শিক্ষক ও শিক্ষার্থী একাল সেকাল
-
- নাজমুল হকঃ
বিগত শতাব্দীতে শিক্ষকতা ছিল মহান পেশা। বাবা-মার পর শিক্ষকরাই ছিল শিশুদের মানুষ করে তোলার বড় কারিগর। ছাত্রদের পারিবারিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মনিটরিং করতেন শিক্ষক।
শুধু টাকা কড়ি রোজগারের উদ্দেশ্যে কেউ শিক্ষকতার পেশায় আসত না। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। ছাত্ররা শিক্ষকদের সম্মান করত এবং শিক্ষকরা ছাত্রদের দেশপ্রেম মূল্যবোধ শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করত। অধিকাংশ স্কুল ও কলেজে লেখাপড়া সিলেবাস মোতাবেক শেষ করা হতো। শিক্ষকদের আলোচনা শুনে এবং ক্লাসের নোট গ্রহণ করে ছাত্রদের প্রাইভেট পড়তে হতো না। একবিংশ শতাব্দীতে শিক্ষা পুরোপুরি বাণিজ্যিক। প্রাইভেট পড়া ছাড়া বোঝার সুযোগ নেই। কোচিং সেন্টারের দ্বারস্থ হতে হবে ভালো রেজাল্ট করতে হলে। যার টাকা আছে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ আছে তার। শিক্ষকরা রাজনৈতিক দলের লেজুরবৃত্তিক সন্ত্রাসীদের আশ্রয় ও প্রশ্রয় দেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটিতে রাজনৈতিক দলের লিডারদের সভাপতি হিসেবে অংশগ্রহণ শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেম্বার এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের জনপ্রতিনিধি। রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় দুর্নীতির বিস্তার ঘটেছে শিক্ষাঙ্গনে। প্রধান শিক্ষক রাজনৈতিক দলের লিডারদের হস্তক্ষেপে। স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে প্রতিষ্ঠান, পরিচালনা করতে পারছে না।
৮০-র দশকে হাই স্কুলের শিক্ষকরা এসএসসি পরীক্ষার্থী ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়া তদারকি করত শীতের রাত্রে ছাত্রদের বাড়ি বাড়ি ভিজিট করে। গভীর রাতে বাইসাইকেলের আওয়াজ পাওয়া গেলে সবাই বুঝতে পারত হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক বা শ্রেণী শিক্ষক এসেছেন। আজকাল ডিজিটাল যুগে শিক্ষকতা হলো কোচিং বাণিজ্য বা প্রাইভেট টিউশন বাণিজ্য। শ্রেণী শিক্ষকের সাথে ছাত্রের দেখা সাক্ষাৎ হবে কোচিং সেন্টারে অথবা টিউশন কক্ষে। ঢাকার নামীদামি স্কুলের সামনে আছে ব্যাঙের ছাতার মতো কোচিং সেন্টার। অধিকাংশ কোচিং সেন্টারের মালিক দামি স্কুলের শিক্ষকরা। কোচিং সেন্টারের মালিক শিক্ষক অভিভাবককে বলে দেন আপনার ছেলেমেয়েকে কোচিং না করালে এ+ পাবে না। শিক্ষকদের পেশা এবং নেশা কোচিং বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়া। ঢাকা ও চট্টগ্রাম, রাজশাহী খুলনা সিলেট ইত্যাদি বিভাগীয় শহর, শহরগুলোতে শত শত কোচিং সেন্টার। কোচিং সেন্টারের মালিক হাইস্কুল কলেজ শিক্ষকরা গাড়ি বাড়ির মালিক হয়েছেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আইনে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এত কিলোমিটার দূরে স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসা কিন্ডারগার্টেন স্কুল করা যাবে। কিন্তু স্কুলের দেয়াল ঘেঁষে কোচিং সেন্টার করলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোন বিধিনিষেধ নেই। ঢাকা শহরে নামীদামি স্কুলের সাথে ব্যাঙের ছাতার মতো কোচিং সেন্টার। কোচিং সেন্টার পরিচালনা করে কোটি টাকার ফ্লাটের মালিক হয়েছে কোচিং সেন্টারের শিক্ষকরা।
কোচিং সেন্টারে ভর্তি ফি, মাসিক পরীক্ষার ফি, ক্লাসপার্টির চাঁদা, মাসিক বেতন, বিভিন্ন দিবস পালনের ফি আদায় করা হয়। কোচিং সেন্টার মানেই ছাত্রসংখ্যা ২০-৩০ জন। পাঠদানের সময় ১ ঘণ্টা ৩০ মিনিট। সপ্তাহে তিন দিন। ব্যাচে মাসিক বেতন ছাত্রপ্রতি ২৫০০ টাকা থেকে ৩,৫০০ টাকা। কোচিং সেন্টারের ব্যাচ সারা বছর ধরেই চলে। ব্যাচের বিষয় ইংরেজি, বাংলা, বিজ্ঞান, বাণিজ্য, গণিত ইত্যাদি। যদি কোচিং সেন্টারে ছেলেমেয়েদের পড়াতে হয় তাহলে নামী দামি স্কুলের শিক্ষিক-শিক্ষিকাদের কাজ কী? এ সব স্কুলে সকাল অথবা দুপুরে আপনার আমার ছেলে-মেয়েদের যাওয়ার দরকার আছে কি? সরকার এমপিওভুক্ত স্কুলের শিক্ষকদের বেতনভাতা, ঈদ বোনাস, প্রভিডেন্ট ফান্ড পেনশন ইত্যাদি সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে কেন?
সরকার শত শত স্কুল ও কলেজ জাতীয়করণ করছে। শিক্ষকদের বেতনভাতা ও বোনাস, প্রভিডেন্ট ফান্ড, পেনশন প্রমোশন প্রশিক্ষণ ইত্যাদি সুযোগ সুবিধা দিতেছে। লেখাপড়া তদারকির জন্য পরিচালনা কমিটি থানা শিক্ষা অফিসার ও জেলা শিক্ষা অফিসার আছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে পরিদর্শক টিম আছে! অভিভাবকরা স্কুলের ভর্তি ফি মাসিক বেতন পরীক্ষার ফি পরিশোধ করছে। সরকার স্কুলের যাবতীয় ব্যয় বহন করছে। তাহলে অভিভাবকরা ছেলেমেয়েকে কেন কোচিং সেন্টারে পাঠাচ্ছেন। এক দিকে রাষ্ট্রের টাকা খরচ হচ্ছে, অন্যদিকে অভিভাবকদের পকেটের টাকা খরচ হচ্ছে। বাজেটের একটা বিশাল অংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় হচ্ছে। এই বিশাল বাজেটের কারণে প্রতি বছর দেশের হাজার হাজার কোটি টাকার অপচয় করা হচ্ছে কি?
পরীক্ষার ফলাফল এ+ নিয়ে টানাটানি: হাউজ টিউটর সপ্তাহে তিন দিন নির্দিষ্ট বিষয় পড়িয়ে বলছেন, আমার ছাত্র বা ছাত্রী এ+ পেয়েছে এই কৃতিত্ব তার। কোচিং সেন্টার নির্দিষ্ট বিষয় সপ্তাহে তিন দিন পড়িয়ে বলে, এ+ আমদের কোচিং সেন্টারের কৃতিত্ব। স্কুলের শিক্ষক ও পরিচালনা কমিটি বছর শেষে পোস্টার ব্যানার ছাপিয়ে বলে এই এ+ এর কৃতিত্ব তাদের। শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে সেরা স্কুলের তালিকা দিয়ে বলছে এটা দেশের সেরা স্কুল। এ+ এর কৃতিত্বের দাবিদার স্কুলের প্রধান শিক্ষক শিক্ষামন্ত্রী ইত্যাদি মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচার করে থাকে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাস করে ছাত্রছাত্রীদের পেশা নিয়ে ভাবনা :
১. একজন বিসিএস পাস করে আমলা হলো। তার ভাবনা সে সবার থেকে আলাদা।
২. আরেকজন বুয়েট থেকে পাস করল। তাকে বিসিএস পরীক্ষা দেবে কিনা জিজ্ঞেস করলে সে বলবে, ‘বিসিএসই যদি দিতে হয় এত কষ্ট করে বুয়েটের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লাম কেন?’ তার কাছে বিসিএস-এর মূল্যই নেই!
৩. আরেকজন জজ। সে ভাবছে, ‘আমিই পৃথিবীর সেরা জব হোল্ডার। সচিব আমলা এমপি মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও যদি দুর্নীতির মামলা হয়, তবে আমার কোর্টে এসে আমাকে স্যার বলতে হবে।
৪. আরেকজন ব্যবসায়ী। সে ভাবছে, ‘চাকরিজীবীরা হচ্ছে চাকর। এ জাতীয় পেশায় স্বাধীনতা নেই। আমার পেশায় চাইলেই ছুটি কাটানো সম্ভব। সেদিক দিয়ে আমার পেশাই সেরা। দেশের অর্থনীতিতে আমাদের অবদানই বেশি। আমাদের কাউকে স্যার বলতে হয় না। তাই আমাদের প্রফেশনই সেরা।’
আসলে দেশের সেরা কে? আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়, সমাজে মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণ করে কারা। যদি আপনি লক্ষ্য করেন তাহলে দেখবেন কিভাবে কম মেধাবীরা বেশি মেধাবীদের নিয়ন্ত্রণ করে। প্রথমত, মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে পড়ে। স্বপ্ন ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ইত্যাদি হবে।
১. প্রথম মেধাবী শিক্ষার্থীরা ডাক্তারি এবং ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হয়।
২. দ্বিতীয় মেধাবিী শিক্ষার্থীরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়।
৩. যারা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার সেনাবাহিনীর অফিসার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারেনি তারা বিসিএস দিয়ে আমলা হয়।
৪. যারা মেডিক্যাল কলেজ ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হতে পারেনি তাদের একটি অংশ জেলা ও উপজেলার কলেজে ভর্তি হয়ে ফুল টাইম রাজনৈতিক দলে যোগ দেয়।
৫. আরো অনেক কম মেধাবী শিক্ষার্থীরা ঠিকাদারি টেন্ডার বাণিজ্য ও রাজনৈতিক দলের প্রভাব খাটিয়ে জেলায় আইনজীবী হিসেবে পেশা গ্রহণ করে। এভাবে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারেনি তারা গডফাদার বিভিন্ন বাহিনীর মাধ্যমে কালোবাজারি নিয়ন্ত্রণ করে। একটা সময়ে এরাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান, মেয়র, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ইত্যাদি। আস্তে আস্তে সংসদ সদস্য ও আইনপ্রণেতা ইত্যাদি কম মেধাবী শিক্ষার্থীরা দখল করে।
৬. মেধাবী ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়ন্ত্রণ করে উপজেলা ও জেলার আমলারা। আবার উপজেলায় আমলাদের নিয়ন্ত্রণ করে উপজেলা চেয়ারম্যান এবং আইনপ্রণেতারা। ঠিকাদার টেন্ডারবাজি লোকজন নিয়ন্ত্রণ করে মেধাবী ইঞ্জিনিয়ারদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণ করে সচিব ও মন্ত্রীরা ইত্যাদি।
৭. একজন শিক্ষিত মানুষকে জিজ্ঞেস করুন, ‘কোন পেশা বা ক্যাডারদের মধ্যে কোন ক্যাডার বেশি সম্মানের?’ পদ ও ক্ষমতা মর্যাদার দিকে একজন সচিব সবার উপরে। আবার ওই সচিবকে জিজ্ঞেস করুন আপনার ছেলেমেয়েকে কী বানাতে চান। অধিকাংশ সচিবও চায় তার ছেলে যেন ডাক্তার বা বুয়েটে চান্স পায়।
তবে দেশের টেন্ডারবাজি ব্যবসায় বাণিজ্য ও রাজনৈতিক দলের পদপদবি এবং ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার জনপ্রতিনিধি ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ অনেকাংশে কম মেধাবীরা করে থাকে। ভাবতে হবে কিভাবে শিক্ষকদের পাঠদানের পরে যেন হাউজ টিউটর এবং কোচিং সেন্টারে আপনার আমার ছেলে-মেয়েকে পাঠানোর প্রয়োজন যেন না পড়ে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট নায়েম বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর সবাই কমবেশি শিক্ষা ও গবেষণার জন্য উন্নত রাষ্ট্র ভ্রমণ করে থাকে। উন্নত রাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে দেখুন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য কোচিং সেন্টার নেই, তাহলে বাংলাদেশে কোচিং সেন্টারের বাণিজ্য আছে কেন?
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার অভাবে অনেক ছাত্রছাত্রী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রনেতারা টর্সারসেল বানিয়ে আবরার ফাহাদের মতো নিরীহ মেধাবী শিক্ষার্থীদের হত্যা করছে। সানজিদা চৌধুরী অন্তরাদের অত্যাচারে ফুলপরী খাতুনকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পালিয়ে যেতে হয়েছে। ইডেন কলেজে লেখাপড়া ছেড়ে অশ্লীলতার ছড়াছড়ি দেশব্যাপী আলোড়ন তুলেছিল। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় ছাত্রছাত্রী নির্যাতন নজীরবিহীন। এগুলো আমাদের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের কোন অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে এখনই ভেবে দেখা দরকার।
লেখক : গবেষক ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৫/০২/২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়