শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত ‘নিঝুম দ্বীপ’ নেই মাধ্যমিক বিদ্যালয়
শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ হাতিয়া উপজেলা নোয়াখালীর মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। আবার অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি ‘নিঝুম দ্বীপ’ হাতিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন। পর্যটনের অপার সম্ভাবনার এই দ্বীপের বাসিন্দারা জেলে পেশার সাথে জড়িত। মাছ ধরেই জীবন নির্বাহ তাদের।
এই দ্বীপের বাসিন্দারা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় না থাকায় এই দ্বীপের ভবিষ্যত প্রজন্ম উচ্চশিক্ষা পাচ্ছে না। শিশুকালেই ঝরে পড়ছে শিক্ষার ওই পথটি থেকে। শিশুরাও জড়িয়ে পড়ছে জেলে পেশায়। বিদ্যালয়ের অভাবে নিরক্ষরতা ও শিশু শ্রম বাড়ছে এখানে। ফলে শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয়ে পড়েছেন অভিভাবকরা। এলাকাবাসীর দাবি দ্রুত একটি মাধ্যমিক স্কুল স্থাপন করা দরকার।
জানা গেছে, ২০০১ সালের ৮ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার দ্বীপটিকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে। ২০১৩ সালে দ্বীপটি ইউনিয়নের মর্যাদা লাভ করে। প্রায় ৬০ হাজার জনসংখ্যার এই দ্বীপ ইউনিয়নে রয়েছে মাত্র একটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের অভাবে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিকের আগেই ঝরে পড়ছে শিশুরা। তারা চলে যাচ্ছে তাদের পূর্ব পুরুষদের পেশা মাছ শিকরে।
গ্রামমবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিম্নমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ার সুযোগ রয়েছে। মাদরাসা শিক্ষার্থীদের রয়েছে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত। মূল হাতিয়া অথবা জেলা শহর নোয়াখালী অথবা পার্শ্ববর্তী চট্রগ্রামে শিক্ষার জন্য পাঠানো সম্ভব হয় না বেশিরভাগ পরিবারের সন্তানদের।
নিঝুম দ্বীপের মফিজা খানম নুরানী মাদরাসার শিক্ষার্থী মো. আবদুল্লাহ জানায়, তাদের এখানে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত রয়েছে। সে ৩য় শ্রেণিতে পড়ছে। তার বাবা একজন জেলে। যেহেতু চতুর্থ শ্রেণির পর মাদরাসায় কোনো পাঠদানের সুযোগ নেই তাই বাবার পেশায় যুক্ত হতে হবে তাকে। তার পড়াশোনার ইচ্ছা থাকলেও শুধুমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাবে ইচ্ছেপূরণ হবে না।
একই মাদরাসার চতুর্থ শ্রেণির কয়েকজন শিক্ষার্থী জানায়, চতুর্থ শ্রেণির পর আর পড়াশোনা না থাকায় তাদের বাড়িতেই থাকতে হয়। বাবা-মা তাদের দিয়ে মাছের কাজ করায়। চতুর্থ শ্রেণি পার হলে তাদের ভাগ্যে কি আছে, তা নিয়ে শঙ্কিত তারা।
নিঝুম দ্বীপ নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ফয়েজ হোসেনের বক্তব্য- সবার সামর্থ্য সমান নয়। অনেকেই এইট পাশ করার পর মূল হাতিয়া, জেলা শহর অথবা চট্রগ্রামে গিয়ে পড়াশোনা করে। অনেকের ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা শেষ হয়। তারপর পেটের তাগিদে নদীতে চলে যেতে হয়।
নিঝুম দ্বীপের সোহেল রানা নামের এক শিক্ষার্থী দশম শ্রেণিতে পড়ে মূল হাতিয়ায়। সেখানে সে নানার বাড়িতে থেকে পড়াশুনা করে। তিনি বলেন, আমার নানার বাড়ি মূল হাতিয়ায় হওয়ায় সেখান থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিবো। সেখানে খাওয়া-থাকা সহ নানান অসুবিধার মধ্যে পড়তে হয়। জেলে পরিবারের সন্তান তাই বাবা সব চাহিদা পূরণ করতে পারেন না। কিন্তু নিঝুম দ্বীপে যদি মাধ্যমিক স্বুল থাকতো তাহলে আমার এত কষ্ট করতে হতো না। অন্তত এসএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত নিজের বাড়িতে থেকে পড়তে পারতাম।
মো. অজিম উদ্দিন নামে একজন অভিভাবক বলেন, আমার ছেলে এখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। এখানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার সুযোগ আছে। কিন্তু বড় স্কুল না থাকায় আমাদের মতো তাদেরকেও জেলে পেশায় চলে আসতে হবে। বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় আমরা জেলে পেশায় যুক্ত হয়েছি। যদি বড় মাদরাসা অথবা স্কুল এখানে থাকতো, তাহলে অন্তত আমাদের সন্তানরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হতো না। আমাদের মতো সবার জীবন অন্ধকার হোক আমরা চাইনা। শিক্ষার আলো চাই।
আইয়ুব আলী নামের ডিপ্লোমা সম্পন্ন করা নিঝুম দ্বীপের এক বাসিন্দা বলেন, আমার পরিবারের সামর্থ্য ছিলো বলে আমি ঢাকায় গিয়ে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করতে পেরেছি। এখানের সবাই নদীর সাথে যুক্ত, তাই সবার সন্তানকে বাইরে শিক্ষার জন্য পাঠাতে পারে না৷ তবে যদি পর্যাপ্ত স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে তারা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হবেনা। পুরো নিঝুম দ্বীপ শিক্ষার আলোয় আলোকিত হবে।
মো. শাহিন নামের এক মাদরাসা শিক্ষক বলেন, মাছের সময় আসলে স্কুল মাদরাসায় শিক্ষার্থী খুঁজে পাওয়া যায় না। সবাই জেলে পেশায় যুক্ত হয়ে যায়। প্রতিষ্ঠান চালাতে আমাদের খুব কষ্ট হয়। কিছু মাদরাসা থাকলেও স্কুলের সংখ্যা কম হওয়ায় শিক্ষার আলো থেকে বেশিরভাগ শিশু বঞ্চিত। জেলেরা নিজেদের ভালো বুঝতে হলেও শিক্ষার প্রয়োজন আছে। নিজেদের জীবন সম্পর্কে সতর্ক হতে হলেও শিক্ষার প্রয়োজন আছে।
নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের শতফুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোজাক্কের হোসেন বলেন, যারা সুযোগ পেয়েছে তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে ভাল পেশায় যুক্ত হয়েছে। নতুন বসতি পূর্ণ এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ও নেই। জনসংখ্যা হিসেবে যা আছে তা খুবই অপ্রতুল। পড়ালেখার সুযোগ না থাকায় শিশুরা জাল ধরে জীবিকা নির্বাহ করছে।
নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল আফছার দিনাজ বলেন, শিক্ষার আলো থেকে নিঝুমদ্বীপ অনেক পিছিয়ে। জনবসতি হিসেবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনেক কমে। ফলে অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী ঝরে পড়ছে। তারা জেলে কাজে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। নিঝুম দ্বীপ পর্যটন এলাকা হিসেবে শিক্ষা ব্যবস্থা ভালো হওয়া দরকার। অন্তত আরও কয়েকটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রয়োজন। একটি মাধ্যমিক স্কুলের প্রয়োজন। তাহলে অন্তত শিক্ষা ব্যবস্থা কিছুটা পরিবর্তন হবে বলে আমি মনে করি।
হাতিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মাহবুব মোর্শেদ লিটন বলেন, প্রধানমন্ত্রী নিঝুম দ্বীপের নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলটিকে জাতীয়করণ করেছেন। আমরা চাই এই স্কুলটিকে মাধ্যমিক স্কুল হিসেবে অনুমোদন দেওয়া হোক। এটা আমাদের জোর দাবি। গরীব নিরীহ মানুষ গুলো শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত যেনো না হয় সেজন্য মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের খুব প্রয়োজন।
হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম হোসেন বলেন, মূল ভূখণ্ডের বাইরে হওয়ার পরও হাতিয়ার শিক্ষার মান খুব ভাল। কিন্তু নিঝুম দ্বীপ শিক্ষার দিক থেকে অনেক পিছিয়ে। এখানে কিছু অবকাঠামোগত প্রতিকূলতা রয়েছে। পর্যটন শিল্পের বিকাশের জন্য এখানে শিক্ষা সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। একটি মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুব প্রয়োজন। জেলা প্রশাসক স্যারসহ স্থানীয় সংসদ সদস্যের সাথে কথা বলে বিষয়গুলো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জানানো হবে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ফেরদৌসী বেগম বলেন, নিঝুম দ্বীপ মূল হাতিয়ার বাইরে হওয়ায় সেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব খারাপ। সেখানকার মানুষের আর্থিক অবস্থা নাজুক। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকলেও স্থানীয় শিক্ষিত মানুষ না থাকায় অন্য স্থান থেকে শিক্ষকদের যাতায়াত করতে হয়। এক্ষেত্রে স্থানীয় বাসিন্দাদের শিক্ষিত হওয়া প্রয়োজন।
জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার নুর উদ্দিন মো. জাহাঙ্গীর বলেন, নিঝুম দ্বীপে কোনো পূর্ণাঙ্গ মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই। যুগের চাহিদার সাথে এখানে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় খুবই দরকার। মাধ্যমিক বিদ্যালয় হলে এখানে শিক্ষার আলো প্রস্ফুটিত হবে। শিক্ষার্থীরা তাদের ভালো মন্দ বুঝবে। অভিভাবকরাও শিশুদেরকে জেলে পেশায় যেতে নিরুৎসাহিত হবে।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৮/০৩/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়