নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে আওয়ামী লীগ শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন স্কেল চালু করবে বলে ঘোষণা দিয়েছিল। তবে অজ্ঞাত কারণে তা কার্যকর হয়নি। টানা ১৪ বছর ধরে তা শুধু প্রতিশ্রুতিতেই আটকে আছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে এ বিষয়ে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই।

২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়ন ও উচ্চ বেতন নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। 'সংকট মোচন ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে আওয়ামী লীগের রূপকল্প ২০২১ সাল, কেমন বাংলাদেশ দেখতে চাই' শীর্ষক নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির 'শিক্ষা' উপ-শিরোনামেও বিষয়টির উল্লেখ আছে। এতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় :'২০১৪ সালে নিরক্ষরতা সম্পূর্ণ দূর, শিক্ষার মানোন্নয়নে বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন প্রজন্ম গড়ে তোলা এবং শিক্ষকদের উচ্চতর বেতন সুবিধা নিশ্চিত করা হবে।' ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়নের লক্ষ্যে স্থায়ী পে কমিশন, শিক্ষক নিয়োগের জন্য স্বতন্ত্র কমিশন গঠন ও সম্মানজনক সম্মানী প্রদানের কথা বলা হয়েছিল।

২০১৪ সালের ইশতেহারেও মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের পৃথক বেতন স্কেল প্রদান এবং স্থায়ী বেতন কমিশন গঠনের বিষয়টি উল্লেখ ছিল। একই কথা বলা হয়েছে ২০১০ সালে জাতীয় সংসদে পাস হওয়া জাতীয় শিক্ষানীতিতেও। জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়, 'আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সকল স্তরের শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা হবে।' নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ও জাতীয় শিক্ষানীতিতে এভাবে পরিস্কার অঙ্গীকার থাকার পরও পৃথক স্কেলের কোনো খবর নেই।

শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘদিনেও সরকারের এ নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ না হওয়ায় তাঁরা হতাশ। শিক্ষকতা পেশায় নিম্ন বেতন ও সুযোগ-সুবিধার অভাবে দেশের বহু মেধাবী শিক্ষার্থী শিক্ষকতা পেশায় নিজেদের ক্যারিয়ার গড়তে রাজি নন। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতায় পদমর্যাদার সংকটের পাশাপাশি বেতনও কম। নিম্ন বেতন ও সামাজিক পদমর্যাদা শিক্ষকতায় মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে পারছে না।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকতা ছাড়া প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়েও শিক্ষকতায় মেধাবীদের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। বিষয়টি শিক্ষার জন্য খুবই উদ্বেগজনক দাবি করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী সমকালকে বলেন, এ অবস্থা থেকে উত্তরণে শিক্ষার সামগ্রিক বাজেট বাড়াতে হবে। প্রকৃত মেধাবীদের এ পেশায় আনতে বেতন ও পদমর্যাদা বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেকারত্ব কাটাতে নিম্ন মেধার লোকজনও শিক্ষকতায় ঢুকে পড়েছে। জ্ঞানের চর্চা ও বিকাশ এতে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।

এমন বাস্তবতার মাঝে আজ ৫ অক্টোবর বুধবার দেশে পালিত হচ্ছে 'বিশ্ব শিক্ষক দিবস।' ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘ এ দিনটিকে শিক্ষক দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এর পর থেকেই

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হচ্ছে। এ বছর এই দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে- 'শিক্ষকদের দ্বারা শিক্ষায় রূপান্তর শুরু।'
বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালন উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ আজ বুধবার সকাল ১১টায় রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এক আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ মো. শাহজাহান আলম সাজুর পরিচালনায় এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান। বিশেষ অতিথি থাকবেন মাগুরা-১ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট সাইফুজ্জামান শিখর।

বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারী ফোরাম দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে আজ সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের অডিটোরিয়ামে 'বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শন এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ' শীর্ষক এক আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম এতে প্রধান অতিথি থাকবেন। বিশেষ অতিথি থাকবেন আ. কা. ম. সরওয়ার জাহান বাদশাহ এমপি, মো. এনামুল হক এমপি, ডা. মো. আব্দুল আজিজ এমপি এবং হাবিবা রহমান খান এমপি।
সরকারি-বেসরকারি বেতন বৈষম্য তীব্র :দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন স্তরের শিক্ষকদের মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি খাতে বেতন বৈষম্য তীব্র। বৈষম্য সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও। অথচ একই শিক্ষাগত যোগ্যতায় তাঁদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।

সরকারি শিক্ষকরা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) মাধ্যমে নিয়োগ পাচ্ছেন। বর্তমানে বেসরকারি শিক্ষকরাও কেন্দ্রীয়ভাবে 'জাতীয় শিক্ষা নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ' (এনটিআরসিএ)-এর মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নিয়োগ পাচ্ছেন। একই সিলেবাস ও কারিকুলামে তাঁরা পাঠদান করলেও বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। অথচ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ৯৮ শতাংশই বেসরকারি খাতের। শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সংখ্যাতেও তাঁরা বেশি।

জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও প্রবীণ শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ সমকালকে বলেন, জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এ শিক্ষকদের মধ্যে বৈষম্য ক্রমশ কমিয়ে আনার কথা বলা আছে। সমযোগ্যতায় চাকরি আর সমপরিমাণ শ্রম দিলেও বেতন-ভাতায় অধিক বৈষম্য কাম্য নয়। অপর এক শিক্ষক নেতা বলেন, সরকারি ও বেসরকারি খাতে পার্থক্য থাকবে- সেটিই স্বাভাবিক। তবে বৈষম্য থাকতে পারে না। এখন সরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের সঙ্গে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের যে পার্থক্য, তা রীতিমতো বৈষম্য।

সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন। ২০১৫ সালের জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী সব সুযোগ-সুবিধা পান তাঁরা। স্কেলভিত্তিক পূর্ণ বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা হিসেবে ১৫০০ টাকা, বার্ষিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধিও পান। এর বাইরে উৎসব বোনাস স্কেলভিত্তিক দেওয়া হয়। পরবর্তী স্কেল নির্ধারণকৃত ও চলমান। ধারাবাহিক প্রমোশন ও বদলির ব্যবস্থা চালু আছে। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের বেতন স্কেল ৩৫,৫০০ টাকা (৬ষ্ঠ গ্রেড)। অথচ বেসরকারি প্রধান শিক্ষকরা ২৯ হাজার স্কেলে (৭ম গ্রেড) বেতন পান। সরকারি শিক্ষকদের বিভাগীয় ভাতার ব্যবস্থা আছে। অবসরের পর পরিপূর্ণ অবসর ভাতাসহ মাসিক পেনশন আছে। সরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের তাঁদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য স্বল্প ও নির্ধারিত ব্যয় করতে হয়। তাঁদের সন্তানরা সরকার থেকে শিক্ষা ভাতা পায়।

সবচেয়ে বড় পার্থক্য পদমর্যাদায়। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড সরকারি কর্মকর্তার পদমর্যাদা ভোগ করেন। বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কোনো পদমর্যাদাই নির্ধারণ করা নেই।

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন স্কেলও সরকারিদের সমানই। তবে কেবল মূল বেতনটুকুই সমান, বাকি সব ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁরা পিছিয়ে আছেন। ৩০ হাজার বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী প্রতি মাসে সরকার থেকে মূল বেতন পান। এর সঙ্গে নামমাত্র বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা দেওয়া হয়। তাঁদেরকে বর্তমানে জাতীয় বেতন স্কেল-২০১৫ অনুযায়ী মূল বেতনের শতভাগ বেতন প্রদান করা হয়। সঙ্গে দেওয়া হয় মাত্র ১ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া। এটি নির্ধারিত। অর্থাৎ বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির কোনো সুযোগ নেই। চিকিৎসা ভাতা নির্ধারিত; মাত্র ৫০০ টাকা।