শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে আত্মানুসন্ধান
ড. মাহবুব উল্লাহ্ ।।
গত ২৫ জানুয়ারি একটি দৈনিক শেষের পাতায় একটু অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদনের শিরোনাম করেছে, ‘সমস্যা শিক্ষক রাজনীতিতে’। প্রতিবেদনের ভূমিকায় লেখা হয়েছে, ‘শিক্ষাঙ্গনে বড় সমস্যা শিক্ষকদের অতিরিক্ত রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া।
বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক এখন সরাসরি রাজনৈতিক দলের সদস্য। অনেকে রয়েছেন জেলা ও উপজেলা কমিটিতেও। তারা শিক্ষকতার চেয়ে বেশি সময় দেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে। আবার কেউ কেউ আওয়ামী লীগ-বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের চেয়েও বেশি দলীয় অবস্থান প্রদর্শনে ব্যস্ত।
সিনিয়র শিক্ষকরা মনে করেন, রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা অতীতেও শিক্ষকদের ছিল। কিন্তু এখনকার মতো ভয়াবহ অবস্থা অতীতে কখনো হয়নি। তাই এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে এখনই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। দেশ ও মানুষের প্রশ্নে শিক্ষক রাজনীতি অবশ্যই থাকবে। কিন্তু দলবাজিতে বেশি যুক্ত হলে সমস্যা হয়। সম্মানজনকভাবে সবকিছুতে কাজ করা দরকার বলে মনে করেন অনেক প্রবীণ শিক্ষক।
সার্বিক অবস্থা নিয়ে বিশিষ্ট শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেছেন আমাদের প্রতিবেদক।’ যাদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে তারা হলেন ড. একে আজাদ চৌধুরী, ড. এসএমএ ফায়েজ এবং আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। এ তিনজন গত দুই দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। উপাচার্য হলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে কেউ বিশিষ্ট শিক্ষক হয়ে যান না।
এ তিনজন সাবেক উপাচার্য ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও অনেক বিশিষ্ট শিক্ষক রয়েছেন। এরা নিভৃতচারী। এরা সংবাদপত্রের পাতায় শিরোনাম পান না। তবে তারা নিয়মিত ক্লাস নেন। তারা চেষ্টা করেন কী করে নতুন জ্ঞানের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায়। তারা দলীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়াকে গৌরবের বিষয় মনে করেন না। এসব শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মনের মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছেন।
রাজনীতি ছাড়াও আরও কিছু বিষয় রয়েছে যেমন-কনসালটেন্সি। কনসালটেন্সির কাজ করলে অতিরিক্ত বেশ পরিমাণ টাকা রোজগার করা সম্ভব হয়। কনসালটেন্সি এক ধরনের লেখাপড়ার কাজ, তবে কনসালটেন্সি চর্চায় জ্ঞান সৃষ্টি হয় না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, কনসালটেন্সির নিয়োগকারীরা পূর্বাহ্নেই বলে দেন কী ধরনের রিপোর্ট ও সুপারিশ তারা আশা করেন।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, কনসালটেন্সির কাজে আলো বিচ্ছুরণকারী জ্ঞানের সৃষ্টি হয় না। আবার এ কথাও সত্য যে কনসালটেন্সির জন্য একাডেমিকভাবে ভালো যোগ্যতা থাকতে হয়। আর্থিক অসচ্ছলতার জন্য যারা কনসালটেন্সি করেন তারা নিশ্চয়ই জানেন শিক্ষকতার মহান ব্রতে জাঁকজমকপূর্ণ জীবনযাত্রা আশা করা যায় না।
এ প্রসঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের একটি বিখ্যাত উক্তি আছে। উক্তিটি হলো, ‘ধন চাহত তাহা হইলে এই পথে আসিও না। মান চাহত তাহা হইলে এই পথে আসিও। তিন্তিড়ি বৃক্ষের পত্র ভক্ষণ করত জীবন ধারণ করিতে চাহো তাহা হইলে এই পথে আসিও।’ বিদ্যাসাগর মহাশয় শিক্ষকতা ব্রতের জন্য যেভাবে ত্যাগ স্বীকার করতে আহ্বান জানিয়েছেন সেটা হয়তো আজকের বাস্তবতায় মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
তবে শিক্ষকদের মধ্যে যদি কিছুটা হলেও ত্যাগের মনোভাব বজায় থাকে তাহলে একজন শিক্ষক নিছক শিক্ষকই থকবেন না, তিনি হবেন একজন সাধক। আজকের ভোগবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে কোনো পেশার মানুষের এ রকম ত্যাগ স্বীকার করতে সম্মত হওয়া বাস্তবধর্মী নয়। শিক্ষকরা যদি সাদামাটা জীবনযাপন করে, তাহলে এর প্রভাব শিক্ষার্থীদের ওপরও পড়তে পারে।
পাকিস্তান আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের জন্য অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন অন্তর্ভুক্ত ছিল। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের বৈশিষ্ট্য কেমন হবে তা জানানোর জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়োজ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের মতামত জ্ঞাপনের জন্য বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান একটি খসড়া তৈরি করে দেওয়ার আহ্বান জানান।
আমি এদেরই একজনের কাছ থেকে জনতে পেরেছি ১৯৭৩-এর বিশ্ববিদ্যালয় আইনের খসড়াটি তারা যেভাবে লিখে দিয়েছেন জাতীয় সংসদে সেটাই পাস হয়ে যায়। তবে এ আইনের খসড়া দেখে শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব মন্তব্য করেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যদি এতগুলো নির্বাচন হয়, তাহলে শিক্ষকরা পড়াবার সময় পাবেন কখন? বলা বাহুল্য, এ মানুষটি বুঝতে পেরেছিলেন অতি গণতন্ত্র অনেক সময় অতি ক্ষতিকর হয়।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে গুণী মানুষ হতে হয়। তিনি যেমন অগাধ জ্ঞানের অধিকারী হবেন, তেমনি হবেন প্রশাসন চালানোর বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন মানুষ। বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রথমদিকে যারা উপাচার্য হয়েছেন তারা প্রায় সবাই ছিলেন উঁচু মাপের মানুষ। প্রফেসর আবুল ফজল, ড. এনামুল হক, সৈয়দ আলী আহসান, খান সারোয়ার মোর্শেদ, প্রফেসর মুজাফ্ফর আহমেদ চৌধুরী, ড. আব্দুল মতিন চৌধুরী এবং প্রফেসর আব্দুল করিমের মতো ব্যক্তিবর্গ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য পদ অলংকৃত করেছিলেন।
পাণ্ডিত্যের কারণে ছাত্রছাত্রীরা তাদের সমীহ করত। তারাও ছাত্রছাত্রীদের আপন সন্তানতুল্য মনে করতেন। তাদের ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য যোগ্য ব্যক্তিদের শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ প্রদানের আন্তরিক চেষ্টা।
বাংলাভাষায় একটি প্রবাদ আছে। এ প্রবাদে বলা হয়েছে, ‘সেই রামও নাই, সেই অযোধ্যাও নাই।’ স্কুল জীবনে ট্রান্সলেশন করতে গিয়ে এ প্রবাদ বাক্যটিকে ইংরেজিতে অনুবাদ করতে হতো। ইংরেজি ভাষায় এর অনুবাদ ছিল Oh the man, oh the time. অর্থাৎ রামের মতো সৎ ও লোভমুক্ত মানুষ এখন পাওয়া যায় না। একইভাবে পাওয়া যায় না অযোধ্যার মতো পাপাচারমুক্ত শহর।
রাম ও অযোধ্যা পৌরাণিক কাহিনির বিষয়। এর মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে গ্রহণযোগ্য কোনো সত্য নিহিত আছে কিনা তা নিয়ে ভারতীয় ইতিহাসবিদরা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে গেছেন। রমিলা থাপারের মতো প্রাচীন ভারত বিশেষজ্ঞ মনে করেন পৌরাণিক কাহিনি ইতিহাসে গ্রহণযোগ্য নয়। ইতিহাস নিয়ে এসব বিতর্ক সত্ত্বেও নির্দ্বিধায় বলা যায় বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম যুগের মতো নেতৃত্ব এখন আর পাচ্ছে না।
পাকিস্তান আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে বিরোধ ছিল না, এমন নয়। মোটামুটিভাবে বলা যায়, এ শিক্ষকদের মধ্যে একটি অংশ ছিল প্রগতিশীল এবং অপর অংশটি ছিল প্রতিক্রিয়াশীল। তবে এখনকার মতো নীল, সাদা ও গোলাপি দল ছিল না। শিক্ষকরা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। সুযোগ পেলে সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে শিক্ষকরা তাদের চিন্তাভাবনা ব্যক্ত করতেন। ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের উদ্যোগে অর্থনৈতিক প্রদর্শনী ও সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছিল।
এ প্রদর্শনীতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য গ্রাফ ও চার্টের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছিল। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক সূচকগুলো তুলে ধরা হয়েছিল। ছাত্রছাত্রীরা দর্শকদের কাছে এসব চার্ট ও গ্রাফের ব্যাখ্যা তুলে ধরেছিল। এ প্রদর্শনীতে তিন দিন ধরে ব্যাপক দর্শনার্থী এসেছিল। সাধারণ মানুষ অর্থনীতির জটিল বিষয়গুলো সহজেই বুঝে নিচ্ছিল। সেমিনারগুলোতে বিপুলসংখ্যক মানুষ যোগদান করেছিল। এ প্রদর্শনীর মাধ্যমে অর্থনীতির মতো একটি কঠিন বিষয়ের সহজ করে দেওয়া ব্যাখ্যা শুনে তারা নিজেদের চিন্তার স্তরকে উন্নীত করেছিল।
একটি অনুন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ মানুষের চিন্তা-চেতনার স্তরকে কীভাবে উন্নত করতে পারে, এ প্রদর্শনী ছিল তারই একটি দৃষ্টান্ত। দুর্ভাগ্যের বিষয় এখন অর্থনীতি বিভাগ এ ভূমিকাটি পালন করে না। অবশ্য এ ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনে বিভাগীয় শিক্ষকদের মধ্যে উদ্যোগে ঘাটতির একটি বড় কারণ হলো রাজনৈতিক বিভাজন। একদল শিক্ষক যদি বলে আমরা এ রকম একটি অনুষ্ঠান করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করব, তখন আরেক দল শিক্ষক এর বিরোধিতা করবে।
কারণ তারা মনে করতে পারে এ রকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে সরকারকে বিব্রত করার জন্য। যদি এ রকম বিরোধিতা অতিক্রম করেও এমন একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, তাহলে দেখা যাবে সরকারের অনুগত একদল ছাত্র অনুষ্ঠানটি ভণ্ডুল করার জন্য সন্ত্রাসের আশ্রয় গ্রহণ করছে। বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা মুক্ত চিন্তা ও ধ্যান-ধারণার প্রতিষ্ঠান হিসাবে যতই ভাবি, বাস্তবে এখন আর এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চিন্তা ও দর্শনের দিক থেকে অতি ভঙ্গুর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ‘স্কুল অব থট’ বলে একটি মূল্যবান ধারণা রয়েছে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে ‘স্কুল অব থট’ নিয়ে। কোনো রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় নেওয়া অথবা ক্ষমতা থেকে নামিয়ে আনা শিক্ষকদের কাজ নয়। বিভিন্ন ‘স্কুল অব থটের’ মধ্যে প্রতিযোগিতা চিন্তার ক্ষেত্রকে সম্প্রসারিত করে। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞান উৎপাদনের কাজটি সহজ হয়ে যায়। উন্নত দেশগুলোতে এমন ধরনের চর্চা অন্তত পাঁচশ বছর ধরে চলে আসছে।
প্রফেসর একে আজাদ চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানও ছিলেন। উভয় পদটি তিনি অলংকৃত করেছিলেন আওয়ামী লীগের শাসনামলে। তিনি মনে করেন, শিক্ষকরা রাজনীতিসচেতন হবেন। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করতে পারেন। কিন্তু দলীয় লেজুড়বৃত্তি শিক্ষকদের মানায় না। শিক্ষকদের প্রধান কাজ পাঠদান, গবেষণা।
দলীয় কার্যক্রম প্রদর্শনের চেয়ে দেশের শিক্ষার মানোন্নয়নে নজর দিতে হবে। তিনি আরও বলেছেন, শিক্ষকরা দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে রাজনৈতিক ভূমিকাও পালন করবেন... দেশের রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হলে তাতেও তেমন দোষের কিছু দেখি না। ...১৯৭৩-এর বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী শিক্ষকরা রাজনৈতিক দলের সদস্য হতে পারেন। তবে সরাসরি রাজনৈতিক দলে যুক্ত হয়েছেন খুব বেশি নয়। কিন্তু সমস্যাটা তখনই সৃষ্টি হয়, যখন দেখা যায় নতুন শিক্ষক নিয়োগের সময় তার দলের সমর্থনপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে তিনি উৎসাহী হয়ে ওঠেন। প্রফেসর একে আজাদ চৌধুরী আরও বলেছেন, পার্টির কার্ডহোল্ডারদের মতো কাজ করলে তা এ পেশার সঙ্গে খাপ খায় না।
পাঠদান-গবেষণা বাদ দিয়ে পার্টি, দলীয় অবস্থান প্রদর্শনে ব্যস্ত থাকলে চলবে না। পদ-পদবি পেতে নিজের পেশার সম্মান বিকিয়ে দেওয়া কোনো শিক্ষকের কাছে সমাজ প্রত্যাশা করে না। প্রফেসর একে আজাদ চৌধুরী যা বলেছেন তা নিঃসন্দেহে মূল্যবান। তবে প্রশ্ন থেকে যায় দলীয় লেজুড়বৃত্তির সংজ্ঞা কী? দলীয় লেজুড়বৃত্তি করা, দলীয় লেজুড়বৃত্তি না করা-এ দুয়ের মধ্যে সীমারেখা কীভাবে নিরূপণ করা যায় তার জন্য গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এসএমএ ফায়েজ বলেছেন, শিক্ষকতা ছাড়া রাজনৈতিক দল কিংবা অন্য কোনো পদের প্রতি মোহ থাকা শিক্ষকদের জন্য উচিত নয়। তবে সচেতন নাগরিক হিসাবে প্রত্যেকেরই ব্যক্তিস্বাধীনতা থাকতেই পারে। কিন্তু শিক্ষক হিসাবে যখন আপনি থাকবেন, তখন এটাকেই বড় করে দেখতে হবে। তিনি আরও বলেছেন, সবারই একটি রাজনৈতিক দল থাকতে পারে।
কিন্তু শিক্ষকতা করার ক্ষেত্রে এর কোনো প্রভাব পড়বে না। অর্থাৎ আপনার রাজনৈতিক আদর্শের কোনো কিছুই শিক্ষকতার ওপর প্রভাব ফেলবে না। শিক্ষকদের নিরপেক্ষতার জায়গা থেকে ছাত্রদের পাঠদান করাতে হবে। প্রশাসন চালাতে হবে। বিশেষ করে দায়িত্বশীল কোনো জায়গা থেকে শিক্ষকদের কোনোভাবেই লেজুড়বৃত্তি করা ঠিক হবে না।
দেখা যাচ্ছে প্রফেসর আজাদ চৌধুরী ও প্রফেসর ফায়েজ প্রায় একই ধরনের কথা বলেছেন। দুজনেই শিক্ষকদের দলীয় লেজুড়বৃত্তি করার বিরোধী। কিন্তু এটা কীভাবে চিহ্নিত হবে তা দুজনের কেউই স্পষ্ট করেননি। আসল কথা হলো একজন শিক্ষক কতটা বিবেকের দ্বারা পরিচালিত হন এবং কতটা নিজ স্বার্থ বুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হন।
মানুষ রাজনৈতিক জীব। রাজনৈতিক বিশ্বাসকে পুঁজি করে অনেক ফায়দা লাভ করা যায়। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্বাসকে বিশ্বাসের জায়গায় রেখে শ্রেয় বোধের চর্চা করতে পারলে এর চেয়ে ভালো কিছু হতে পারে না। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা অনেকেই নীতি-নৈতিকতা ও শ্রেয়বোধ হারিয়ে ফেলছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেছেন, আমাদের দেশে সমস্যা হয়ে গেছে, এখন রাজনীতি বলতে কিছু নেই। রাজনীতির নামে চলছে অপরাজনীতি। যে কারণে রাজনীতি করার জন্য শুধু লবিং-গ্রুপিং নয়, টাকা-পয়সা পর্যন্ত লেনদেন হয়। এখন রাজনীতি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জায়গায় নেই। রাজনীতিতে আদর্শ অনেক দূরে সরে গেছে।
এখন শিক্ষকদের এ বাস্তবতা মেনে নিয়ে দায়িত্বশীলতার আচরণ করতে হবে।... তিনি বলেন, অনেক সময় কোনো কিছুর সঙ্গে জড়িত না থেকেও রাজনীতির কারণে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। শিক্ষকরা কতটুকু রাজনীতি করবেন বা করবেন না সেটা তাদেরই নির্ধারণ করতে হবে। শিক্ষকদের এখন বড় দায়িত্ব হবে, তাদের শিক্ষক হিসাবে বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখা। প্রফেসর আরেফিন সিদ্দিক শিক্ষকদের রাজনীতিতে জড়িত হওয়া খারাপভাবে দেখেন না। তিনি চান শিক্ষকরা যাতে শিক্ষার্থীসহ সার্বিকভাবে জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারেন।
বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার পীঠস্থানে পরিণত করতে হলে অনেক রকম কাজকর্ম করা যায়। আরেফিন সিদ্দিক সাহেব উপাচার্য হওয়ার পর তাকে বলেছিলাম, তিনি যেন একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগে গিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এ মতবিনিময়ের উদ্দেশ্য হবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার মানোন্নয়ন। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, এ পরামর্শটি বাস্তবায়িত হয়নি।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে একজন জগৎবিখ্যাত অর্থনীতির শিক্ষক ছিলেন। তিনি হলেন মরিস ডব। অবশ্য মরিস ডবের সহকর্মীরা প্রায় একই রকম বিখ্যাত ছিলেন। মরিস ডব ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। তিনি অনেক মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করে গেছেন। তার লেখা গ্রন্থগুলো পড়ার চেষ্টা করেছি। তার প্রতিটি বাক্যের নিহিতার্থ বুঝতে একাধিকবার পড়তে হতো এবং চিন্তা করতে হতো।
এ মানুষটি তার কর্মজীবনের প্রায় পুরো সময় সিনিয়র লেকচারার হিসাবে কাজ করেছেন। জীবনের শেষ প্রান্তে আসার পর তাকে রিডার পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। অথচ অর্থনীতি শাস্ত্রে তিনি যে অবদান রেখেছেন তার জন্য বহু আগেই তাকে ফুল প্রফেসর হিসাবে নিয়োগ দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ একজন ঘোষিত কমিউনিস্টকে পদোন্নতি দিতে চায়নি।
রাজনৈতিক বিশ্বাসের জন্য ত্যাগ স্বীকার করে নিুতর পদে বহাল থেকে জ্ঞানচর্চায় তিনি কখনো নিরুৎসাহিত হননি। যারা তার পদোন্নতিতে বাধা দিয়েছিল তাদের প্রতিও তিনি কোনো ক্ষোভ প্রকাশ করেননি। তার মৃত্যুর পর ক্যামব্রিজ জার্নাল অব ইকোনমিক্স তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছিল। এ সংখ্যায় প্রথম নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ পল এ স্যামুয়েলসন মরিস ডবের তাত্ত্বিক ও দার্শনিক অবদানের গুরুত্ব সম্পর্কে তার মতামত ব্যক্ত করেন।
রাজনৈতিক কারণে বঞ্চনার শিকার হয়েছেন এমন অধ্যাপক আরও অনেকেই আছেন। চেস্টার বাওয়েলস ছিলেন ভারতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত। তার সন্তান স্যাম বাওয়েলস ছিলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তখন ছিল ম্যাকার্থিজমের যুগ। এ সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যদি কেউ সামান্যতম কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন বলে চিহ্নিত হতেন, তিনি যদি কোনো চাকরিতে থাকতেন তখন তাকে বরখাস্ত করা হতো। স্যাম বাওয়েলসকে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বরখাস্ত করা হয় কমিউনিস্ট মনোভাবের অভিযোগে।
যে রাষ্ট্রটি ফ্রিডম ও ডেমোক্রেসির অমৃত বাণী শোনায়, সে রাষ্ট্রটি আসলে কতটুকু ফ্রিডম ও ডেমোক্রেসিতে বিশ্বাস করে? আমাদের বাংলাদেশ একটি স্বল্পোন্নত দেশ। গত প্রায় ৫০ বছরে এ দেশটিতে বহু রকমের পটপরিবর্তন হয়েছে। এখানে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বিরুদ্ধে মতাদর্শিক অভিযোগ সরাসরি উত্থাপন করা হয় না। কিন্তু কায়দা কৌশল করে রাজনৈতিকভাবে অপছন্দনীয়দের বিতাড়ন করার একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রতিশোধ ও নির্মূলের এ প্রক্রিয়া আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে তা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না।
যে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় একটি মহাদেশের শ্রেষ্ঠ ১০০০-এর মধ্যে ঠাঁই পায় না, সে দেশ যে কীভাবে সোনার বাংলা হবে তা বোঝা দুষ্কর। আপাতত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নির্বাচনের সংখ্যা একটু কমিয়ে অথবা অন্য কোনো ধরনের সংস্কার করে পরিস্থিতির উন্নতি হয় কি না দেখা যেতে পারে।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ