শিক্ষক নিজে এমপি-মন্ত্রী না হলেও তাদের হাতেই তৈরি হয় রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী
একজন শিক্ষক তাঁর শিক্ষার্থীর জীবনে বিভিন্নভাবে প্রভাব বিস্তার করেন। শিক্ষার্থীর মেধা, মনন, জীবনাচরণ থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি স্তরে তাঁর নিজস্ব চিন্তার ছাপ ফেলেন। মার্কিন ঐতিহাসিক হেনরি ব্রুকস্ এডামস বলেছেন, একজন শিক্ষক সামগ্রিকভাবে এমন প্রভাব ফেলে, কেউ বলতে পারে না তার প্রভাব কোথায় গিয়ে শেষ হয়। তাই বলা হয় শিক্ষকগণ কেবল তাঁর বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ। শিক্ষকতা শুধু কোনো পেশা নয়, এটি একটি ব্রত। একটি জাতিকে, একটি সমাজকে প্রগতির দিকে, উন্নতির দিকে অগ্রসর করার ব্রত। যোগ্য শিক্ষকরাই পারেন সমাজের রূপান্তর ঘটাতে। জাপানী একটি বিখ্যাত প্রবাদও আছে, এক হাজার দিনের পরিশ্রমী অধ্যয়নের চেয়ে একদিন একজন শিক্ষকের কাছে অধ্যয়ন করা অধিক শ্রেয়। সঠিক শিক্ষাদানের মাধ্যমে একজন শিক্ষক তার শিক্ষার্থীর সুপ্ত প্রতিভাকে জাগ্রত করতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। তাই সুপ্রাচীনকাল থেকে সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা উঁচু স্থানে প্রতিষ্ঠিত।
বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তান আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন অধ্যয়নে জানা যায়, তিনি সবসময় শিক্ষক/ শিক্ষাবিদদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতেন। তাঁর লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী পাঠেও অনেক ঘটনা জানা যায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির কার্যালয়ে কাজ করার সুবাদে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম স্যারের কাছে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের শিক্ষকভক্তি সম্পর্কে জানার। স্যারের মুখে শোনা যায়, স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা ছাড়াই ডিগ্রী প্রদানের জন্য আন্দোলন করছিল। একপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবরুদ্ধ করে ফেলে। এই খবর শুনেই জাতির পিতা কীভাবে রাষ্ট্রীয় প্রটোকল ভেঙ্গে সরাসরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে এসেছিলেন শিক্ষকদের উদ্ধার করার জন্য। চট্টগ্রাম বিশ্বদ্যিালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের প্রথম চেয়ারম্যান প্রফেসর ইন্নাস আলী তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু উপাচার্যদের প্রায়ই ডাকতেন। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁদের মতামত চাইতেন। বঙ্গবন্ধু আমাকে খুব সম্মান দেখাতেন। ওনার রুমে ঢুকলেই দাঁড়িয়ে যেতেন। অনেক সময় হয়তো মিটিং চলছে তখনও এ রকম দাঁড়িয়ে সম্মান করতেন।’ অধ্যাপক আবুল ফজলের লেখা থেকেও জাতির পিতার শিক্ষকভক্তির দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। আমি নিজেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বেশ কয়েকটি সভায় তাঁর প্রিয় শিক্ষক জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম স্যারের আগমনে দাঁড়িয়ে গিয়ে এগিয়ে যেতে দেখেছি। অমর একুশে বইমেলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর লাল গালিচা তাঁর প্রিয় শিক্ষক জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে ছেড়ে দিয়ে হেঁটে আসা কিংবা মঞ্চে বসে প্রিয় শিক্ষকের গায়ের চাঁদর ঠিক করে দেওয়ার সেই চিত্র বাঙালির গুরুভক্তির অন্যতম দৃষ্টান্ত হয়ে ছুঁয়ে গেছে আপামর জনসাধারণকে।
আরো একটি ঘটনার কথা আমরা জানি, নোবেলবিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আব্দুস সালামও তার নোবেল প্রাপ্তির কথা প্রচার করতে নিষেধ করেছিলেন। কারণ তিনি তার নোবেল প্রাপ্তির কথাটি নিজেই তার শিক্ষককে জানাতে চেয়েছিলেন। এমনকি প্রফেসর ড. সালাম তার শিক্ষক মি. গাঙ্গুলীকে খুঁজে বের করার জন্য ভারত সরকারকে অনুরোধ করেছিলেন। এটি আসলে শিক্ষকের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা, ভালোব
এটি আসলে শিক্ষকের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ। মহাভারতে শ্রেষ্ঠ তীরন্দাজ একলব্য তার ছায়াগুরু দ্রৌনাচায্যর্কে গুরুদক্ষিণা হিসেবে তার ডান হাতের বুড়ো আঙুল কেটে উপহার দিয়েছিলেন। প্রতিটি সমাজব্যবস্থায় শিক্ষকদের মর্যাদা প্রাচীনকাল থেকেই সমুন্নত করা হয়েছে। শিক্ষকরা হারিয়ে যাওয়া সত্যকে সমাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। সত্যকে ধারণ করেন, লালন করেন।
শিক্ষকগণ জ্ঞানের আলো দিয়ে যুগের সব অন্ধকার দূর করে মানুষের জন্য সভ্য পৃথিবী সৃজন করেন। বস্তুত একজন শিক্ষক নিজে কখনো রাষ্ট্রপতি হন না, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী বা সংসদ সদস্য হন না। কিন্তু তাদের হাতেই তৈরি হয় রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিচারপতি, সচিবসহ পুরো সমাজ। এ জন্য তাঁরা জাতি গড়ার কারিগর। এ জন্যই সৃষ্টির শুরু থেকেই তাঁরা শ্রদ্ধার পাত্র। অ্যারিস্টটল, সক্রেটিস থেকে শুরু করে আজকের প্রাথমিক স্কুলের একজন শিক্ষকও এ জন্যই সমান কাতারে—মেরুদণ্ডের কারিগর।
লেখক: উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সিংগাইর, মানিকগঞ্জ
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৫/১০/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়