শিক্ষক মুরাদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির সত্যতা পেয়েছে পুলিশ
নিজস্ব প্রতিবেদক।।
রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আজিমপুর ক্যাম্পাসের সিনিয়র শিক্ষক মোহাম্মদ মুরাদ হোসেন সরকারের (৪৮) বিরুদ্ধে ছাত্রী নিপীড়নের প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। অভিযুক্ত ব্যক্তির জব্দ করা ফোন ও ল্যাপটপে এ সংক্রান্ত কিছু অডিও, ভিডিও ক্লিপ পেয়েছে পুলিশ।
গতকাল ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ড. খ. মহিদ উদ্দিন। তিনি বলেন, অভিযুক্ত ব্যক্তির ফোন ও ল্যাপটপ জব্দ করে কিছু অডিও, ভিডিও ক্লিপ পাওয়া যায়। ভুক্তভোগী আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ২২ ধারায় সাক্ষ্য দিয়েছেন। আমরা অনেক তথ্য পাচ্ছি। আসামি এসব অভিযোগ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।
এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, কেউই একজন শিক্ষকের কাছ থেকে এ ধরনের আচরণ আশা করে না। ২৬ ফেব্রুয়ারি এক শিক্ষার্থীর মা লালবাগ থানায় আসেন। তিনি অভিযোগ করেন, ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী সপ্তম শ্রেণীতে থাকাকালীন ওই শিক্ষকের কোচিংয়ে পড়তে যেত। তাকে গত বছরের ১০ মার্চসহ বিভিন্ন সময় নানাভাবে যৌন নিপীড়ন করেছেন শিক্ষক মুরাদ।
মহিদ উদ্দিন বলেন, এর আগেও এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ এসেছে। এ নিয়ে কিছু অভিভাবক ও তাদের সন্তানদের বক্তব্য শোনেন কলেজের অধ্যক্ষ। তিনি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। এ ঘটনায় স্কুলে মানববন্ধনও হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি মামলা হওয়ার পর ওই রাতে আসামিকে গ্রেফতার করা হয়।
অভিযোগ এক বছর আগের, এখন সেটা কিভাবে প্রমাণ করা সম্ভব? এমন প্রশ্নে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, ফৌজদারি অপরাধ কখনো তামাদি হয় না, ৫০ বছর হলেও তার বিচার হতে পারে। কোচিংসংক্রান্ত বিরোধ থেকে এমন অভিযোগ আনা হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সেটাও তদন্ত করে দেখা হবে।অপর এক প্রশ্নের জবাবে মহিদ উদ্দিন বলেন, শ্লীলতাহানির অভিযোগ প্রমাণের জন্য মেডিক্যাল প্রতিবেদন জরুরি নয়। অভিযোগ প্রমাণের জন্য আরো অনেক প্রক্রিয়া রয়েছে। আমরা প্রত্যেক নাগরিকের অধিকারের বিষয়ে সংবেদনশীল। যৌন নিপীড়নসংক্রান্ত অপরাধ কত দিন, কত জায়গায়, কতবার হয়েছে, সবই তদন্তের আওতায় আনা হবে।
পুলিশের দাবি স্কুলের পাশে কোচিং সেন্টারে ছাত্রীদের পড়ানোর নামে বিভিন্ন সময় আপত্তিকর স্থানে হাত দেয়াসহ নানা অশোভন আচরণের মাধ্যমে যৌন হয়রানি করেছেন শিক্ষক মুরাদ। যার প্রমাণ পাওয়া গেছে তার মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপে। তিনি একাধিক ছাত্রীর শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানে হাত দিয়েছেন। তাদেরকে জড়িয়ে ধরে চুম্বনও করেছেন। একাধিক ছাত্রীর বেশকিছু অডিও রেকর্ডিং ও কথোপকথনে এর প্রমাণ মিলেছে।
সর্বশেষ গত বছরের ১৯ নভেম্বর স্কুলে পরীক্ষা শেষে শিক্ষক মুরাদের কোচিং সেন্টারে পড়ার কথা বলে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় এক ছাত্রীকে। বিকেলে কোচিং শেষে অন্য ছাত্রীরা চলে গেলেও এক ছাত্রীকে শিক্ষক মুরাদ কৌশলে বসিয়ে রেখে নামাজের রুমে যেতে বলেন। এরপর তাকে জোর করে জড়িয়ে ধরে যৌন নির্যাতন করেন। পরে ভুক্তভোগী ছাত্রীকে মুরাদ বলেন, এই ঘটনা জানাজানি হলে তোমার মা-বাবার সম্মানহানি হবে এবং স্কুল থেকে তোমাকে বের করে দেবে।
গত ৩ ফেব্রুয়ারি ভুক্তভোগী ছাত্রীর মাসহ আরো বেশ কয়েকজন অভিভাবককে নিজ নিজ সন্তানসহ ডেকে নিয়ে বসেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। এ সময় অভিভাবকসহ স্কুলের সাবেক ও বর্তমান অনেক ছাত্রী শ্লীলতাহানির ঘটনা জানান। এরপর গত ২৫ ফেব্রুয়ারি এ ঘটনার বিচার দাবিতে স্কুলের সামনে মানববন্ধনসহ বিক্ষোভ ও সংবাদ সম্মেলন করেন ভুক্তভোগী ছাত্রীরা।
ড. খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, মামলা দায়েরের পর গত ২৭ ফেব্রুয়ারি রাত ১টার দিকে কলাবাগান থানা এলাকা থেকে অভিযুক্ত শিক্ষক মোহাম্মদ মুরাদ হোসেন সরকারকে গ্রেফতার করা হয়।
এ সময় তার ব্যবহৃত একটি মোবাইল ফোন, দুটি সিমকার্ড এবং একটি ল্যাপটপ জব্দ করা হয়। পরবর্তীতে ঘটনার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতের কাছে সাতদিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। শুনানি শেষে দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। রিমান্ডে ঘটনার বিষয়ে শিক্ষক মুরাদকে জিজ্ঞাসাবাদে বিভিন্ন ধরনের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমানে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত আছে। এ ছাড়া, ভুক্তভোগী ছাত্রী আদালতে জবানবন্দী দিয়েছে। শিক্ষক মুরাদের মোবাইল ও ল্যাপটপ থেকে বেশ কিছু ভিডিও ও অডিও রেকর্ড উদ্ধার করা হয়েছে। যা যাচাই-বাছাই অব্যাহত আছে।
ভিকারুননিসা স্কুলের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের পেশাগত অবহেলা রয়েছে কি না জানতে চাইলে ড. মহিদ বলেন, ব্যক্তির দায় কখনো প্রতিষ্ঠান নেয় না। প্রতিষ্ঠানটিতে আরো অনেকে চাকরি করেন। তারা নিশ্চয়ই এমন আচরণ করছেন না। একজন শিক্ষার্থীর সাথে তাদের যে আচরণ করা দরকার তারা সেটা করছেন। বিক্ষিপ্তভাবে একজন শিক্ষক যদি এ ধরনের কাজ করেন সে দায়ভার তো অন্য শিক্ষক নেবেন না।
একই প্রতিষ্ঠানে এমন অভিযোগে তিন শিক্ষকের বিরুদ্ধে তদন্ত হয়েছে, সেই তদন্তে তাদের দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে, এই দায়মুক্তি পুলিশের তদন্তের সাথে সাংঘর্ষিক কি না এমন প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, এটি একটি অ্যাকাডেমিক বিষয়। তদন্তের বিষয়গুলো দেখার জন্য প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং কমিটি রয়েছে। দায়িত্বশীল জায়গাগুলো তারা দেখবেন। তবে ফৌজদারি বিষয়গুলো আমাদের অংশ। আমরা তা দেখছি।
শিবা/জামান