতে ওঠা। সবচেয়ে বড় কথা, ছাত্র যখন শিক্ষকের চিন্তাকে ছাড়িয়ে গিয়ে নতুন বিশ্বাসের জন্ম দেয়, তখন শিক্ষকের কাছে এর চেয়ে গর্বের, এর চেয়ে আনন্দের আর কিছুই হতে পারে না।
রবার্ট ব্রাউনিং, যাকে বলা হয় আশার কবি, প্রেমের কবি। যখন অন্যান্য কবিরা দুঃখকষ্ট, পাওয়া না-পাওয়ার যন্ত্রণাগুলো কবিতার ছন্দে রূপান্তরিত করত, তখন তিনি দুঃখকষ্ট, হতাশা-ব্যর্থতার মধ্যে সম্ভাবনাগুলোকে খুঁজতেন, আশার বীজ বুনতেন, স্বপ্ন দেখাতেন। ভেঙে যাওয়া হূদয়কে কবিতা দিয়ে জোড়া লাগানোর জাদু যেন তিনি জানতেন।
প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষক যা দিতে পারেন না, নিজের শিক্ষক নিজে হলে হয়তো সেটা পাওয়া যায়। শৈশবেই বড় বড় লেখকের বই পড়ে ফেলেছিলেন ব্রাউনিং, কেবল পড়ার জন্য পড়েননি, বইগুলো থেকে খুঁজেছেন জীবনের আস্বাদন। জীবনকে আরো গভীরভাবে জানতে হলে নিজের ভাষার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না বরং ভাষার পর ভাষা শিখে সারা পৃথিবীর বুকে লুকিয়ে থাকা জীবনকে খুঁজতে হবে। এই বিশ্বাস নিয়ে ফরাসি, ল্যাটিন, গ্রিক, ইতালিয়ান ভাষাগুলো কৈশোরেই শিখে ফেলেন তিনি ।
মাত্র ১২ বছর বয়সে লিখেছিলেন প্রথম কবিতার বই। কিন্তু বইটি প্রকাশ করার জন্য কেউ তেমন আগ্রহ দেখায়নি বলে রাগে-দুঃখে, ক্ষোভে, অভিমানে তিনি ছিঁড়ে ফেলেন সেই বই। যিনি সৃষ্টি করতে পারেন, তিনি ধ্বংসও করতে পারেন। এই পৃথিবী খুব কঠিন, সৃষ্টির মূল্য দিতে জানে না অথচ ক্ষমতার উচ্চমূল্যে কিনে নেয় সবকিছু। গান লিখেছিলেন, নাটকও লিখেছিলেন, কিন্তু যার মধ্যে কবিতা লুকিয়ে আছে, তিনি তো কবিই হয়ে উঠবেন।
জীবনের প্রথম দিকে কবি হিসেবে স্বীকৃতি না পেলেও, ১৮৬৮ থেকে ১৮৬৯ সালের মধ্যে লেখা তার ১২টি বইয়ের দীর্ঘ কবিতা ‘দ্য রিং অ্যান্ড দ্য বুক’ তাকে শ্রেষ্ঠ কবির সম্মান এনে দেয়। তখন তার বয়স ৫০ পেরিয়ে গেছে। কখনো কখনো স্বীকৃতির জন্য মানুষকে অনেকটা সময় অপেক্ষা করতে হয়। কারো কারো ক্ষেত্রে এই অপেক্ষা বেঁচে থাকতে হয় না, মরে যাওয়ার পর হয়। এই পৃথিবী বেঁচে থাকলে মূল্য বোঝে না, মরে গেলে বোঝে যে মানুষটাকে তারা হারিয়েছে, সে কতটা মূল্যবান ছিল।
রবার্ট ব্রাউনিংয়ের মা পিয়ানো বাজাতেন, হয়তো দুঃখের মধ্যে সুখের টুকরো টুকরো সুর সেখানে ছিল। সে পিয়ানোটার সুর সারা জীবন হয়তো তার কানে বেজেছিল, লেখাগুলোতেও লেগেছিল তার মায়ের গন্ধ। সেই গন্ধটাই হয়তো তাকে বলিয়েছিল, ‘মাতৃত্ব হলো সকল স্নেহ আর ভালোবাসার শুরু এবং শেষ।’ যেমন—তার কবিতাগুলো দীর্ঘ হলেও তার শুরু ছিল, শেষ ছিল, জীবনটাও তো তাই, সেটার পেছনে ছুটে চলা মানুষটা হয়তো এখনো চলছেন, মৃত্যু হয়েছে দেহের, জীবনটা যে এখনো বিদ্যমান।
ফিরে যাই শিক্ষার কথায়। প্রথাগত শিক্ষার বাইরেও একটি শিক্ষার বিষয় আছে। সেই শিক্ষাও পরোক্ষভাবে অনুপ্রাণিত হয় প্রথাগত শিক্ষার দ্বারা। ব্রাউনিং যাদের বই পড়তেন, তারা অনেকেই প্রথাগত শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। আজ আমাদের সমাজে প্রথাগত শিক্ষার বাইরের জ্ঞানচর্চাও সীমিত হয়ে গিয়েছে।
লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর