শিক্ষাক্রমে উদ্ভাবনী দক্ষতা ও আগামীর চ্যালেঞ্জ
শিক্ষাক্রমে উদ্ভাবনী দক্ষতা ও আগামীর চ্যালেঞ্জ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির কারণে ভবিষ্যতে চাকরির প্রকৃতি অনিশ্চয়তায় আবৃত।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও ছাত্রদের আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনে কাজ করছে। এটা সম্ভব হবে যদি উচ্চশিক্ষায় উদ্ভাবনের সংস্কৃতি গড়ে তোলা যায়।
অন্যদিকে প্রচলিত উচ্চশিক্ষা কারিকুলামে প্রয়োজনীয় উদ্ভাবন দক্ষতা সে অর্থে কম এবং এ শিক্ষাদান পদ্ধতির মাধ্যমে ছাত্রদের এসব দক্ষতা অর্জন করাও প্রায় অসম্ভব।
কারণ ওইসব দক্ষতা অর্জনে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি। সমসাময়িক গবেষণা কারিকুলামে উদ্ভাবন দক্ষতা সংযোজন এবং তা অর্জনে ছাত্রদের অংশগ্রহণমূলক বিকল্প শিক্ষাদান পদ্ধতির ওপর জোর দেওয়া হয়।
আধুনিকায়নের প্রভাব এবং পরিবর্তন সত্ত্বেও কিছু সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য টিকে থাকা দরকার। এশীয় সমাজে বিশেষ করে বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য শিক্ষাগত গতিশীলতাকে প্রভাবিত করে।
শিক্ষকদের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার কারণে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের আলোচনা শোনে এবং শিক্ষককেন্দ্রিক নির্দেশনা বেশি পছন্দ করে। কাজেই এসব বিবেচনায় রেখে প্রচলিত শিক্ষাদান পদ্ধতি সংস্কার করা দরকার এবং উদ্ভাবনতত্ত্ব প্রয়োগ করে শিক্ষায় একটি নতুন কার্যকর মডেল উদ্ভাবন করা যেতে পারে।
এ উপায় অনুসরণ করে আমরা ‘তাত্ত্বিক শিক্ষা’ এবং ‘কর্মজীবনের বাস্তব প্রয়োজনীয়তা’র মধ্যে শূন্যতা পূরণ করতে পারি এবং এটা ছাত্রদের পেশাগত উন্নতির সুবিধাও বাড়াবে।
এতে তারা অধ্যয়নের সময়েই পেশাগত উন্নতি অর্জন করতে পারবে। যাই হোক, দুটি পদ্ধতির মধ্যে কার্যকরভাবে ভারসাম্য আনতে এবং বিভিন্ন শিক্ষার শৈলী পূরণ করতে শিক্ষাবিদদের অধ্যয়ন ও ব্যাপক প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। স্পষ্ট যে, শিক্ষকদের বর্তমান টিচিং লোড অত্যন্ত বেশি।
ফলে শিক্ষাদান, মূল্যায়ন এবং ছাত্রদের কর্মক্ষমতা পরিমাপে আরও সময় দেওয়া প্রয়োজন হবে, নতুবা তাদের নতুন পরিবর্তন গ্রহণে অনাগ্রহ সৃষ্টি হবে। এসব সমস্যার সমাধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেই করতে হবে।
কার্যকর শিখন বোঝাও গুরুত্বপূর্ণ। মানবমস্তিষ্কের ‘ওয়ার্কিং মেমরি’ প্রথমে তথ্য গ্রহণ করে তা ‘লংটার্ম মেমরি’তে প্রেরণ করে। যার সময়কাল এবং ক্ষমতা উভয় ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। উল্লেখযোগ্য, যে তথ্য প্রক্রিয়া করা হয় কিন্তু রিহার্সাল করা হয় না, সেকেন্ডের মধ্যে তা হারিয়ে যেতে পারে।
জটিল শিক্ষার পরিবেশ, যেমন লেকচারভিত্তিক শিক্ষা ওয়ার্কিং মেমরিকে সহজেই ওভারলোড করে। ফলে খণ্ডিত তথ্য লংটার্ম মেমরিতে প্রেরণের কারণে শিক্ষা বাধাগ্রস্ত হতে পারে। লংটার্ম মেমরি অভিজ্ঞতা থেকে সঞ্চিত জ্ঞানের বিশাল ভান্ডার ধারণ করতে পারে।
শিক্ষাক্ষেত্রে সক্রিয় নিযুক্তি ছাত্রদের লংটার্ম মেমরিতে জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে সাহায্য করে, যা তাদের অধ্যয়ন ও কর্মক্ষেত্রে জটিল সমস্যা কার্যকরভাবে সমাধানে লংটার্ম মেমরিতে প্রবেশ করতে পারে।
বিপরীতে প্রচলিত ‘চক ও ডাস্টার’ শিক্ষাদান পদ্ধতি, যা শিক্ষককেন্দ্রিক, এটি প্রাথমিকভাবে শিক্ষার্থীদের কাছে অল্প সময়ে বিপুল তথ্য প্রেরণের সঙ্গে জড়িত।
ওয়ার্কিং মেমরি লংটার্ম মেমরিতে তথ্যের একটি বড় অংশ পাঠাতে পারে না। এ পদ্ধতি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান অনুশীলন থেকে বাদ দেওয়া উচিত কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
ছাত্রকেন্দ্রিক শিখন পদ্ধতি, যেমন প্রজেক্ট বেজ্ড লার্নিং, প্রবলেম সল্ভিং লার্নিং ও ইনকোয়ারি বেজ্ড লার্নিং তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য কার্যকর হিসেবে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত।
সে জন্য প্রচলিত ও উদ্ভাবনী শিক্ষা পদ্ধতির মিশ্রণ প্রয়োজন। ট্র্যাডিশনাল শিক্ষাদান পদ্ধতি তাত্ত্বিক ধারণার জন্য কাঠামো প্রদান করতে পারে।
বিকল্প পদ্ধতি সৃজনশীলতা ও স্বাধীন শিক্ষাকে উৎসাহিত করতে পারে। যাই হোক, দুটি ভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে কার্যকরভাবে ভারসাম্য আনতে, বিভিন্ন শিক্ষা পদ্ধতি জানতে এবং সফলভাবে প্রয়োগ করতে শিক্ষাবিদদের ব্যাপক প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।
উদ্ভাবনের মাধ্যমে কর্মক্ষেত্র ও সমাজে ব্যাপকভাবে জ্ঞান ও ধারণা তৈরি এবং প্রয়োগ করতে সক্ষম হওয়া যায়। ক্রিটিক্যাল থিংকিং, ক্রিয়েটিভিটি, প্রবলেম সল্ভিং, এন্টারপ্রেনিউরশিপ, ডিসিশন মেকিং ও লাইফলং লার্নিং উদ্ভাবনের জন্য অপরিহার্য। গবেষণা বলে, যেসব উদ্ভাবন দক্ষতা একক পৃথক কোর্সের পরিবর্তে প্রোগ্রামের বিষয়বস্তুর সঙ্গে যুক্ত থাকে, সেগুলো আরও ভালোভাবে শেখা হয়। অতএব, একটি প্রোগ্রামের অধীনে কিছু কোর্স চিহ্নিত করা গুরুত্বপূর্ণ।
যেখানে উদ্ভাবন দক্ষতা শেখানো ও মূল্যায়ন করা হবে। কোর্সে উদ্ভাবন দক্ষতা একীভূত করার ক্ষেত্রে স্থানীয় অনুষদ সদস্যদের বর্তমানে অভিজ্ঞতার অভাব থাকায় বিদেশি অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদদের সহযোগিতা প্রয়োজন হবে।
একটি প্রোগ্রামের মধ্যে উদ্ভাবন দক্ষতা কারিকুলামে একীভূত করার কৌশল লিটারেচার অধ্যয়নের মাধ্যমে জানা সম্ভব হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ এখানে লিটারেচার অধ্যয়নের ভিত্তিতে বিবিএ প্রোগ্রামে উদ্ভাবন দক্ষতার কয়েকটি একীকরণ কীভাবে করা যায় তা সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো–
ইন্টারডিসিপ্লিনারি প্রজেক্ট: ইন্টারডিসিপ্লিনারি প্রজেক্টের জন্য অন্যান্য ডিপার্টমেন্ট বা ডিসিপ্লিন যেমন ইঞ্জিনিয়ারিং, কম্পিউটার সায়েন্সের সঙ্গে সহযোগিতা দরকার। এটি শিক্ষার্থীদের কাছে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে এবং উদ্ভাবনী থিংকিং উৎসাহিত করে।
এন্টারপ্রেনিউরশিপ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজমেন্ট: এ কোর্স উদ্যোক্তা মানসিকতা, সৃজনশীল সমস্যা সমাধানের দক্ষতা এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা বিকাশের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। শিক্ষার্থীরা এ কোর্সে ক্রিটিক্যাল থিংকিং ও ক্রিয়েটিভি প্রবলেম-সল্ভিং স্কিল, ব্যবসায়িক মডেল বিকাশ এবং কৌশলগত পরিকল্পনা সম্পর্কে শেখে।
কন্টিনিউয়াস লার্নিং অ্যান্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট: কন্টিনিউয়াস লার্নিং, প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট এবং লাইফলং লার্নিংয়ের দক্ষতার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা মডিউল বা কর্মশালাকে বিবিএ পাঠ্যক্রমের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। বিষয়গুলোর মধ্যে টাইম ম্যানেজমেন্ট, লক্ষ্য নির্ধারণ, নেটওয়ার্কিং এবং ব্যক্তিগত ব্র্যান্ডিং অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
প্রজেক্ট বেজ্ড লার্নিং ও প্রবলেম বেজ্ড লার্নিং দুটি বিকল্প শিক্ষাদান পদ্ধতি, যা প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান বা মানবিকসহ উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন শাখায় সফলভাবে অভিযোজিত হয়েছে।
স্থাপত্য, ব্যবসা, আইন, প্রকৌশল, সমাজকর্ম, শিক্ষা এবং অন্য অনেক পেশাগত ক্ষেত্রের প্রোগ্রামগুলোও এ দুটি বিকল্প শিক্ষাদান পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিকল্প শিক্ষাদান পদ্ধতি ব্যবহারের কথা বলতে শুনি না। শিক্ষকদের ট্র্যাডিশনাল ‘চক অ্যান্ড ডাস্টার’ শিক্ষাদান পদ্ধতির সঙ্গে এ দুটি বিকল্প শিক্ষাদান পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে।
প্রযুক্তির জটিল প্রকৃতি এবং বিভিন্ন সামাজিক চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চশিক্ষা কারিকুলামে উদ্ভাবনমূলক দক্ষতা সংযোজনের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার সময় এসেছে। শিক্ষকদের তাদের প্রোগ্রামে বিকল্প শিখন পদ্ধতি ব্যবহারের উপযুক্ত কোর্স চিহ্নিত এবং ছাত্রদের উদ্ভাবন যোগ্যতা মূল্যায়নের দক্ষতা অর্জন করতে হবে।
কাজটি করতে ব্যর্থ হলে বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করতে পারবে না। চাহিদামাফিক পাঠ্যক্রম প্রণয়ন এবং উদ্ভাবনী শিক্ষা ও শেখার বিকাশ অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
এম. এম. শহিদুল হাসান: প্রাক্তন উপাচার্য, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষাবার্তা ডট কম/জামান/২৮/০৩/২০২৪