শিক্ষকতার অনুভবে দূঃখবোধ ও দায়িত্বচেতনা
অধ্যাপক মো. আলী এরশাদ হোসেন আজাদ।।
সবাই কম বেশি নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও একজন আদর্শ শিক্ষক তেমন হন না। মন-মননে শিক্ষার্থীর স্বার্থ ও উন্নতির মধ্যেই শিক্ষকের জীবনের সাফল্য ও আনন্দ নিহিত। পৃথিবীতে খুব কম মানুষই আছেন যারা অপরের সুখ ও সাফল্য দেখে খুশি হন, শর্তহীন আনন্দের বিষয় মনে করেন। তবে দু’ধরনের মানুষ, অপর মানুষের সাফল্য ও প্রতিষ্ঠার মধ্যে জীবনের সাফল্য-স্বার্থকতা খুঁজে পান। তারা হলেন; পিতামাতা ও শিক্ষক। সন্তানের সাফল্যে পিতামাতা যেমন গর্ব অনুভব করেন, তার চেয়ে বেশি গর্ব ও আনন্দ অনুভব করেন একজন শিক্ষক তার ছাত্রের সাফল্য ও প্রতিষ্ঠায়। এখানেও পিতামাতার কিছু জাগতি স্বার্থ থাকলেও, শিক্ষকের আনন্দ সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ-নির্মোহ।
-
শিক্ষক কখনোই শিক্ষার প্রতিপক্ষ নন। অথচ শাস্তির খড়গ, চাকুরিচ্যুতির হুমকী, প্রভাবশালীদের অন্যায় আবদারে দিনে দিনে শিক্ষকতা যেন নিরানন্দ-নির্মোহ পেশা হয়ে যাচ্ছে। কারণ, শিক্ষাব্যবস্থার সব ত্রæটি, সব ব্যর্থতার দায় কেবল শিক্ষকের ওপর চাপানো যেন এখন ফ্যাশন হয়ে গেছে। যেমন-
ছাত্র বে-আদবি করে, দায়ি কে: শিক্ষক!
শিক্ষার মান কমে যাচ্ছে, দায়ি কে: শিক্ষক!
মেয়ে ফেসবুকে প্রেম করে, দায়ি কে: শিক্ষক!
ছাত্র পরীক্ষায় খারাপ করেছে, দায়ি কে: শিক্ষক!
ছেলেমেয়েরা বাবামার কথা শোনেনা, দায়ি কে: শিক্ষক!
মোবাইল, মটর সাইকেল কিনে দিতে ছেলেমেয়েরা চাপ দিচ্ছে, দায়ি কে: শিক্ষক!
ছোটবেলায় ছেলে নামায পড়তো, বড় হয়েছে- নামায পড়েনা, দায়ি কে: শিক্ষক!
অথচ, এখন শিক্ষার্থীর গুরু কেবল কি শিক্ষক? না, ওদের গুরু থাকেন নেপথ্যে, ওদের বখে যাবার গোড়ার কুশিলবরা থাকেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে! ওরা এখন মেনেজ হচ্ছে নানান পথ ও কৌশলে!
সার্বিক পর্যালোচনায় বলতে পারি, আমাদের সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক ত্রুটি দূর করা না হলে আমাদের সব প্রচেষ্টাই থাকবে অসম্পূর্ণ। বিষয়টি ভেবে দেখতে হবে।
১২.১০.১৭ মাউশির প্রজ্ঞাপনে শ্রেণি কক্ষে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মোবাইল ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু দেশে সম্ভবত সরকারি আদেশটি বাস্তবায়ন হয়নি। পাবলিক পরীক্ষায় তো কেন্দ্র সচিব ছাড়া অন্যদের মোবাইল বহন-ব্যবহার নিষিদ্ধ ও গুরুতর অপরাধ। অথচ মোবাইল বহন-ব্যবহারে প্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ সব পক্ষই ঐকমত্য হয়েছে নিরবে- ‘যে য্-াই বলুক ভাই, আমার মোবাইল সঙ্গে রাখা চাই’।
প্রফেসর মুহম্মদ জাফর ইকবাল ২০ অক্টোবর ২০১৭ তাঁর ‘শিক্ষক এবং শিক্ষকতা’ শিরোনামের লেখায় বলেছেন “আমাকে একজন জিজ্ঞেস করেছে, আপনার বেশ কয়েকটি পরিচয় আছে.... আপনার কোন পরিচয়টিতে আপনি পরিচিত হতে চান? আমি এক মুহূর্ত দ্বিধা না করে বলেছি আমি শিক্ষক পরিচয়ে পরিচিত হতে চাই..... আমরা ফাইল নিয়ে কাজ করি না, যন্ত্র নিয়ে কাজ করি না, আমরা কাজ করি রক্তমাংসের মানুষ নিয়ে। যাদের চোখে রঙিন চশমা এবং যারা ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে”। কাজেই, শিক্ষার্থীকে স্বপ্ন দেখানোর মধ্যেই তো একজন শিক্ষকের সার্থকতা।
যে পর্যায়েরই হোক না কেনো, সব শিক্ষকের ভাবনার বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে প্রফেসর মুহম্মদ জাফর ইকবালের বক্তব্যে। প্রকৃত শিক্ষক আসলে খুব বেশি কিছু পাবার আশায় থাকেন না। বরং প্রফেসর মুহম্মদ জাফর ইকবাল তাঁর ‘শিক্ষক এবং শিক্ষকতা’ শিরোনামের লেখায় বলেছেন “আমরা যারা শিক্ষক তারা সত্যিকারের মানুষ নিয়ে কাজ করি।..... যে ছাত্রটি প্রায় কিশোর হিসেবে একদিন পড়তে এসেছিল, এখন সে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে, দেখে কী ভালই না লাগে। শুধু আমরা শিক্ষকরাই সেই আনন্দটুকু পেতে পারি...”। এখানেই কাদের নওয়াজের ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ কবিতার সার্থকতা:
“....স্পর্ধার কাজ হেন অপরাধ কে করেছে কোন্ কালে!
ভাবিতে ভাবিতে চিন্তার রেখা দেখা দিল তার ভালে।
হঠাৎ কি ভাবি উঠি
কহিলেন, আমি ভয় করি না’ক, যায় যাবে শির টুটি,
শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার
দিল্লীর পতি সে তো কোন্ ছার,
ভয় করি না’ক, ধারি না’ক ধার, মনে আছে মোর বল....”।
আমরা জানি, যেনতেন উপায়ে পরীক্ষায় পাস করা জীবনের উদ্দেশ্য হতে পারে না। নকল করা, দেখাদেখি করা, ফেসবুক, প্রশ্নপত্র ফাঁস, কোচিং সেন্টারের অসৎ বানিজ্যিক কৌশল, তথাকথিত ১০০% কমন সাজেশানের মোহে গা ভাসিয়ে দেওয়া শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবার জন্য অশোভনীয়ই নয় বরং অন্যায়-অনৈতিক। অথচ এগুলোই এখন বিশেষ প্যাকেজ মনে হয়! যেন কেউ আর শিক্ষার্থী হবার দরকার নেই, আমরা চাই ভাল পরীক্ষার্থী- যেন ভাল ছাত্রের প্রয়োজন নেই।
মানুষের জীবন আসলে কতগুলো পরীক্ষার সমষ্টি মাত্র। জীবনের সব মূহুর্ত শেখার এবং সবদিনই পরীক্ষার। বলা হয় ‘ছাত্র জীবন মধুর জীবন যদি না থাকে বীধসরহধঃরড়হ’! অথচ ইদানিং শিক্ষার্থী অভিভাবক সবাই আছে এক দৌড়ে, যেখানে কেউ হারতে চায় না। পরীক্ষার আগের রাতে এখন দেখা যায়, পরীক্ষার্থী ফেসবুক নিয়েই বেশি ব্যস্ত, পড়ার ‘বুক’ থাকে অযতœ-অবহেলায়। চোখবন্ধ করে পড়া মুখস্ত করা বাদ দিয়ে যারা ফেসবুকে মত্ত থাকবার মধ্যে পরীক্ষায় সাফল্য খুঁজে তারা মাথা উুঁচু করে দাঁড়াবে? বরং ওরা আছে ঘাড় নিচু করে ঘষাঘষিতেই চরম ব্যস্ত!
ফেসবুক অন্যান্য অনেক কিছুর কল্যাণে এখন আর দেখে লেখার প্রয়োজন হয় না, কাগজে কলমে নকলও হয় না। ‘নকলমুক্ত পরিবেশে’র তকমা রক্ষার তাগিদে এখন বহিষ্কারের ঘটনাও প্রায় ঘটেনা। পরীক্ষার হলে আগের মতো ‘কড়া গার্ডের’ প্রবণতাও কমেছে। কেউ কেউ এখন আর অন্যায় দেখেও দেখেন না। ‘বহিষ্কার’ মানেই যেন ঝামেলায় জড়ানো! ‘বহিষ্কার’ করবার নৈতিক শক্তিও অনেকের লোপ পেয়েছে।
অন্যদিকে, সৃজনশীল ও বহুনির্বচনী প্রশ্নপত্রের কল্যাণে উচ্চ নম্বর প্রাপ্তির সংখ্যাও বেড়েছে। কিন্তু কোথায় ও কেনো এবং কী কারণে শিক্ষার মান কমছে তা ভাবা হয়না, শুধু দোষ চাপানো হয় শিক্ষককে।
অথচ শিক্ষককে প্রতিপক্ষ না বানিয়ে বরং আমাদের আগামী প্রজন্ম তথা জাতি ধ্বংসকারী অপতৎপরতা রোধে শিক্ষক, অভিভাবক ও সচেতন নাগরিক সমাজের সোচ্চার ভূমিকা রাখা জরুরি। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এবং তা এখনই। তবেই পরীক্ষায় অনৈকিতা প্রতিরোধ সম্ভব।
অন্যদিকে শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। বাংলাদেশের সংবিধানেও সার্বজনীন, গণমুখী ও বৈষম্যহীন শিক্ষার অঙ্গিকার রয়েছে। অথচ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সব স্তরে সরকারি বেসরকারি ব্যবস্থার বিভক্তি রেখা সুস্পষ্ট ও বেদনাদায়ক। একদেশ, একই শিক্ষাপদ্ধতি ও অভিন্ন শিক্ষা বিভাগে প্রাথমিক, ইবতিদায়ি, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, ক্যাডেট ও উচ্চ শিক্ষার সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে। এগুলোর সিলেবাস এক, পাঠ ও পরীক্ষা পদ্ধতি এক। অথচ, সুযোগের বেলায় সরকারি ও বেসরকারির ক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পার্থক্য আকাশ-পাতাল। বেসরকারি খাতে শিক্ষাক্ষেত্রে যে বৈষম্য তা এখন কাম্য নয়। অথচ বাস্তবে দেখা যায়,
ক) বেসরকারি পর্যায়ে শিক্ষার্থীর ব্যয় বেশি অথচ শিক্ষকের বেতন কম।
খ) সরকারি পর্যায়ে শিক্ষার্থীর ব্যয় কম অথচ শিক্ষকের বেতন বেশি।
সম্ভবতঃ এটাই শিক্ষার মান উন্নয়নে প্রধান অন্তরায়। এজন্যই প্রয়োজন ও সর্বজন স্বীকৃত বাস্তব আকাক্সক্ষা শিক্ষা জাতীয়করণ। অথচ, যখন জাতীয়করণের লক্ষে শিক্ষকরা সবার মনোযোগ আকর্ষণে তৎপর হয় তখন অনেকেই ভাবেন: শিক্ষকরা টাকার জন্য এ সব করে। এমন ধারনা শিক্ষকসমাজের জন্য পীড়াদায়ক। এগুলো নিতান্তই হীন মানসিকতা ও বিভ্রান্তিকর। টাকার কাঙ্গালরা অন্যসব কিছু করলেও শিক্ষকতা করেন না। নিতান্তই নিরিহ, নির্লোভরাই শিক্ষক হন। দারুণ সম্ভাবনা ছেড়েও অনেকে শিক্ষকতায় আসেন কেবল অন্তরের আকাক্সক্ষা ও জাতির প্রতি কৃতজ্ঞতার ঋণ শোধের দায়ে।
মানুষের মৌলিক প্রয়োজন অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থানের মতোই ‘শিক্ষা’ মানুষের মৌলিক অধিকার। একটি কল্যাণরাষ্ট্র মানুষের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়। কাজেই, এক ঘোষণায় ও নিঃশর্তভাবে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একযোগে জাতীয়করণ হলে শিক্ষার মান যেমন বাড়বে, তেমনি সর্বস্তরের বৈষম্য হ্রাস পাবে।
পরিশেষে নিবেদন, আমি যা কিছু বললাম তা হয়তো অনেকের কাছে চর্বিত চর্বণ মনে হতে পারে। এখানে কথাগুলো রূঢ় মনে হলেও, আমার সুদীর্ঘ পেশাগত অবস্থান বারবার বহুভাবে আমাকে নানান তিক্ত বাস্তবতার নিরব সাক্ষী করেছে। তবু- আমার প্রত্যাশা এক ঘোষণায় ও একযোগে ‘শিক্ষা জাতীয়করণ’ নিঃশর্ত বাস্তবায়ন ঘটবে অতিশীঘ্রই।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান ইসলামিক স্টাডিজ কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ কাপাসিয়া গাজীপুর