শিক্ষা ও চিকিৎসা ঢাকাকেন্দ্রিক
শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ মায়ের গর্ভে থাকা শিশুর শারীরিক ত্রুটি থাকলে পরীক্ষার মাধ্যমে বোঝা যায়। কিন্তু মস্তিষ্কে সমস্যা থাকলে তা সহজে ধরা পড়ে না। এসব শিশুর অস্বাভাবিক আচরণ বুঝে উঠতে জন্মের পর অন্তত দেড় বছর পর্যন্ত সময় চলে যায়। মা-বাবা যখন বুঝতে পারেন তাঁদের সন্তান অটিজম বা বিশেষ সমস্যায় ভুগছে, তখন আর কিছু করার থাকে না।
এসব কথা এমন বিশেষ সমস্যায় ভোগা এক শিশুর বাবার। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের অতিরিক্ত পরিচালক ডা. মো. নাজমুল করিম মানিক। তিনি বলেন, এসব শিশুর শিক্ষা ও চিকিৎসা রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক। অন্য কোনো শহর বা গ্রামে নেই বললেই চলে। এই বিশেষ শিশুদের জনপ্রতি ৭০০ টাকা করে ভাতা দিচ্ছে সরকার। অথচ তাদের খরচ অন্য সব শিশুর চেয়ে বেশি। মা-বাবা যত দিন জীবিত থাকেন, তত দিন তারা তাঁদের সাহচর্যে মোটামুটি ভালোভাবে দিন কাটাতে পারে। মা-বাবা কিংবা ঘনিষ্ঠজনের অবর্তমানে তাদের দেখভালে অনেক ক্ষেত্রে খুব সমস্যা হয়।
তিনি বলেন, যখন এসব বিশেষ শিশুর মা-বাবা থাকবে না, তখন এদের জীবনযাপনের সব দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। ঢাকায় এদের জন্য কাজ করছে বিএসএমএমইউর ইপনা আর প্রয়াস। এর বাইরে সরকারি আর কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। বাকি যেগুলো প্রাইভেট, সেগুলোতে অনেক খরচ। আমি মনে করি, বিশেষ শিশুদের জন্য সরকারি পর্যায়ে প্রথমে বিভাগে, তারপর জেলা পর্যায়ে কিছু প্রতিষ্ঠান করা উচিত।
মো. নাজমুল করিম বলেন, ‘আট-দশটা মানুষ যেভাবে স্বাভাবিক জীবন যাপন করে, গণপরিবহন ব্যবহার করে, রাস্তাঘাটে চলাচল করে, একজন অটিস্টিকের ক্ষেত্রে আমাদের সেই বাস্তবতা ভিন্ন। বর্তমানে অনেক অটিস্টিক শিশুই চাকরি করছে। কিন্তু তাদের জন্য অফিসে যাওয়াটা খুব কঠিন। সেই বিষয়গুলো নিয়েও কাজ করার প্রয়োজন।’
দ্য সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে আট বছর বয়সী প্রতি ৬৮ জন শিশুর মধ্যে একজন শিশু অটিজম স্পেকট্রাম ডিজ-অর্ডার বা স্নায়ুবিকাশজনিত সমস্যায় ভুগছে। সংক্ষেপে যা এএসডি নামে পরিচিত। ৪২ জন ছেলেশিশুর মধ্যে একজন ও ১৮৯ জন মেয়েশিশুর মধ্যে একজন এএসডি সমস্যায় ভুগছে।
এমন পরিস্থিতিতে আজ রবিবার ২ এপ্রিল বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ১৬তম বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস পালিত হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে—‘রূপান্তরের অভিযাত্রায় সবার জন্য নিউরোবান্ধব অন্তর্ভুক্তিমূলক বিশ্ব গঠন।’ দিবসটি উপলক্ষে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এ ছাড়া বিএসএমএমইউর ইপনার পক্ষ থেকে আলোচনাসভা ও শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়েছে।
সিডিসির তথ্য মতে, এএসডি শিশুদের মধ্যে ২১ শতাংশের বৃদ্ধিমত্তা একেবারে কম, ২৩ শতাংশের বুদ্ধিমত্তা স্বাভাবিকের তুলনায় কম এবং ৪৬ শতাংশ শিশু স্বাভাবিক অথবা স্বাভাবিকের ওপরে অবস্থান করে।
চিকিৎসকদের তথ্য মতে, এ সমস্যার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা সামাজিক যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে না, আশপাশের মানুষের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদানে তাদের সমস্যা হয় এবং একই ধরনের আচরণ বারবার করতে থাকে।
অটিজম সমস্যা থাকা শিশুদের ভাষা শিখতে সমস্যা হয়। শব্দ বা স্পর্শের প্রতি অতিসংবেদনশীলতা বা সংবেদনহীনতা থাকতে পারে। কখনো কখনো আচরণের সমস্যা দেখা দেয়। নাম ধরে ডাকলে অনেকে সাড়া দেয় না, চোখে চোখ রেখে তাকায় না। কারো কারো মধ্যে অতিচঞ্চল অমনোযোগিতা (এডিএইচডি) বা খিঁচুনি থাকতে পারে। অটিজমের বৈশিষ্ট্যগুলো শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের যেকোনো বয়সে দেখা দিতে পারে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তিন বছর বয়সের কাছাকাছি সময়ে দেখা যায়।
ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরো ডিজ-অর্ডার অ্যান্ড অটিজম (ইপনা)-এর তথ্য মতে, বাংলাদেশে অটিজমের বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশুর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি এ বিষয়ে দেশব্যাপী চালানো জরিপে দেখা গেছে, ১৬ থেকে ৩০ মাস বয়সী শিশুদের মধ্যে অটিজম রয়েছে প্রতি ১০ হাজারে ১৭ জনের।
ইপনার ট্রেনিং কো-অর্ডিনেটর ডা. মাজহারুল মান্নান বলেন, যাদের মাইল্ড অটিজম, তাদের পড়াশোনা করিয়ে বা ভোকেশনাল ট্রেনিং দিয়ে সমাজের বিভিন্ন জায়গায় কাজে লাগানো যায়। এ ক্ষেত্রে আবার দুই দিক ম্যানেজ করতে হয়। দেখা যায়, এদের কাজ করতে ইচ্ছা হলো না, তখন ওরা কাজ নাও করতে পারে। এগুলো মেনে বুঝে বিভিন্ন জায়গায় কাজে লাগাতে হয়।
ডা. মাজহারুল মান্নান বলেন, ২০০৯-২০১০ সালে অটিজম স্কুল ছিল ৮টা। এখন ঢাকাতেই শতাধিক স্কুল। তবে অনেকে অটিজম স্কুলের নামে ব্যবসা খুলে বসেছে। তবে সুবিধা হলো, অটিজম শিশুরা স্কুলে এসে চার-পাঁচ ঘণ্টা থাকে বলে মা-বাবা অন্য কাজের সুযোগ পান।
শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সঞ্জয় কুমার দে বলেন, ‘অটিজম প্রতিবছর বাড়ছে। এর সামাজিক ট্যাবু এখনো রয়ে গেছে। আমরা বলি বিশেষ শিশু, কিন্তু সামাজিকভাবে এদের সেভাবে গ্রহণ করা হয় না। ওদের প্রয়োজনীয় শিক্ষার ব্যবস্থা ঢাকার বাইরে অন্য জায়গায় নেই। চিকিৎসা প্রয়োজন হলে এখনো মা-বাবার সঙ্গে তাদের ঢাকায় আসতে হয়।’
তিনি বলেন, অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের বয়ঃসন্ধিকাল শুরুর আগে থেকে বিষয়টি নিয়ে মা-বাবা, শিক্ষক ও যত্নকারীকে সচেতন হতে হবে। কাউকে গল্পের মাধ্যমে, কাউকে ছবি ব্যবহার করে শারীরিক পরিবর্তনগুলো বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে। নারী-পুরুষের দৈহিক পার্থক্যগুলো তার সক্ষমতা অনুযায়ী বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০২/০৪/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়