দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়
'শিক্ষক' হয়ে ওঠাই সবচেয়ে কঠিন
শিক্ষাবার্তা ডেস্কঃ পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন শিক্ষক হওয়া, তার চেয়েও কঠিন ছাত্র হওয়া। পৃথিবীর সব মানুষ আমার শিক্ষক, আমি তাদের ছাত্র- এর চেয়ে সুখের কিছু আর হতে পারে না। প্রতিদিন মানুষের কাছে শিখছি, সেটি ভালো-মন্দ দুটোই হতে পারে। তবে অবাক করার মতো বিষয় হলো স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের কাছ থেকে বইয়ে যা লেখা আছে সেটিই জেনেছি। বইয়ের বাইরেও যে শেখার বিশাল জগৎ আছে, তেমনটা কখনও শিখতে পারিনি। জানতেও পারিনি।
যদিও শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য- শিক্ষার্থীদের কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে শেখানো; বইয়ের ভেতরের লেখা অক্ষরগুলো ক্রমাগত গবেষণার বস্তুতে পরিণত হয়ে পরিবর্তন হতে হতে কোন জায়গাটাতে এসে পৌঁছেছে তা জানানো; কোন কোন জায়গায় চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে তা বোঝানো। এসব বিষয় নিয়ে শিক্ষার্থীদের চিন্তার জগৎকে হালকা বাতাসের মতো একটু নাড়া দেওয়া। সেটি নিয়ে দুশ্চিন্তা তৈরি করা না; বরং শিক্ষার্থীদের চিন্তার গভীরে নিজের মাথাটা ঢুকিয়ে তাদের মধ্যে এমন এক ধরনের আনন্দের অতৃপ্তি জন্মানো, যা খুঁজতে খুঁজতে শিক্ষার্থীরা নতুন কিছু বের করে আনবে। যা পৃথিবীর চিরায়ত ধারণা পাল্টে দেবে। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র, তাই গবেষণার চ্যালেঞ্জগুলো চোখে পড়ছে। সেসব চ্যালেঞ্জের সমাধান কীভাবে খোঁজা যায় তেমন সৃজনশীল চিন্তায় শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করা দরকার। কিন্তু সেটা কতটুকু হচ্ছে?
হাইড্রোজেন স্টোরেজ নিয়ে সারাবিশ্বে গবেষণা চলছে। চ্যালেঞ্জও আছে অনেক। শিক্ষার্থীদের জানানো দরকার, সেসব চ্যালেঞ্জ কী? বোরোফেন নামের আধুনিক ম্যাটেরিয়াল হাইড্রোজেন স্টোরেজ করতে পারে, কিন্তু এর বাণিজ্যিক উৎপাদনের প্রক্রিয়া এখনও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। যদিও ল্যাবরেটরিভিত্তিক রিসার্চ কিছুটা আশার সঞ্চার করেছে। কিন্তু চ্যালেঞ্জ তো আছেই। হাইড্রোজেন স্টোরেজ ছাড়াও এই ম্যাটেরিয়াল অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। গবেষকরা বলছেন, সিলিকনের বদলে গ্রাফেন নামের ম্যাটেরিয়াল সেমিকন্ডাক্টর হিসেবে ব্যবহার করা গেলে এর কার্যকারিতা ২৫০ গুণ বাড়ানো সম্ভব। কিন্তু এখানেও চ্যালেঞ্জ আছে। গ্রাফেনের ব্যান্ড গ্যাপ শূন্য। সিলিকনের মতো এর সহজাত (ইন্ট্রানসিক) ব্যান্ড গ্যাপ নেই। শিক্ষার্থীদের এসব বিষয় কি জানানো সম্ভব হচ্ছে?
লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারিতে এনোড ম্যাটেরিয়াল হিসেবে গ্রাফাইট বা কার্বন ব্যবহূত হচ্ছে। কিন্তু এই ব্যাটারিতে গ্রাফাইট বা কার্বনের পরিবর্তে সিলিকন ব্যবহার করা গেলে এর কার্যকারিতা ১০ গুণ বাড়ানো সম্ভব। মূল সমস্যা হচ্ছে, সিলিকনের আয়তনের দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটায় এর খুব দ্রুত ক্ষয় ঘটে। তার মানে এখানেও চ্যালেঞ্জ আছে। যেখানে চ্যালেঞ্জ সেখানেই সম্ভাবনা। সেজন্য চ্যালেঞ্জ নেওয়ার মতো শিক্ষার্থী গড়ে তুলতে হবে।
এখানে কয়েকটি চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করেছি। এমন অনেক চ্যালেঞ্জ বিজ্ঞান ও গবেষণায় রয়েছে, যা আমাদের শিক্ষার্থীরা জানতে পারছে না। সেগুলো নিয়ে চিন্তা করার সুযোগও পাচ্ছে না। বিজ্ঞান ছাড়া অন্যান্য শাখাতেও বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, রয়েছে সম্ভাবনাও। সেগুলো আমাদের শিক্ষার্থীরা জানতে পারছে না।
শিক্ষকদের বই হয়ে ওঠা তেমনটা চোখে পড়ছে না। যেদিন শিক্ষকরা একেকটা বইয়ের চেয়ে আরও বড় হয়ে উঠতে পারবেন, সেদিন হয়তো ছাত্রদের জ্ঞানপিপাসা মিটবে। নিজের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি, ছাত্রদের পড়াতে হলে শিক্ষকদের অনেক বেশি পড়তে হয়। জ্ঞানচর্চা করতে হয়। গবেষণা করে নতুন জ্ঞান আহরণ করতে হয়। জ্ঞানের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো সক্ষমতা থাকতে হয়। সেগুলোও তেমনটা দেখছি না। বরং শিক্ষকদের মধ্যে প্রশাসক হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। শিক্ষকের গুণাবলি অর্জনের প্রবণতা কমছে। শিক্ষকরা পদ-পদবির লোভে পড়ে নিজের ব্যক্তিত্ব ও স্বকীয়তা হারাচ্ছেন। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করতেও লজ্জিত হচ্ছেন না। এমনকি শিক্ষকদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ির মতো ঘটনাও ঘটছে। শিক্ষার্থীরা এসব থেকে ভালো কিছু শিখছে না। এ বিষয়গুলো নিয়ে দেখার কেউ নেই; ভাবার কেউ নেই। গোটা সমাজ যেন গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়েছে।শিক্ষায় চিন্তার চর্চার চেয়ে মুখস্থবিদ্যার চিন্তা প্রাধান্য পেলে এর মূল্যইবা কতটুকু। চোখে দেখলেই তো মন ভরবে না; শিক্ষায় যতটা চোখের ক্ষুধা মেটানোর লোভ ততটাই মনের খোরাক মেটানোর অভাব। অথচ কপালের নিচে চোখের চেয়ে অদৃশ্য মনের দাম অনেক বেশি। যা মানুষ চোখে দেখে তা যতটা না মূল্যবান, এর চেয়েও বেশি মূল্যবান মানুষ যা চোখে দেখে না।
দৃশ্যমান চিন্তার চেয়ে অদৃশ্যমান চিন্তার শক্তি অনেক বেশি। এটি কোনো মনস্তত্ত্ব বা দর্শনতত্ত্ব নয়; এটি সহজ তত্ত্ব, সরল তত্ত্ব। ফুলের সৌন্দর্য সবাই দেখতে পায়, ফুলের গন্ধ কেউ চোখ দিয়ে দেখতে পায় না। অথচ গন্ধ ছাড়া ফুল মূল্যহীন। ফুলের গন্ধ না দেখতে পেলেও মানুষ সেই গন্ধের অস্তিত্বকে বিশ্বাস করে। যা মানুষের মধ্যে অনুভূতি গড়ে দেয়। মন না থাকলে অনুভূতি থাকে না। শিক্ষায় তাই যন্ত্র তৈরি না করে মন তৈরিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
প্রকৃতির কাছ থেকে শিখছি। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে শিখছি। ক্লাসরুমে বসে থাকা ৬০ থেকে ১২০ জন শিক্ষকের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটার পর একটা প্রশ্ন করতে করতে শিখছি। যদিও এই ৬০ থেকে ১২০ জন কারও কাছে হয়তো ছাত্রের চেয়ে বেশি কিছু নন; কিন্তু আমার কাছে তাঁরা মহান শিক্ষক। আগামী দিনের পৃথিবী বদলানোর মহানায়ক। সবচেয়ে মজার বিষয়, আমি সারাজীবন ক্লাসরুমে দাঁড়িয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাই। তাঁরা বছর গড়িয়ে একসময় আমাকে ছেড়ে চলে যান। তবে যাওয়ার আগে আবার নতুন নতুন সম্ভাবনাময় শিক্ষককে তাঁদের জায়গায় বসিয়ে দিয়ে যান। এই ধারা অব্যাহত থাকে। আমার সঙ্গে পরিচয় ঘটে নতুন নতুন শিক্ষকের। এই জায়গাটাই আমার জন্য গর্বের, আনন্দের, অনুভূতির সত্যি কথা বলতে, স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মধ্যে আমি কোনো পার্থক্য খুঁজে পাইনি। নামগুলোই বদলেছে, জায়গা বদলেছে, একটার পর একটা বছর পেরিয়ে ক্যালেন্ডারে সময় বদলেছে, বয়সও বদলেছে, বড় বড় ডিগ্রি নিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্মে বেকার বদলেছে; কিন্তু সেখান থেকে যা পাওয়ার কথা ছিল তা পাওয়া হয়নি।
ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী : অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২১/০২/২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে পেজে লাইক দিয়ে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়।
সর্বশেষ
জনপ্রিয়
এই বিভাগের আরও খবর